জাতীয়

‘জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় বৈশ্বিক অংশিদারিত্বের বিকল্প নেই’

‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় আমাদের বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দরকার নেই, আমাদের প্রযুক্তিগত সহায়তা দরকার, উত্তম ব্যবস্থাপনা দরকার। এটি মোকাবেলায় উন্নত দেশগুলোকে যেমন আর্থিক সহায়তা দিতে হবে, তেমনি প্রাপ্ত অর্থ সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশের মতো ভুক্তভোগী দেশগুলোর পরিকল্পিত নীতি প্রণয়ন জরুরি।’

বুধবার (২২ সেপ্টেম্বর) সেন্টার ফর গর্ভন্যান্স স্টাডিজ আয়োজিত ওয়েবিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।

'এড্রেসিং দ্যা গোলস অব কপ-২৬ ইন সাউথ এশিয়ান কনটেক্সটঃ পিটফল এন্ড এক্সপ্লিকেশন্স’ শীর্ষক এই ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটারসন ডিকসন।

ওয়েবিনারে আলোচক হিসেবে যুক্ত ছিলেন পরিবেশবিজ্ঞানী ও সেন্টার ফর এডভান্সড স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক ড. আতিক রহমান, বাংলাদেশ স্থপতি ইন্সটিটিউটের প্রেসিডেন্ট স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন, পরিবেশ আইনবিদ ও বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, আইইউসিএন বাংলাদেশ-এর সভাপতি অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)- এর সদস্য সচিব স্থপতি ইকবাল হাবিব এবং সিজিএস- এর চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী। ওয়েবিনাটি সঞ্চালনা করেন সিজিএস-এর নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটারসন ডিকসন জলবায়ু পরিবর্তনের হার কমানোতে তার সরকারের পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমাদের কাছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কতগুলো প্রমাণ রয়েছে, আমরা যদি বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে না রাখতে পারি তাহলে ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।’  তার দেশের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের উদ্ধৃতি দিয়ে ব্রিটিশ হাইকমিশনার বলেন, ‘আমরা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কয়লা, নগদ অর্থ, গাড়ি এবং গাছ এই চারটি জিনিসের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছি।’ 

তিনি বলেন, ‘সুন্দরবনকে রক্ষা করা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। কেননা এটি, যেকোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করে। জলবায়ু মোকাবেলায় বাংলাদেশের পদক্ষেপগুলো প্রশংসার দাবি রাখে।’       

পরিবেশ বিজ্ঞানী ও সেন্টার ফর এডভান্সড স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক ড. আতিক রহমান বলেন, করোনার কারণে পাঁচ থেকে বিশ শতাংশ দেশ আসন্ন কপ-২৬ সম্মেলনে উপস্থিত থাকতে পারবে না, সেখানে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্থ দেশ হিসেবে এতে অংশ নিচ্ছে এটা বড়কিছু। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশ তার বাৎসরিক বাজেটের ১০ থেকে ১৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করলেও পদ্মাসেতু নির্মাণে ক্ষেত্রে যন্ত্রপাতির পেট্রোল ডাম্পিং এর সমালোচনা করেন তিনি। 

ড. আতিক বলেন, বাংলাদেশ কয়লা বাদ দিয়ে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গিয়েছে, যা প্রশংসার দাবি রাখে। সৌরবিদ্যুতের ৫.৫৮ মিলিয়ন চুল্লীর মাধ্যমে ২০ মিলিয়নের বেশি মানুষ এদেশে সরাসরি উপকৃত হচ্ছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশের অগ্রগতি হয়েছে এবং কপ এর দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়নে গুরুত্বারোপ ও তা বাস্তবায়নের তাগিদ দেন তিনি। অনুষ্ঠানে ড. আতিক বাংলাদেশের প্রস্তাবিত ১০০ টি রপ্তানী প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলকে জলবায়ু সহিষ্ণু করার পরামর্শ দেন।         

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)- এর সদস্য সচিব স্থপতি ইকবাল হাবিব জলবায়ু মোকাবেলায় ২ ধরনের পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেন। অভিযোজন কর্মসূচীতে গুরুত্বারোপ করে সরকারের ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ প্রকল্পকে টেকসই করার তাগিদ দেন। তিনি বলেন, শহরে সুষ্ঠ আবাসন ব্যবস্থা নেই, এই খাতে প্রচুর বরাদ্দ থাকলেও তা ব্যবহারে দক্ষতা কম। জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবেলায় জ্ঞানভিত্তিক ও সৃজনশীল পদক্ষেপ দরকার। পয়নিষ্কাশন ও পানি ব্যবস্থাপনায় প্রকৃতি সহিষ্ণু প্রযুক্তি স্থাপন জরুরি। দক্ষ পরিকল্পনা ভিত্তিক অবকাঠামোগত উন্নয়নে সহজ শর্তে অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন। আমাদের প্রযুক্তিগত ও ব্যবস্থাপনাগত সাহায্য দরকার। আমরা যাতে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে পারি সেজন্য আমাদের জীবনধারায় কিছুটা পরিবর্তন আনতে হবে। মনে রাখতে হবে, অভিযোজন যুদ্ধ নয় অংশীদারিত্ব।     

আইইউসিএন বাংলাদেশ-এর সভাপতি অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, ‘বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল পর পর দুইটি ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়েছে। সিডর, আইলা, আম্পানে মানুষের ঘড়বাড়ি ডুবে গেছে, চাষের জমি নষ্ট হয়েছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে দাড়িয়েছে যে, আমাদের এখন আর জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার কথা বলার সময় নেই। জরুরি পদক্ষেপ দরকার।’ জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত নাজমা আক্তারের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘উপকূলের মানুষের সুপেয় পানি নেই, কয়েক মাইল দূরে গিয়ে পানি আনতে হয়। অনেকেই সরাসরি পুকুরের পানিও পান করে থাকেন।’ 

অধ্যাপক তিতুমীর আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের মত দেশগুলো সবচেয়ে বেশি কার্বণ নিঃসরণ করলেও এই দেশগুলোকে উল্লেখযোগ্য জরুরি কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখছি না। বাংলাদেশে মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা আসায় পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, বন কেটে তাদের আবাসনের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। এমন পরিস্থিতে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় বৈশ্বিক অংশীদারিত্বের বিকল্প নেই। এই যখন পরিস্থিতি তখন কি গ্লাসগোতে আসন্ন কপ-২৬ এর আয়োজকরা বাংলাদেশের গাবুরার মানুষের ভোগান্তি কথা শুনতে পাবে।’         

পরিবেশ আইনবিদ ও বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় জাস্টিস ও ইক্যুইটি ইস্যুকে প্রাধান্য দিয়ে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজনের চেয়ে প্রশমন কর্মসূচীতে গুরুত্বারোপ জরুরি। উন্নত দেশগুলো যে পরিবেশের বায়ুমণ্ডলের প্রতি অবিচার করছে তা প্রথমে স্বীকার করতে হবে। প্রথমসারির উন্নত দেশগুলোকে এটার প্রভাব মোকাবেলায় অর্থায়ন-এর ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশের মত ভুক্তভোগী দেশগুলোতে এই ফান্ডের টাকা কার পকেটে যায় তা আগে খুঁজে বের করতে হবে। প্রাপ্ত অর্থের সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্য সরকারকে স্বচ্ছ নীতি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে। বাংলাদেশ ও পুরো বিশ্বকে উন্নয়ন মডেল নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। তিনি অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার গ্রিন গ্রোথ মডেলের সমালোচনা করেন।

তিনি আরও বলেন, ‘উন্নত বিশ্বের টাকার জন্যে আমাদের অপেক্ষা করার আর সু্যোগ নেই। যেহেতু আমরাই প্রথমসারির ভুক্তভোগী তাই নিজস্ব অর্থায়নে হলেও এ ব্যাপারে আমাদের জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।’    

বাংলাদেশ স্থপতি ইন্সটিটিউট এর প্রেসিডেন্ট স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ঢাকাতে সবচেয়ে বেশি ইনহেলার বিক্রি হয়। গাছের পাতাগুলো ধুলোয় ভরে যায়। শীতকালে গাছের পাতাগুলো ধুয়ে দিতে পারলে মানুষ অন্তত স্বচ্ছ বাতাস পেত, অক্সিজেন পেত। ইনহেলারের ব্যবহার কমতো। দুইভাবে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলা করা যেতে পারে। প্রথমত সামগ্রিক বা গ্লোবাল কার্যক্রম দ্বারা একটা গ্লোবাল পার্টনারশিপের মাধ্যমে এক যোগে কাজ করা। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় ভাবে কাজ করা। তিনি পোড়া ইটের ব্যবহার বন্ধ ও কংক্রিটের ইটের ব্যবহারে সরকারের উদ্যোগের প্রশংসা করেন।

ওয়েবিনারের সমাপনী বক্তা হিসেবে সেন্টার ফর গর্ভন্যান্স স্টাডিজ- এর চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশ জলবায়ু ইস্যুতে ফ্রন্টলাইনার দেশ। এদেশে প্রতিবছর ১৫০ মিলিয়ন মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট দুর্যোগের শিকার। উচ্চ আয়ের দেশগুলোর অধিক পরিমানে শক্তি ভোগ নিম্ন আয়ের দেশ গুলোর জন্যে জলবায়ুর ভোগান্তির কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। জলবায়ু মোকাবেলায় আমরা কি করছি বা বিশ্ব কি করছে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল পশ্চিমা বিশ্ব তথা শক্তির অধিক ব্যবহারকারি দেশগুলো কি করছে তা।’