ফারজিব সালমান : একটা প্রতিষ্ঠান তাদের ইচ্ছেমত টাকা ব্যয় করে সেরা কর্মীদের নিয়োগ দিলেও অফিসের বস যদি খারাপ হয় তাহলে ওইসব কর্মীরা সুযোগ পাওয়া মাত্রই চাকরি ছেড়ে চলে যাবে।
অন্যদিকে, যদি অফিসে ভালো ম্যানেজার বা দলনেতা থাকে তাহলে তারা চাকরি তো ছাড়বেই না বরং কর্মীদের থেকে সেরাটাই পাওয়া যাবে।
বিগত ১০ বছর যাবত গুগল ‘প্রজেক্ট অক্সিজেন’ নামে একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে। তাদের লক্ষ্য ছিল, কোন কোন গুণাবলির কারণে কেউ সেরা ম্যানেজার হয়ে উঠে তা খুঁজে বের করা। কেননা তাহলে গুগল তাদের দলনেতাদেরকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সেসব গুণাবলি অর্জন করিয়ে আদর্শ ম্যানেজার হিসেবে গড়ে তুলবে। তাদের এ গবেষণার সাফল্য পাওয়া গেছে। সময়ের সাথে সাথে গুগলের কর্মী টার্নওভার বেড়েছে, কর্মীদের কর্মদক্ষতা বেড়েছে ও কর্মীদের মধ্যে সন্তুষ্টি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ম্যানেজারদের কারিগরি দক্ষতাকে আমরা যতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করি তার চাইতে বহুলাংশে কম। বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, ম্যানেজারদের মানসিক দক্ষতা- যা দিয়ে সে নিজের ও কর্মীদের মানসিকতা বুঝতে ও আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
গুগলের গবেষণা অনুসারে জেনে নিন, সেরা ম্যানেজারদের মধ্যে যে ১০টি বিষয় বিদ্যমান থাকে।
* একজন ভালো প্রশিক্ষক
সেরা ম্যানেজাররা তৎক্ষণিক কোনো সমস্যার সমাধান দেন না বরং কর্মীদের শিখানোর মাধ্যম হিসেবে তা ব্যবহার করেন। তারা তাদের দলগুলো পরিচালনা করেন এবং প্রয়োজনে দিকনির্দেশনা দেন। এতে করে দলগুলো সময়ের সাথে সাথে পরিণত হতে ও মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে।
* দলের কর্মীদের ক্ষমতায়ন করা এবং অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ না করা
‘আমি অতিরিক্তভাবে নিয়ন্ত্রিত হতে ভালোবাসি’- কোনো কর্মীই কখনো এ একথা বলেনি।
বিপরীতে সেরা ম্যানেজাররা কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের কাঙ্ক্ষিত (নতুন নতুন আইডিয়া উদ্ভাবন করার, ঝুঁকি নেয়ার, ভুল করার) স্বাধীনতা দেন। কর্মীদের জন্য কাজের সুবিধামত সময় ও কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করেন।
* সাম্যাবস্থার দলীয় কর্মপরিবেশ তৈরি করা এবং সাফল্যের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকা
অন্য একটি গবেষণা প্রকল্পের মাধ্যমে গুগল আবিষ্কার করেছে উচ্চমানের দলীয় কর্মদক্ষতা লাভের একমাত্র চাবিকাঠি হচ্ছে, দলের মধ্যে ‘মানসিকভাবে নিরাপদ’ কর্মপরিবেশ তৈরি করা।
গুগলের মতে, ‘একটি দল যেখানে উচ্চ মানসিক নিরাপত্তা রয়েছে সেখানে দলীয় কর্মীরা তাদের সাথীদের মাঝে ঝুঁকি নিতে নিরাপদ অনুভব করবে। তারা নিশ্চিন্ত থাকবে যে তাদের কোনো ভুল স্বীকার করার জন্য কিংবা প্রশ্ন করার জন্য কিংবা নতুন আইডিয়া দেয়ার জন্য দলের কেউ তাদের শাস্তি দিবে না কিংবা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলবে না।’
অর্থাৎ, সেরা দলগুলো বিশ্বাসের উপর জোরদার থাকে। সেরা ম্যানেজাররা দলের মধ্যে সেই বিশ্বাসটা গড়ে তুলতে সাহায্য করেন।
* উৎপাদনশীল ও ফলাফলভিত্তিক
সেরা ম্যানেজার হচ্ছেন একজন তারকা খেলোয়াড়ের চাইতেও বেশি কিছু। তারা দলের মধ্যে সঠিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। যখন যেমন প্রয়োজন তেমনভাবে কাজ করেন। তারা কঠোর পরিশ্রম করতে এবং অন্যকে সাহায্য করতে কার্পণ্য করেন না। এটি তাদের দলকে অনুপ্রাণিত করে।
* একজন ভালো যোগাযোগকারী- কথা শোনেন এবং তথ্য শেয়ার করেন
সেরা ম্যানেজাররা হলেন একজন ভালো শ্রোতা। এটা তাদের দলকে বুঝতে ও যথাযথ সহানুভূতি প্রদর্শনে সাহায্য করে। উপরন্তু ভালো ম্যানেজাররা জানেন জ্ঞানই শক্তি। একারণেই তারা থাকেন ছলাকলাহীন এবং দলকে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদানে রাজি। সুতরাং তাদের কর্মীরা জানে কোনোকিছু হওয়ার আসল কারণ।
* ক্যারিয়ারের উন্নতিকে সমর্থন করেন এবং কর্মদক্ষতা নিয়ে আলোচনা করেন
সেরা ম্যানেজাররা তাদের কর্মীদের আন্তরিক ও সুনির্দিষ্ট বিষয়ে প্রশংসার মাধ্যমে অনুপ্রাণিত করেন। কিন্তু পাশাপাশি তারা সমালোচনামূলক প্রতিক্রিয়াও শেয়ার করেন। তারা এমন কৌশলে এটি করেন যাতে এটি গঠনমূলক মনে হয়।
তারা দলীয় কর্মীদের ব্যক্তিগত কর্মজীবনের লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে তাদের উপর বিনিয়োগ করেন৷ এর মাধ্যমে তারা স্বাভাবিকভাবেই তাদের দলকে (দলীয় কর্মীদের) এ সহায়তার প্রতিদান দিতে অনুপ্রাণিত করেন।
* দলের জন্য তার একটি সুনির্দিষ্ট কৌশল থাকে
একজন সেরা ম্যানেজার জানেন তার দল এখন কোন অবস্থানে আছে, ভবিষ্যতে দলের লক্ষ্য কি এবং সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে কি করতে হবে। ভালো যোগাযোগের মাধ্যমে তারা তাদের দলকে সঠিক পথে রাখতে সাহায্য করেন। এবং দলের কৌশল বাস্তবায়নে দলের প্রত্যেক সদস্য তাদের ব্যক্তিগত ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন কিনা তা নিশ্চিত করেন।
* প্রয়োজনীয় প্রায়োগিক দক্ষতা থাকে
সেরা ম্যানেজাররা তাদের কর্মীদের প্রতিদিনকার দায়িত্ব ও বাধা সহ তাদের কাজ বুঝেন। যদি ম্যানেজার অন্য সেকশনে বদলি হয়ে যান, তাহলে সেখানে কোনো পরিবর্তন আনতে কিংবা পরামর্শ দেয়ার আগে কর্মীদের সঙ্গে বিশ্বাস তৈরিতে কাজ করেন।
* কার্যকরভাবে সহযোগিতা করা
খারাপ ম্যানেজাররা তাদের দলকে একরোখাভাবে ভালো করতে চায় এবং কোম্পানির অন্যদলগুলোর বিরুদ্ধে কাজ করে বা কূটাঘাত করে অন্যদলগুলোকে। এতে কোম্পানির ক্ষতি হয়।
বিপরীতে, ভালো ম্যানেজাররা কোম্পানির ভালোর জন্য কাজ করেন। কোম্পানির সব দলকে সমানভাবে দেখেন এবং তাদের দলকেও সেটা করতে অনুপ্রাণিত করেন।
* একজন দক্ষ সিদ্ধান্তগ্রহণকারী
সেরা ম্যানেজাররা আবেগপ্রবণ হয় না বরং তারা হয় স্থির বুদ্ধিসম্পন্ন। দলের বর্তমান পরিস্থিতি জানার যদি এমন সিদ্ধান্তও নিতে হয় যে কেউ অনুমোদন করবে না তবুও দলের অবস্থান চিন্তা ও বিবেচনা করে তারা সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেন।
যেসব ম্যানেজার এই দশটি কাজ করে তাদের যদি আপনার প্রতিষ্ঠান প্রশিক্ষণ দেয় এবং পদোন্নতি দেয় তাহলে আপনি আপনার কর্মীদের মধ্যে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারবেন এবং কর্মীদের সেরাটা বের করে আনতে অনুপ্রাণিত করতে পারবেন।
তখন কর্মীরা আপনাকে নিজেরাই অনুসরণ করতে চাইবে আর বাধ্য হয়ে অনুসরণ করবে না।
তথ্যসূত্র : আইএনসি
পড়ুন :
* রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ জুলাই ২০১৯/ফিরোজ