বুধবার সকাল ১০ টা ১০ মিনিট। পুলিশের একটি প্রিজন ভ্যান এসে থামে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। একে একে নামানো হয় মিরপুরের সাবেক ডিসি মো. জসিম উদ্দিন মোল্লা, ঢাকা জেলার সাবেক পুলিশ সুপার মো. আব্দুল্লাহ আল কাফি, গুলশান থানার সাবেক ওসি মাজহারুল হক, ঢাকা উত্তর ডিবির সাবেক পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন, যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান ও ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত সুপার (সাভার সার্কেল) মো. শাহিদুর ইসলামকে।
তখন এসে পৌঁছায়নি সাবেক পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসান। ১০ মিনিট পর তাকে নিয়ে ট্রাইব্যুনালের সামনে আসে আরেকটি প্রিজন ভ্যান। তাদের ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় রাখা হয়। সকাল পৌনে ১১টার দিকে তাদের ট্রাইব্যুনালের এজলাসে নেওয়া হয়। ১১ টা ২০ মিনিটের দিকে আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়।
প্রথমে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা ওকালতনামায় স্বাক্ষর নেওয়ার আবেদন করেন। চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম এতে আপত্তি করেন। জেলখানায় গিয়ে কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে স্বাক্ষর নেওয়ার কথা জানান তিনি। পরে আদালত বলেন, আজকের জন্য হোক। এরপর আর না। আমরাই তো বলেছি। পরে আইনজীবীরা আসামিদের স্বাক্ষর নেন।
এরপর চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, গত ২৭ অক্টোবর কয়েকজনের বিরুদ্ধে প্রোডাকশন ওয়ারেন্টজারি করা হয়। আজ ৮ জনকে হাজির করা হয়েছে। এই ৮ আসামির বিরুদ্ধে তদন্ত সংস্থা থেকে প্রাপ্ত অভিযোগ সংক্ষেপে তুলে ধরতে চাই। প্রথমে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে পাওয়া অভিযোগ তুলে ধরা হয়।
তাজুল ইসলাম বলেন, ‘৫ আগস্ট সরকার পতনের আগে ও পতনের পর আইজিপি ছিলেন এই আসামি। তার নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনী ও এর বিভিন্ন সংস্থা জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নির্বিচারে গুলি করে। অপরাধ সংগঠনের প্রধান হোতা চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। তার নেতৃত্বে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হয় সারাদেশে সুপিরিয়র অবস্থানে এ আসামি। আন্দোলনের সময় তার অধীনে একজন ব্যতীত বাকিরা কাজ করেন। তারা বেপরোয়া হায়েনা ছিলেন। গণহত্যার সুপ্রিম কমান্ডার ছিলেন মামুন। তার নির্দেশে, পরিকল্পনায় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। এ গণহত্যার দায় তার ওপর বর্তায়।’
জিয়াউল আহসানের বিষয়ে বলেন, ‘তার বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ১৯৯১ সালে কমিশন্ড পদে যোগদান করেন। ২০০৯ সালে উপ-অধিনায়ক হন। র্যাবে চাকরি করেন। গুম-খুনের সাথে তিনি জড়িত। এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক ছিলেন। সরকার বিরোধীদের শায়েস্তা করার দায়িত্ব ছিল তার ওপর। আন্দোলনের সময় ইন্টারনেট বন্ধে তার ভূমিকা ছিলো। দেশে গুমের ঘটনা তার হাত ধরে। তার দ্বারা অসংখ্য ব্যক্তি গুমের শিকার হন। এখনো কয়েকজন গুম রয়েছে। গুমের নেপথ্যেও কারিগর তিনি। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীসহ বিরোধীদের গুম করতেন তিনি। কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারতেন না। ফ্যাসিস্ট সরকার তার কাছ থেকে সুবিধা নিতো। আর সেও দাপটের সাথে চাকরি করতেন। আন্দোলনের সময় ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন শিক্ষার্থীদের ঘরে ফিরে যেতে। সরকার পতনের পর অবশ্য তা ডিলিট করেছে। আয়নাঘর, বন্দিদশা তৈরি তার হাতে। ফ্যাসিস্ট সরকারের হুমকিদাতাদের ধরে এনে আয়নাঘর, বন্দিদশায় রাখা হতো। ২০২২ সাল থেকে এনটিএমসির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পান। এরপর থেকে কল রেকর্ড ফাঁস করতেন। তিনি দায়িত্ব পাওয়ার পর আড়িপাতার সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। দিনের পর দিন কলরেকর্ড ফাঁস করতেন। ইন্টারনেট বন্ধ করে আন্দোলনকারীদের হত্যায় তার ভূমিকা রয়েছে। তারা নাস্তি বাহিনীর চেয়ে ভয়ঙ্কর।’
জসিম উদ্দিনের বিষয়ে বলেন, তিনি মিরপুরের ডিসি ছিলেন। আন্দোলনের সময় মিরপুরে যত নিষ্ঠুরতার ঘটনা ঘটেছে এর নেতৃত্বে ছিলেন তিনি।
আব্দুল্লাহ আল কাফির বিষয়ে বলেন, এসপি থাকার সময় প্রায় শতাধিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে তার নেতৃত্বে। ইয়ামিন নামে এক যুবককে এপিসি থেকে গুলি করে। ইয়ামিন পানি খেতে চায় পানি দেয়। কিন্তু চিকিৎসার ব্যবস্থা করেনি। তিন ঘণ্টা পর হাসপাতালে নেওয়া হলে ইয়ামিন মারা যায়। তার লাশ দাফনে বাধা দেয়। পরে গোপনে তার লাশ দাফন করা হয়। আন্দোলনের সময় আশুলিয়া থানার সামনে ৬ জনকে গুলি করে হত্যা করে। প্রথমে লাশগুলো রিকশাভ্যানে করে থানায় নেয়। পরে পুলিশভ্যানে তোলে। এরপর গাড়িতে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দেয়। আন্দোলনকারীদের ওপর দায় চাপাতে তারা এ নাটক করে।
শাহিদুর ইসলামও আশুলিয়ার ওই ৬ লাশ পোড়ানোর ঘটনায় জড়িত। ওসি মাজহারুল ইসলামও ওই নির্মম হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত। তাদের নেতৃত্বে এ ঘটনা ঘটে।
এ সময় আসামির ডকে বসে থাকা মাজহারুল ইসলাম দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমি কখনো সাভারের ওসি ছিলাম না। গুলশানের ওসি ছিলাম। এ ঘটনার সাথে আমি জড়িত না। এ কথা বলে উচ্চস্বরে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। ছাত্রদের আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন বলে জানান। কোনো হত্যাকাণ্ড ঘটাননি বলেও দাবি করেন।
তখন চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদার তাকে আশ্বস্ত করে বলেন, নির্দোষ হলে আপনি ন্যায়বিচার পাবেন। পরে তাজুল ইসলাম সাভার এলাকার অভিযোগ তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় বলে জানান। আরাফাত হোসেনও ৬ লাশ পোড়ানোর ঘটনার সাথে জড়িত।
এরপর তাজুল ইসলাম আবার ওসি মাজহারুলের বিষয়ে অভিযোগ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, গুলশান এলাকায় আন্দোলনে গিয়ে আবির, নাইমুর রহমান, বাহাদুর হোসেন মানিক, সোহাগ, ওয়াসিম মারা যান। এ সময় গুলশান থানার ওসি ছিলেন মাজহারুল ইসলাম। একত্রিত হয়ে তারা এসব হত্যাকাণ্ড চালান।
আবুল হাসানের বিষয়ে বলেন, যাত্রাবাড়ী থানায় সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। গোটা দুনিয়া তা দেখেছে। আবুল হাসানের প্রত্যক্ষ নির্দেশে অধীনস্থরা হত্যাকাণ্ড চালায়। মানবতাবিরোধী অপরাধ করে। দিনের পর দিন শত শত আন্দোলনকারীকে হত্যা করে। আন্দোলন দমনে অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করে কয়েক হাজার মানুষকে আহত করে। ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়ে ছাত্রদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করে। পরে তাদের ধরে নিয়ে টর্চার করে। আহতদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে বাধা দিয়ে সময়ক্ষেপণ করে। সব অভিযোগ আবুল হাসানের বিরুদ্ধে। সেখানকার একটা ঘটনা থেকে আরেকটা ঘটনা বেশি নির্মম।
তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই ৮ জনকে গ্রেপ্তার রাখার প্রার্থনা করেন তিনি। একই সাথে মামলার তদন্ত শেষ করতে দুই মাস চান চিফ প্রসিকিউটর।
এ সময় আদালত জানতে চান, তদন্ত কতদূর পর্যন্ত। তখন তাজুল ইসলাম বলেন, চেষ্টা করবো দ্রুত সময়ের মধ্যে তদন্ত শেষ করার। কাঁচের মত স্বচ্ছ করে বিচার করতে চায় আমরা। প্রমাণ করবো তারা কি করেছে। তাদের প্রতি যেন কোনো অবিচার না হয়। আর ভুক্তভোগী পরিবার যেন ন্যায়বিচার পায়।
এরপর জিয়াউল আহসানের পক্ষে তার আইনজীবী নাজনীন নাহার একটি আবেদন করেন। তবে যথাযথ প্রসেস মেইনটেন না থাকায় প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম এতে আপত্তি জানান। এ বিষয়ে আর শুনানি হয়নি।
পরে আদালত ৮ আসামিকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানোর আবেদন মঞ্জুর করেন। আগামী ১৯ ডিসেম্বরের মধ্যে আসামিদের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করতে সময় বেঁধে দেন। ১২ টা ৫ মিনিটের দিকে আদালতের কার্যক্রম শেষ হয়।