জাতীয়

প্রশ্নবিদ্ধ সিটি নির্বাচনের দায়ভার ইসির : টিআইবি

নিজস্ব প্রতিবেদক : ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) মতে, তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থীদের অনুমোদিত ব্যয় সীমার অতিরিক্ত খরচ,  নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষপাতিত্বের কারণে পুরো নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ। টিআইবি আরো বলেছে, এসব প্রতিরোধে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ব্যর্থ। তাই এই প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে নির্বাচন কমিশনের। সোমবার দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে মাইডাস সেন্টারে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ সংক্রান্ত এক গবেষণা প্রতিবেদনে টিআইবি এ তথ্য প্রকাশ করেছে।টিআইবি মনে করে, তিন সিটি নির্বাচনে অধিকাংশ প্রার্থী বিভিন্ন ভাবে আচরণবিধি লঙ্ঘন, প্রার্থীদের অনুমোদিত সীমার তিনগুণের বেশী ব্যয়, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষপাতিত্ব, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নির্বাচনে প্রতিযোগিতার মনোভাবের ঘাটতির কারণে গত ২৮ এপ্রিল সমাপ্ত তিনটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। স্বাধীনভাবে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে নির্বাচন কমিশন ব্যর্থ হয়েছে। তাই এর দায়ভার পুরোপুরি নির্বাচন কমিশনের।টিআইবি মনে করেন, নির্বাচনে সেনা মোতায়েনে দোদুল্যমানতা, প্রার্থীদের আচরণবিধি লঙ্ঘণে সমানভাবে পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতা, ভোট জালিয়াতি, কারচুপি এবং ভোট কেন্দ্র দখলে সহিংসতা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারায় ইসি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দায়ী।তিন সিটি নির্বাচনে অধিকাংশ প্রার্থী ব্যয়সীমা অতিক্রম করেছেন উল্লেখ করে টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা উত্তরের জন্য নির্ধারিত ৫০ লাখ টাকা সীমার বাইরে তিন মেয়র প্রার্থী ২০ লাখ থেকে ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছেন। ঢাকা দক্ষিণের তিন মেয়র প্রার্থী অনুমোদিত ৩০ লাখ টাকার সীমার বিপরীতে ১ কোটি ৪৬ লাখ থেকে ৩ কোটি ৫১ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেন। চট্টগ্রামের তিন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে সর্বোচ্চ ৬ কোটি ৪৭ লাখ থেকে ৩৭ লাখ টাকা ব্যয়ের চিত্র উদঘাটিত হয়েছে। যদিও এখানে অনুমোদিত ব্যয়ের সীমা ছিল ৩০ লাখ টাকা। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ঢাকা উত্তরের মেয়র প্রার্থীরা গড়ে ২ দশমিক ৭ কোটি টাকা, ঢাকা দক্ষিণের মেয়র প্রার্থীরা গড়ে ২ দশমিক ২ কোটি টাকা এবং চট্টগ্রামের মেয়র প্রার্থীরা গড়ে ২ দশমিক ৭ কোটি টাকা নির্বাচনে ব্যয় করেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত সাধারণ কাউন্সিলর প্রার্থীরা ঢাকায় গড়ে যথাক্রমে ১৫ দশমিক ৯৫ লাখ টাকা, ৮ দশমিক ২৬ লাখ টাকা এবং চট্টগ্রামে যথাক্রমে ১৬ দশমিক ৫৮ লাখ এবং ১১ দশমিক ৫২ লাখ টাকা ব্যয় করেন। দলীয় সমর্থন পেতে অনেক প্রার্থী ২০ লাখ থেকে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেন এমন তথ্য দিয়ে টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়, সিটি নির্বাচন দল নিরপেক্ষ নির্বাচন হলেও এই নির্বাচনে দলীয় সমর্থন পেতে মোটা অংকের অর্থ ব্যয় করেছে প্রার্থীরা। চট্টগ্রামে দলের সমর্থন, দলের প্রভাবশালী নেতাদের সমর্থন আদায় এবং প্রতিপক্ষের প্রভাবশালী নেতাদের রাজি করতে বিরাট অংকের অর্থের লেনদেন হয়েছে। সেখানে মেয়র পদে দলীয় সমর্থনে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত লেনদেনের প্রমাণ রয়েছে। আর কাউন্সিলর পদে ২ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে।ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে মেয়রদের বিরুদ্ধে দলীয় সমর্থনে টাকা লেনদেনের প্রমাণ না পেলেও সাধারণ কাউন্সিলররা দলীয় সমর্থন পেতে আট লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছেন। এই খাতে সংরক্ষিত পদে কাউন্সিলররা ব্যয় করেছেন ২ থেকে ৫ লাখ টাকা। আচারণবিধি লংঘনের ধরন ও হারের বিষয়ে টিআইবির পক্ষ থেকে বলা হয়, তিন সিটি নির্বাচনে ক্যাম্পে পানীয়, খাদ্য পরিবেশন, উপহার প্রদানের ক্ষেত্রে ৫৮ শতাংশ, নির্ধারিত সময়ে বাইরে মাইকিং করার ক্ষেত্রে ৪২ শতাংশ, ধর্মীয় উপসনালয়ে প্রচারণার ক্ষেত্রে ৪২ শতাংশ, একসঙ্গে একাধিক মাইক ব্যবহারের ক্ষেত্রে ৪১ শতাংশ, জনসভার ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ, মনোয়নপত্র দাখিলের সময় শো-ডাউনের ক্ষেত্রে ২৬ শতাংশ, যানবাহনসহ মিছিল ও শোডাউনের ক্ষেত্রে ২৩ শতাংশ, চাঁদার ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ, পোস্টার ছাপানোর ক্ষেত্রে ১৭ শতাংশ, ব্যক্তিগত আক্রমনের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ এবং প্রার্থীর ছবি, আলোকসজ্জা, প্রতীকসহ জ্যাকেট ইত্যাদির ক্ষেত্রে ২১ শতাংশ হারে আচারণবিধি লংঘিত হয়েছে।সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও প্রাক্তন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এ টি এম শামসুল হুদা বলেন, আইনে নির্দলীয় নির্বাচনের কথা বলা হলেও বাস্তবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়া হয়। এই দ্বৈততার কারণেই নির্বাচনে নানা অনিয়ম দেখা যায়। এক্ষেত্রে নির্বাচনী আইন পরিবর্তন করে দলীয় করা যেত পারে, যাতে দলীয় প্রার্থী ছাড়া অন্য কেউ মনোনয়ন না পায়। এতে আর্থিক অনাচার ও অনিয়মের সুযোগ কমে আসবে।টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়নি। কোন কোন ক্ষেত্রে অনুমোদিত নির্বাচনী ব্যয়ের তুলনায় সাত, এগারো বা একুশ গুণ বেশি অর্থ ব্যয়িত হয়েছে। নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘন করে ব্যাপক ভোট জালিয়াতি হয়েছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ ছিল।বিএনপি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিএনপি নির্বাচনের মাঝ পর্যায়ে নির্বাচন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে। এর মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার উদ্দেশ্য ছিল কিনা তাও বিতর্কিত বিষয়।    টিআইবির সুপারিশে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালীকরণ, খাত অনুযায়ী ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ, নির্বাচনী ব্যয় পরিবীক্ষণের বিধান, ব্যয় সংক্রান্ত দাখিলকৃত রির্টান যাচাই বাছাই এবং প্রার্থীর হলফনামায় প্রদত্ত তথ্যের সঠিকতা নিশ্চিতকল্পে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনী আইনের ব্যাপক সংস্কার ও তা হালনাগাদের ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়।প্রতিবেদনের সারাংশ উপস্থাপন করেন গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. রেজাউল করিম। তিন সিটি কর্পোরেশনের ১৩৪ ওয়ার্ডের মধ্যে ২৮টি ওয়ার্ডকে দ্বৈবচয়ন পদ্ধতিতে নমুনা এলাকা নির্ধারণ করে ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত নয়জন মেয়র এবং ১০১জন সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থীর ওপর গবেষণা পরিচালনা করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও প্রাক্তন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এ টি এম শামসুল হুদা, নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপ-নির্বাহী পরিচালক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং মোহাম্মদ রফিকুল হাসান, পরিচালক, রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ মে ২০১৫/এম এ রহমান/নওশের