‘ছেলে-মেয়েকে ঠিকমত খেতে দিতে পারি না। কাপড়-চোপড়, পড়াশোনাও করাতে পারছি না। এ অবস্থায় একজন মায়ের কাছে ছেলে-মেয়ে থাকাটাই যেন অভিশাপ। ওরা না থাকলে বেঁচেই যেতাম। তাদের করুন চেহারা দেখতে হতো না।’
এভাবেই আপেক্ষ করে কথাগুলো বলছিলেন ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর তাজরীন গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডে আহত সুইং অপারেটর জরিনা বেগম।
উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর তাজরীন গার্মেন্টসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে ১১২ জন পোশাক শ্রমিক ও কর্মী নির্মমভাবে নিহত হন। আহত হন ১০৪ জন শ্রমিক। গার্মেন্টস কারখানায় এক হাজার ১৬৩ জন শ্রমিক কাজ করতেন। কিন্তু দুর্ঘটনার সময় ৯৮৪ জন শ্রমিক সেখানে কর্মরত ছিলেন।
জরিনা বেগম বলেন, ‘সেদিনের ঘটনা এখনো চোখে ভাসে। আগুন লাগার পর বাঁচতে তিন তলা থেকে লাফ দেই। পায়ের হাড় ভেঙে যায়। কোমরে, মাথায় আঘাত পাই। আর ৪/৫ মিনিট আটকে থাকলে মারা যেতাম। ১১দিন পর জ্ঞান ফেরে। গার্মেন্টস এর কথা শুনলে এখনো ভয় লাগে। গার্মেন্টস আর চাকরি করার ইচ্ছে নেই। আর ক্ষমতাও নেই। এখনো কোনো উঁচু বিল্ডিংয়ে উঠলেও ভয়ে থাকি।’
তিনি বলেন, ‘ভাত আর কাপড়ের জন্য ঢাকায় কাজ করতে এসেছিলাম। ভাবছিলাম নিজে কাজ করে মা, সন্তানদের নিয়ে একটু ভালো থাকবো। এখন তো মায়ের বোঝা হয়ে গেছি। বৃদ্ধ মা পরের বাসায় কষ্ট করে কাজ করে টাকা উপার্জন করে। আর তার সেই কষ্টের টাকা আমি বসে বসে খাই। সেদিন লাফ না দিয়ে আগুনে পুড়ে মরে গেলেই ভালো হত। মা যেন লাশটা পায় সেজন্যই লাফ দিয়েছিলাম। এভাবে বেঁচে না থেকে সেদিন মরে গেলেই ভালো হতো। দিন শেষে পাখিরও একটি বাসা থাকে। আমার তো তাও নেই। ভাই-বোনের চিকিৎসায় ভিটে বাড়ি বিক্রি করা লাগছে। টিকে থাকতে গার্মেন্টসে ঢুকছিলাম। এখন তো আমার কিছুই নাই। ছেলে-মেয়েকে একটু ভালো খাবার, কাপড় চোপড় দিতে পারি না। দেনাও হয়ে গেছি।’
জরিনা বেগম বলেন, ‘এতগুলো শ্রমিক মারা গেলো কিন্তু এর বিচার পেলাম না। আমরা যাবো কোথায়। কেউ তো আমাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে না। কেউ আমাদের কষ্ট বোঝে না।’
তিনি বলেন, ‘অভাবের কারণে ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন মনে হয় ছেলে-মেয়ে না থাকলেই ভালো হতো। ছেলে-মেয়ে থাকাটাই অভিশাপ হয়ে গেছে।’