জুলাই-আগস্টের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ১৩ আসামিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামের বক্তব্যে উঠে আসে ‘গণহত্যার’ কথা। তার দাবি, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে উপস্থিত আসামিরা ‘গোটা জাতিকেও’ হত্যায় দ্বিধা করতেন না।
সোমবার (১৮ নভেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালে তাজুল ইসলাম ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
এই টিনশেড ভবনেই আজ আদালত বসেছিল
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের শুরু থেকেই শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী এমপিদের বিরুদ্ধে ‘গণহত্যার’ অপরাধে বিচারের কথা বলে আসছে। সাবেক সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা ও প্রতিমন্ত্রীদের এই প্রথম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হলো।
গত ৫ আগস্ট দুপুরে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরও তার নেতাকর্মীরা ওইদিন গভীর রাত পর্যন্ত ‘গণহত্যা’ চালায়— দাবি করে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘‘এক ব্যক্তি (শেখ হাসিনা)-কে ক্ষমতায় রাখতে গোটা জাতিকে হত্যা করতে তারা দ্বিধা করত না।’’
এদিন সকাল ১০টায় একাধিক প্রিজন ভ্যানে করে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, ফারুক খান, শাহজাহান খান, কামাল আহমেদ মজুমদার, গোলাম দস্তগীর গাজী, দীপু মনি, জুনায়েদ আহমেদ পলক, শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, তৌফিক-ই-ইলাহী, আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাঙ্গীর আলমকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়।
আব্দুর রাজ্জাককে হাজির করার নির্দেশ থাকলেও টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানার এক মামলায় রিমান্ডে থাকায় তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়নি। ১০টা ৫০ মিনিটে হাজতখানা থেকে তাদের এজলাসে তোলা হয়। সকাল ১১টার দিকে শুনানি শুরু হয়।
শুনানি শুরু হলে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘আজ ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ১৩ আসামিসহ অন্যান্যরা তিন বাহিনীর ওপর চাপ অব্যাহত রাখে, যেন তাদের ক্ষমতায় রাখা যায়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় শতাধিক শিশু হত্যার শিকার হয়। ‘আড়াই হাজার’ লোক মারা যায়।’’
আসামিপক্ষে শুনানি করতে পারেননি সমাজী
এদিন পাঁচ আসামির পক্ষে শুনানি করার কথা ছিল সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট এহসানুল হক সমাজীর। কিন্তু ‘রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হচ্ছেন’ এমন খবরে শুনানি থেকে বিরত থাকেন তিনি।
এর আগে তাজুল ইসলাম আদালতকে মেনশন করে বলেন, ‘‘আজকে আসামিপক্ষে সিনিয়র অ্যাডভোকেট এহেসানুল হক সমাজী শুনানি করতে এসেছেন। তবে তিনি রাষ্ট্রীয় একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ পদে’ বসতে যাচ্ছেন বলে জেনেছি। দু’একদিনের মধ্যেই হয়তো সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করবে। তাই তিনি আসামিপক্ষে শুনানি করলে এটা হবে কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট।’’
তাজুল ইসলাম তাকে আসামিপক্ষে শুনানি না করতে অনুরোধ জানান।
আসামিপক্ষের একজন আইনজীবীর ব্রিফিং
‘রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হচ্ছেন’ খবরে এহেসানুল হক সমাজী আদালতকে বলেন, ‘‘আমি এখনো ফরমাল কোনও লেটার পাইনি। ফরমাল লেটার না পাওয়া পর্যন্ত কিছু বলতে পারছি না। এ ছাড়াও যে পদে আমাকে নির্বাচিত করা হবে, সেটা আমি গ্রহণ করি কি না, তাও ভাবার বিষয়।’’
এ সময় বিচারক জানতে চান, কোন আসামির পক্ষে তিনি এসেছেন। উত্তরে সমাজী পাঁচজন আসামির নাম বলেন। এরা হলেন— সালমান এফ রহমান, আনিসুল হক, তৌফিক-ই-এলাহী, ফারুক খান ও জুনায়েদ আহমেদ পলক।
পরে সমাজী শুনানি না করে আরেক আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলুকে দায়িত্ব দেন।
সকাল ১১টায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়ে শুনানি শুরু হয়। প্রথমে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম শেখ হাসিনার সাড়ে ১৬ বছরের বিভিন্ন অপরাধের তথ্য বিশদভাবে তুলে ধরেন। যাকে তিনি ‘ফ্যাসিবাদের দুঃশাসন’ হিসেবে অভিহিত করেন।
এর মধ্যে গুম-খুন, সরকারি প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ, বিচার বিভাগকে ব্যবহারসহ নানা বিষয় ছিল। এরপর গত ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের তথ্য তুলে ধরেন। কীভাবে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা-গুলি চালানো হয়—সেসব বিষয়ে আলোচনা তুলে ধরেন।
‘ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে উৎখাতের পথ সুগম ছিল না’ মন্তব্য করে চিফ প্রসিকিউটর ট্রাইব্যুনালে বলেন, ‘‘আড়াই হাজার প্রাণ, ২৫ হাজার আহতের মাধ্যমে সর্বগ্রাসী শাসন থেকে ন্যায়পরায়ণ দেশ পেয়েছি। ‘জেন-জির’ চূড়ান্ত আত্মত্যাগে নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি।’’
আদালতের কার্যক্রম শেষে মামলার আসামিদের বের হতে দেখা যাচ্ছে
তাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। এরপর থেকে শুরু হয় স্বৈরাচারী আচরণ। বিরোধীদের দমন, গুম, খুন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া, ভিন্ন মত পোষণকারীদের নিপীড়ন করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা তুলে নেওয়া হয়।’’
‘‘২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বী সরকার গঠন। ২০১৮ সালে বিএনপি অংশ নিলে কারচুপি, দিনের ভোট রাতে করে। ২০১৪ এর আমি/ডামি নির্বাচন করে জোর করে ক্ষমতায় বসে। ফ্যাসিবাদের ১৫ বছরে হাসিনার নেতৃত্বে হত্যা, গুম, হেফাজতে ইসলামের ওপর হত্যাকাণ্ড, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। প্রহসনের বিচার চলতো। আয়নাঘর সৃষ্টি করে।
‘‘গত ১৫ বছরে ৬১১ জনকে গুম করা হয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, মূল্যস্ফীতি, অর্থপাচারের ঘটনা ঘটে। দুই লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। শেয়ারবাজার থেকে লাখ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। ‘রাজাকার’ শব্দ ব্যবহার করে জাতিকে বিভক্ত করা হতো। মানুষ একটা সুযোগ খুঁজছিল। কোটা আন্দোলন পরে গণআন্দোলনে রূপ নেয়।’’
‘বন্দি বিনিময় চুক্তির আওতায় শেখ হাসিনাকে ফেরানোর চেষ্টা হবে’
এরপর আদালত জানতে চান, শেখ হাসিনার ওয়ারেন্টের কী হলো? তাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘ইস্যু হয়নি। তিনি পালিয়ে গেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানতে পেরেছে, তিনি ভারতে অবস্থান করছেন। ‘বন্দি বিনিময় চুক্তির’ মাধ্যমে সরকার তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে।’’
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা তদন্তে দুই মাস সময় চায় তদন্ত সংস্থা। পরে আদালত এক মাস সময় মঞ্জুর করেন। আগামী ১৭ ডিসেম্বর প্রতিবেদন জমা দিতে বলেন। এ সময়ের মধ্যে ওয়ারেন্ট কার্যকর করতেও নির্দেশ দেন।
এরপর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের অভিযোগের বিষয়ে শুনানি হয়। তাজুল ইসলাম বলেন, ‘‘এ মামলায় ১৪ জন গ্রেপ্তার আছেন। এদের মধ্যে ১৩ জনকে হাজিরা করা হয়েছে। আব্দুর রাজ্জাককে হাজির করা হয়নি। তাদের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ।’’
তিনি বলেন, ‘‘দেশব্যাপী কোটা আন্দোলন শুরু হয়। বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়। সংস্কারের জোর দাবি জানানো হয়। হাসিনা ১৪ জুলাই আন্দোলন প্রতিহত করতে উসকানিমূলক বক্তব্য দেয়। ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল, আনিসুল হক, দীপু মনি, আ ক ম মোজাম্মেল হক, সজিব ওয়াজেদ জয়ও উসকানিমূলক বক্তব্য দেয়। এছাড়া আন্দোলন দমনে গণহত্যার নির্দেশ দেয়।’’
‘হাসিনার পরিবার দুর্নীতি-টাকা পাচার করে, অন্যদেরও সুযোগ করে দেয়’
ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম আদালতকে বলেন, ‘‘হাসিনার পরিবারের সদস্যরা ১৬ বছরে দুর্নীতি, টাকা পাচার করে এবং অন্যদেরও সুযোগ করে দেয়। এদের মধ্যে রয়েছেন-শেখ রেহানা, সজিব ওয়াদেদ জয়, ববি, শেখ সেলিম, হাসানাত আব্দুল্লাহ, সাদিক আব্দুল্লাহ, শেখ হেলাল, সারহান নাসের তন্ময়, মজিবুর রহমান নিক্সন চৌধুরী।’’
‘‘পাশাপাশি দেশব্যাপী হত্যাযজ্ঞ চালাতে তাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে। ডিবির হারুন, বিপ্লব, প্রলয় কুমার জোর্য়াদার, হাবিবুর রহমান, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামু, তারেক আনাম সিদ্দিকীর প্রত্যক্ষ নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় দিনের পর দিন হত্যাযজ্ঞ চলতে থাকে। শাসসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, জাফর ইকবাল, নিঝুম মজুমদারও আন্দোলনের সময় উসকানিমূলক বক্তব্য দেন।’’
তবে অভিযোগ আসা আরও কয়েকজনের নাম বলতে চাননি এ প্রসিকিউটর।
তাজুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ১৩ আসামি বিষয়েও তদন্ত শেষ করতে দুই মাস সময় চেয়ে আবেদন করা হয়। আদালত তদন্ত শেষ করতে এক মাস সময় দেন।
ট্রাইব্যুনালে যেমন ছিলেন আসামিরা
এদিন সকাল ১০টায় একাধিক প্রিজন ভ্যানে করে ১৩ আসামিকে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসা হয়। দীপু মনি ব্যতীত ১২ জনকে ১২২ নং কক্ষে রাখা হয়। দীপু মনিকে রাখায় অন্য কক্ষে। ১০টা ৫০ মিনিটের দিকে আসামিদের এজলাসে নিয়ে আসা হয়। সেখানে আসামিদের বসার জন্য নির্দিষ্ট স্থানে তারা বসেন।
এ সময় হাসানুল হক ইনু, বিচারপতি মানিককে হাস্যোজ্জ্বল দেখা যায়। সালমান এফ রহমান তার আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেন। সিনিয়র আইনজীবী এহেসানুল হক সমাজী আনিসুল হকসহ কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলেন।
ট্রাইব্যুনাল থেকে বেরিয়ে দুহাত তুলে দোয়া চাইলেন পলক
সকাল ১১টায় আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়। এ সময় আসামিরা কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরে যার যার স্থানে বসেন। বিচার কার্যক্রম চলাকালে কামাল আহমেদ মজুমদার ১২টার সময় চেয়ার থেকে উঠে আদালতের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে যান। তাকে থামিয়ে দেন কয়েকজন পুলিশ সদস্য। তিনি দাঁড়িয়েই থাকেন। কয়েক মিনিট পর আবার আদালতের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চান। এ সময়ও ব্যর্থ হন তিনি।
বেলা ১২টা ৮ মিনিটের দিকে আদালতের কার্যক্রম শেষ হয়।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিলো।
এখন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত জুলাই ও অগাস্টের আন্দোলন সময় সংঘটিত ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে বর্ণনা করে এ আদালতে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের বিচারের কথা বলছে সরকার।
গত ১৭ অক্টোবর শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়।