বর্তমানে দেশে ৯০ লাখের বেশি টিআইএনধারী আছেন। আয়করের ব্যাপ্তি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তারপরও দেখা যায়, দেশের প্রায় ৪০% থেকে ৫০% মানুষ আয়কর সম্পর্কিত আজানা ভীতি থেকেই এড়িয়ে যেতে চান। অনেক ক্ষেত্রে আয়কর সনদ বিশেষভাবে প্রযোজ্য হয়েছে, যা আগে ছিল না। দিনে দিনে বাড়ছে আয়কর এর বাধ্যবাধকতা এবং প্রয়োজনীয়তা। ৪৩টি ক্ষেত্রে রিটার্ন জমা দেওয়ার প্রমাণপত্র লাগে। আগে টিআইএন থাকলেই হতো। এখন টিআইএন থাকলেই আপনার করযোগ্য আয় থাকুক বা না থাকুক, আপনাকে আয়কর রিটার্ন দিতে হবে, কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া। জেনে নিন, কাদের আয়কর রিটার্ন দিতে হবে এবং দিতে হবে না।
যাদের আবশ্যিকভাবে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে ১. করদাতার মোট আয় করমুক্ত আয়ের সীমা অতিক্রম করলে; ২. সংশ্লিষ্ট আয়বর্ষের অব্যবহিত পূর্ববর্তী তিন বছরের মধ্যে কোনো বৎসর তার কর নির্ধারণ করা হয়; ৩. কোনো ফার্ম, কোনো ব্যক্তিসংঘ ও কোনো ফার্মের অংশীদার হলে; ৪. কোম্পানির কোনো শেয়ারহোল্ডার পরিচালক বা কোনো কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার কর্মচারী হলে; ৫. গণকর্মচারী হলে; ৬. কোনো ব্যবসায় নির্বাহী বা ব্যবস্থাপকের পদধারী কোনো কর্মচারী; ৭. কেবল দাতব্য উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত কোনো প্রতিষ্ঠান ব্যতীত, সংশ্লিষ্ট আয়বর্ষে এরূপ কোনো আয়প্রাপ্ত হন বা অংশ ৬-এর প্রথম অধ্যায়ের অধীন কর অব্যাহতি বা হ্রাসকৃত কর হার সুবিধাপ্রাপ্ত। ৮. ধারা ২৬১ অনুসারে করদাতা হিসেবে নিবন্ধনযোগ্য কোনো ব্যক্তি; বা ৯. ধারা ২৬৪ অনুযায়ী রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ দাখিলের বাধ্যবাধকতা রয়েছে, এমন ৪৩টি ক্ষেত্রে।
যাদের আয়কর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক নয় ধারা ১৬৬ (২) অনুযায়ী নিম্নবর্ণিত ব্যক্তিদের জন্য আয়কর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক নয়, যথা- (ক) কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১) যা বাংলা ভাষায় পাঠদানকারী প্রাথমিক বা প্রাক্-প্রাথমিক বিদ্যালয় বা সরকারি মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় বা যা মাসিক পেমেন্ট আদেশভুক্ত (এমপিও) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান; এবং ২) যার ইংরেজি ভার্সন কারিকুলাম নেই; (খ) সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়; (গ) বাংলাদেশ ব্যাংক; (ঘ) স্থানীয় কর্তৃপক্ষ; (ঙ) সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ বা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, যার সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্ত তহবিল ও সুদ আয় ছাড়া অন্য আয় নেই; (চ) আপাতত বলবৎ কোনো আইন দ্বারা বা আইনের অধীন প্রতিষ্ঠিত বা গঠিত যেকোনো সত্তা, যাদের সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্ত তহবিল ছাড়া অন্য কোনো আয় নেই; (ছ) সরকারি ভবিষ্য তহবিল ও সরকারি পেনশন তহবিল; (জ) কোনো অ-নিবাসী স্বাভাবিক ব্যক্তি, যার বাংলাদেশে কোনো নির্দিষ্ট ভিত্তি নেই; বা (ঝ) বোর্ড কর্তৃক, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, রিটার্ন দাখিল করা হতে অব্যাহতিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের।
যেসব আয়ের ওপর কর দিতে হবে না বছর ঘুরে চলে আসে। আয়কর রিটার্ন দেওয়ার সময় চলে আসে প্রতিবছর। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে আয়কর রিটার্ন দিতে হবে, যদি এর মধ্যে সময়সীমা না বাড়ানো হয়। কথা হচ্ছে, সব আয়ের ওপর কি কর দিতে হয়? কিছু কিছু আয় আছে, যা করমুক্ত, অর্থাৎ তার ওপর কর দিতে হয় না। চলুন, জেনে নেওয়া যাক সেসব আয় সম্পর্কে।করদাতার করমুক্ত ও কর অব্যাহতিপ্রাপ্ত আয় থাকলে তা রিটার্নে উল্লেখ করতে হবে। ব্যক্তিকরদাতার করমুক্ত আয়ের কয়েকটি খাত (উদাহরণ) নিচে উল্লেখ করা হলো:
(১) সরকারি পেনশন তহবিল থেকে করদাতা কর্তৃক গৃহীত বা করদাতার বকেয়া পেনশন; (২) সরকারি আনুতোষিক তহবিল থেকে করদাতা কর্তৃক আনুতোষিক হিসেবে গৃহীত অনধিক ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা আয়; (৩) কোনো স্বীকৃত ভবিষ্য তহবিল, অনুমোদিত বার্ধক্য তহবিল, পেনশন তহবিল ও অনুমোদিত আনুতোষিক তহবিল হতে সুবিধাভোগীদের মধ্যে বিতরণকৃত আয়, যা ওই তহবিল থেকে করারোপিত হয়েছে; (৪) ভবিষ্য তহবিল থেকে আইন, ১৯২৫ (১৯২৫ সনের ১৯ নং আইন) প্রযোজ্য এরূপ কোনো ভবিষ্য তহবিলের উদ্ভূত বা উপচিত অথবা ভবিষ্য তহবিল থেকে কোনো আয়; (৫) সরকারি সংস্থা, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বা স্বায়ত্তশাসিত বা আধা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও তাদের নিয়ন্ত্রিত ইউনিট বা প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো কর্মচারী স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণের সময় এ উদ্দেশ্যে সরকার কর্তৃক অনুমোদিত কোনো পরিকল্প অনুসারে গৃহীত যেকোনো পরিমাণ অর্থ; (৬) পেনশনারস সেভিংস সার্টিফিকেট থেকে সুদ হিসেবে গৃহীত কোনো অর্থ বা গৃহীত অর্থের সমষ্টি, যে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আয়বর্ষ শেষে ওই সার্টিফিকেটের বিনিয়োগকৃত অর্থের মোট পুঞ্জীভূত অর্জিত মূল্য, প্রকৃত মূল্য, আক্ষরিক মূল্য, ক্রয়মূল্য অনধিক ৫ লাখ টাকা হয়; (৭) কোনো নিয়োগকারী কর্তৃক কোনো কর্মচারীর ব্যয় পুনর্ভরণ যদি—(ক) ওই ব্যয় সম্পূর্ণভাবে ও আবশ্যকতা অনুসারে কর্মচারীর দায়িত্ব পালনের সূত্রে ব্যয়িত করা হয়; এবং(খ) নিয়োগকারীর জন্য ওই কর্মচারীর মাধ্যমে এরূপ ব্যয় নির্বাহ সর্বাধিক সুবিধাজনক ছিল; (৮) কোনো অংশীদারি ফার্মের অংশীদার হিসেবে কোনো করদাতা কর্তৃক মূলধনি আয়ের অংশ হিসেবে প্রাপ্ত আয়ের অংশ, যার ওপর ওই ফার্ম কর পরিশোধ করেছে; (৯) হিন্দু অবিভক্ত পরিবারের সদস্য হিসেবে একজন করদাতা যে পরিমাণ অর্থ প্রাপ্ত হন, যার ওপর ওই পরিবার কর পরিশোধ করেছে; (১০) বাংলাদেশি কোনো স্বাভাবিক ব্যক্তিকরদাতা কর্তৃক বিদেশে উপার্জিত কোনো আয়, যা তিনি বৈদেশিক রেমিট্যান্স-সম্পর্কিত বিদ্যমান আইন অনুসারে বাংলাদেশে এনেছেন; (১১) কোনো করদাতা কর্তৃক ওয়েজ আর্নারস ডেভেলপমেন্ট ফান্ড, ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড, ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড, ইউরো প্রিমিয়াম বন্ড, ইউরো ইনভেস্টমেন্ট বন্ড, পাউন্ড স্টারলিং ইনভেস্টমেন্ট বন্ড বা পাউন্ড স্টারলিং প্রিমিয়াম বন্ড থেকে গৃহীত আয়; (১২) রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার ক্ষুদ্র জাতিসত্তার কোনো স্বাভাবিক ব্যক্তির আয় যা কেবল ওই পার্বত্য জেলায় পরিচালিত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে উদ্ভূত; (১৩) কোনো স্বাভাবিক ব্যক্তির ‘কৃষি হতে আয়’ খাতের অন্তর্ভুক্ত অনধিক ২ লাখ টাকা পর্যন্ত কোনো আয়, যদি ওই ব্যক্তি—(ক) পেশায় একজন কৃষক হন;(খ) এর সংশ্লিষ্ট আয়বর্ষে নিম্ন বর্ণিত আয় ব্যতীত কোনো আয় না থাকে, যথা—(অ) জমি চাষাবাদ থেকে উদ্ভূত আয়;(আ) সুদ বা মুনাফা বাবদ অনধিক ২০ হাজার টাকা আয়; (১৪) সফটওয়্যার তৈরিসহ তথ্যপ্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট কয়েকটি খাতের ব্যবসায় আয়। খাতগুলো হচ্ছে—(ক) সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, (খ) সফটওয়্যার বা অ্যাপ্লিকেশন কাস্টমাইজেশন, (গ) নেশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এটিটিএ), (ঘ) ডিজিটাল অ্যানিমেশন ডেভেলপমেন্ট, (ঙ) ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট, (চ) ওয়েবসাইট সার্ভিস, (ছ) ওয়েব লিস্টিং, (জ) আইটি প্রসেস আউটসোর্সিং; (ঝ) ওয়েবসাইট হোস্টিং, (ঞ) ডিজিটাল গ্রাফিকস ডিজাইন, (ট) ডিজিটাল ডেটা এন্ট্রি ও প্রসেসিং, (ঠ) ডিজিটাল ডেটা অ্যানালিটিকস, (ড) গ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিস (জিআইএস), (ঢ) আইটি সহায়তা ও সফটওয়্যার মেইনটেন্যান্স সার্ভিস, (ণ) সফটওয়্যার টেস্ট ল্যাব সার্ভিস, (ত) কল সেন্টার সার্ভিস, (থ) ওভারসিজ মেডিকেল ট্রান্সক্রিপশন, (দ) সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন সার্ভিস, (ধ) ডকুমেন্ট কনভারশন, ইমেজিং ও ডিজিটাল আর্কাইভিং, (ন) রোবোটিকস প্রসেস আউটসোর্সিং, (প) সাইবার সিকিউরিটি সার্ভিস, (ফ) ক্লাউড সার্ভিস, (ব) সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন, (ভ) ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম, (ম) ই-বুক পাবলিকেশন, (য) মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস ও (র) আইটি ফ্রিল্যান্সিং। (১৫) জুলাই ১, ২০২০ থেকে ৩০ জুন, ২০২৪ তারিখের মধ্যে হস্তশিল্প রপ্তানি থেকে উদ্ভূত কোনো আয়; (১৬) যেকোনো পণ্য উৎপাদনে জড়িত ক্ষুদ্র বা মাঝারি শিল্প থেকে উদ্ভূত আয়, যার—(ক) শিল্পটি নারীর মালিকানাধীন হলে বার্ষিক টার্নওভার অনধিক ৭০ লাখ টাকা;(খ) অন্যান্য ক্ষেত্রে বার্ষিক টার্নওভার অনধিক ৫০ লাখ টাকা; (১৭) নিম্নবর্ণিত শর্ত সাপেক্ষে ব্যাংক, বিমা বা কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যতীত ব্যক্তি কর্তৃক জিরো কুপন বন্ড থেকে উদ্ভূত কোনো আয়, যথা—(ক) বাংলাদেশ ব্যাংক বা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের পূর্বানুমোদন গ্রহণ করে কোনো ব্যাংক, বিমা বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উক্ত জিরো কুপন বন্ড ইস্যু করা হয়েছে;(খ) বাংলাদেশ ব্যাংক বা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের পূর্বানুমোদন গ্রহণ করে কোনো ব্যাংক, বিমা বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যতীত অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান কর্তৃক জিরো কুপন বন্ড ইস্যু করা হয়েছে; (১৮) ‘চাকরি হতে আয়’ হিসেবে পরিগণিত আয়ের ১/৩ বা ৪ দশমিক ৫ লাখ টাকা, যেটি কম; (১৯) কোনো ব্যক্তি কর্তৃক বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে গৃহীত সম্মানী বা ভাতা প্রকৃতির কোনো অর্থ বা সরকার থেকে গৃহীত কোনো কল্যাণ ভাতা; (২০) সরকারের কাছ থেকে গৃহীত কোনো পদক/পুরস্কার; এবং (২১) কোনো বৃদ্ধাশ্রম পরিচালনা থেকে উদ্ভূত কোনো আয়;(২২) ২০৩০ সালের ৩০ জুনের মধ্যে কোনো সমুদ্রগামী বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ কর্তৃক অর্জিত ব্যবসার আয় রেমিট্যান্স-সংক্রান্ত বিধান অনুসরণ করে বাংলাদেশে আনা হলে অনুরূপ আয়। করমুক্ত আয়সমূহ করদাতার মোট আয়ের অন্তর্ভুক্ত হবে না। এটি রিটার্নে করমুক্ত আয়ের কলামে প্রদর্শন করতে হবে।
লেখক: আয়কর আইজীবী