জাতীয়

অ্যাকশন জেসমিন : নকল কাঠামোতেও দুর্দান্ত ববি

নাবীল অনুসূর্য : অ্যাকশন জেসমিন নির্মাতা ইফতেখার চৌধুরী-নায়িকা ইয়ামিন হক ববি জুটির চতুর্থ সিনেমা। প্রথমবারের মতো ববি কোনো সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন। অন্যদিকে ববি-সায়মন জুটির প্রথম সিনেমাও এটি। এ ছাড়া প্রথমবারের মতো কোনো সিনেমায় ববি দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করেছেন। নানা কারণেই অ্যাকশন জেসমিন সিনেমাটি নিয়ে আগ্রহী হওয়া যেতে পারে।

তবে সবচেয়ে আগ্রহোদ্দীপক বিষয়, অত্যন্ত ব্যবসাসফল বলিউডি সিনেমা রাউডি রাঠোর-এর কাহিনি নিয়ে সিনেমাটি তৈরি। এই রাউডি রাঠোর আবার তেলেগু ভিক্রমারকুদু (বিক্রম সিংহ) সিনেমার রিমেক। তবে অ্যাকশন জেসমিন-এ রাউডি রাঠোর-এর কাহিনির মূল কাঠামো অনুসরণ করেছে। পাশাপাশি অনেক ঘটনা ও দৃশ্য হুবুহু নেয়া হলেও কাহিনিতে বেশ কিছু পরিবর্তন-পরিমার্জন-সংযোজনও করা হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু তাৎপর্যপূর্ণ সংযোজনও আছে। যেমন, ইন্সপেক্টর জেসমিন ভাইজির ছোট ভাই মুন্না কাটারিকে মদের ভাঙা বোতল দিয়ে মারার পর, অধীনস্ত পুলিশদের হুকুম দেয় রিপোর্টে লিখতে যে, মুন্না মদ খেয়ে মাতাল হয়ে মদের ভাঙা বোতলের ওপর পরে মরে গেছে।

তবে কাহিনিতে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ যে পরিবর্তনটা করা হয়েছে, কেন্দ্রীয় চরিত্রে নায়কের জায়গায় নায়িকাকে স্থাপন। অর্থাৎ রাউডি রাঠোর-এর নায়ক-নির্ভর কাহিনিকে নায়িকা-নির্ভর কাহিনিতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। মোদ্দা কথা, নারীবিষয়ক প্রথাগত রক্ষণশীল ধারণার একটি কাহিনিকে উল্টে দিয়ে করা হয়েছে আধুনিক প্রগতিশীল নারীভাবনার কাহিনি। নারীকে মেয়েমানুষ হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবেই দেখানো হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশের সিনেমার সাধারণ প্রবণতা মেনে সিনেমার শেষে গিয়ে নায়িকা সেভাবে নায়কের কোলে আত্মসমর্পণও করেনি।

সিনেমাটির কাহিনিটি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম অংশ মেলোড্রামাটিক, দ্বিতীয় অংশ অ্যাকশন-ড্রামাভিত্তিক। মেলোড্রামার অংশটি ভয়ংকর রকমের মন্থরগতির, একই সঙ্গে স্থূল রসিকতাপূর্ণ। দ্বিতীয় অংশটির শুরুতেই ইন্সপেক্টর জেসমিনের আবির্ভাবে কাহিনি জট পাঁকাতে শুরু করলে সিনেমার আখ্যানের গতি বৃদ্ধি পায়, ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে উপভোগ্যও হয়ে ওঠে। তবে পরে অবশ্য মেলোড্রামাটিক অংশটির প্রতিটি ঘটনাই অ্যাকশন-ড্রামাটিক অংশের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়া হয়েছে। কাহিনিতে বেশ ভালো কিছু টুইস্টও আছে। বিশেষ করে সদৃশ-চরিত্র জেসমিন ও দিপা বিষয়ক টুইস্টটি, যদিও এ টুইস্টের উৎস রাউডি রাঠোর।

সিনেমাটি যে অ্যাকশন-ভিত্তিক, তার প্রমাণ তো নামেই। এই অ্যাকশন-ভিত্তিক সিনেমাটির অ্যাকশন স্ট্যান্টগুলো কিছু জায়গায় বেশ ভালো হয়েছে। কিছু জায়গায় আবার বেশ দুর্বল। অনেক জায়গাতেই রাউডি রাঠোর থেকে প্রায় হুবুহু নেয়া হয়েছে। এমনকি রাউডি রাঠোর থেকে চাকতি সদৃশ অস্ত্রটিও নেয়া হয়েছে। আর সেই চাকতিওয়ালা মারামারির শেষে যখন ইন্সপেক্টর জেসমিনের পিঠে তলোয়ার ঢুকিয়ে দেয়া হয়, তখন তলোয়ারের যতখানি অংশ রক্তে লাল হয়, ততখানি পিঠ দিয়ে ঢোকালে জেসমিন চরিত্রে অভিনয় করা ববির শরীরের আনুপাতিক হিসাবে তা পেট বা বুক ফেঁড়ে বেরিয়ে আসার কথা। তবে মারামারির দৃশ্যগুলোতে রক্ত ছিটকে বের হয়ে আসার ইফেক্টগুলোর ব্যবহার বেশ ভালোই হয়েছে। তাছাড়া ববির গাড়ি থেকে গাড়িতে লাফিয়ে পড়ার দৃশ্যটা হাস্যকর তো হয়ইনি, খানিকটা বিশ্বাসযোগ্যও হয়েছে।

তবে সিনেমাটির গানগুলো বেশ ভালো, কানে লেগে থাকার মতো। আর গানগুলোর কোরিওগ্রাফিও বেশ দৃষ্টিসুখকর। সিনেমাটিতে নায়িকা ববি দুইটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন। সম্ভবত সে কারণেই আইটেম সং-সদৃশ গান দুটি— নটি গার্ল এবং পান-জর্দ্দা-চমন। দুটিতেই আছেন ববি। প্রথমটিতে দিপা চরিত্রে, দ্বিতীয়টিতে ইন্সপেক্টর জেসমিন চরিত্রে। দুটি গানের কোরিওগ্রাফিই যথেষ্ট দৃষ্টিসুখকর। তবে স্টেজ-ব্যাকগ্রাউন্ড ইত্যাদি মিলিয়ে দ্বিতীয় গানটির কোরিওগ্রাফিকেই বেশি নম্বর দিতে হয়। আবার ছেলে পাপ্পুকে নিয়ে গাওয়া দিপার গানটিও দুর্দান্ত। বিশেষ করে সিনেমাতে গানটির ব্যবহার (এই ব্যবহারও উৎস সিনেমা হতে গৃহীত)। আর সিনেমাতে নায়ক-নায়িকার জানে খোদা জানে গানটিও বেশ। অন্যটিও মন্দ নয়।

অবশ্য সিনেমাটির সাউন্ড ডিজাইনিং তেমন আহামরি কিছু হয়নি। প্রায়শই তাতে গলদ থেকেছে। তবে নায়িকার অ্যাকশন-অ্যাপিয়ারেন্সের ব্যাকগ্রাউন্ডে সাহস অনেক বেশি/ আমি যে বাংলাদেশি টুকরো গানটির ব্যবহার ভালো হয়েছে। এটি হয়তো আরেকটু বেশি ব্যবহার করলেও একঘেয়েমি আসত না।

তুলনামূলকভাবে সিনেমাটোগ্রাফি ভালোই হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় কালার কারেকশনও দুর্দান্ত হয়েছে। কিন্তু পুরো সিনেমায় সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখা যায়নি। লোকেশন নির্বাচন ভালোই হয়েছে।

তবে সিনেমার শুরুতে স্পষ্ট ইঙ্গিতে বর্তমান বাংলা সিনেমার একাধারে একজন নায়ক-পরিচালক-প্রযোজককে রীতিমতো ব্যঙ্গ করা হয়েছে, যেটা সম্ভবত জরুরি ছিল না। তার সাজপোশাক তো বটেই, এমনকি তার নামও উল্লেখ করা হয়েছে জ্বলন্ত হিসেবে। এবং নায়িকা চরিত্রের মুখ দিয়ে এমনও বলানো হয়েছে যে, সে নায়ক একজন ফালতু, যে নায়ক নিজেই প্রযোজক তার সঙ্গে কাজ করা উচিত না ইত্যাদি।

সব মিলিয়ে অ্যাকশন জেসমিন সিনেমাটি পাশ নম্বর পায়। আর অন্তত তিনটি কারণে সিনেমাটি প্রশংসাও পায়— পুরো সিনেমাজুড়ে ববির প্রাণবন্ত উপস্থিতি, একাধারে শ্রুতিমধুর ও দৃষ্টিসুখকর গানগুলো (অন্তত আইটেম সং দুটো) এবং কাহিনিতে আধুনিক প্রগতিশীল নারীভাবনার প্রতিফলন।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ মে ২০১৫/নাবীল/রাশেদ শাওন/ফিরোজ