# রাঘববোয়ালরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে # সেবাখাতে বেপরোয়া ঘুষ-দুর্নীতি # মানিলন্ডারিং আইনে সব ধরনের তদন্তভার পায়নি # জোরদার নেই ফাঁদ অভিযান # গণশুনানি ও প্রাতিষ্ঠানিক সুপারিশের ফলোআপ নেই # বেড়েছে অভিযোগ, কমেছে মামলা-চার্জশিট # ১১৬ ইসলামী বক্তার বিরুদ্ধে গণকমিশনের শ্বেতপত্র
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দেশে দুর্নীতি দমন, নিয়ন্ত্রণ ও দুর্নীতি প্রতিরোধে গঠিত সরকারের একটি স্বাধীন কমিশন। এটি ২০০৪ সালের ৯ মে দুর্নীতি দমন আইন অনুসারে গঠন করা হয়। দেশের দুর্নীতিমূলক কার্যক্রম প্রতিরোধ, দমন ও নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সমাজে সততা ও নিষ্ঠাবোধ সৃষ্টির লক্ষে উপযুক্ত কার্যক্রম পরিচালনার জন্যই গঠিত হয় এই কমিশন। দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগ গ্রহণ করে অনুসন্ধান ও তদন্ত শেষে অপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি এবং দুর্নীতিবাজদের শাস্তি নিশ্চিত করাই সংস্থাটির কাজ। একইসঙ্গে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহিতা, প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা; বিশেষ করে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলায় বড় ভূমিকা রাখে প্রতিষ্ঠানটি।
কিন্তু সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে গঠন করা হয়েছে, তা হাসিল করতে বার বার হোঁচট খাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে নানা মহলে। বরং দুর্নীতি দমন কমিশনকে ‘নখ ও দন্তহীন বাঘ’ বলেও আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
দেশে দুর্নীতি প্রতিরোধকল্পে কমিশনের ফাঁদ অভিযানসহ ধারাবাহিকভাবে নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করলেও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনও ঘুষ-দুর্নীতি কমেনি। বরং সরকারি সেবা খাতে সবচাইতে বেশি ঘুষ-দুর্নীতি হচ্ছে বলে অভিযোগ। টিআইবির প্রকাশিত এক প্রতিবেদনেও সেটি উঠে এসেছে।
দুর্নীতি বিরোধী কার্যক্রম, বিশেষ করে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান, বিচারের মুখোমুখি করা, ফাঁদ অভিযান, গণশুনানি, প্রাতিষ্ঠানিক সুপারিশ ও অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ গত একবছরের সার্বিক কর্মকাণ্ড নিয়ে কতটুকু সন্তুষ্ট জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ রাইজিংবিডিকে বলেন, সন্তুষ্ট হয়ে তো আর কাজের স্পৃহা থাকে না। কাজ করে যাচ্ছি। আগের থেকে আরও উন্নতি করার চেষ্টা করছি। আমাদের তথ্য-উপাত্ত বলেন, আগের চেয়ে কাজের গতি বেড়েছে। কিছু কাজ পেন্ডিং ছিল তা আমরা কমিয়ে এনেছি, বাকি কাজও দ্রুত করার চেষ্টা করছি। আমরা করে ফেলেছি বলবো না, কাজের দীর্ঘসূত্রিতা কমিয়ে আনার চেষ্টা করেছি।
আর্থিক-খাতের লুটেরা প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার ও তার সহযোগীদের ২০২২ সালের ১৫ মে ভারতে গ্রেপ্তারের পর তার বিরুদ্ধে নতুন মামলা দায়ের করে দুদক। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার তোড়জোড় হলেও, এখনও সেটা করা যায়নি। চাঁদপুরের ইউপি চেয়ারম্যান বালুখেকো সেলিম খান, ব্যাংকার, সরকারি কর্মচারীসহ বেশ কিছু দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান, মামলা ও চার্জশিট দিয়েছে দুদক। তাছাড়া মহিলা যুবলীগ সভাপতি ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) সাবেক কাউন্সিলর আলেয়া সারোয়ার ডেইজি এবং বিমান, ওয়াসাসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বড় কর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বছর পার করেছে সংস্থাটি। তার মধ্যে বাংলাদেশ বিমানের এমডিসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে শীর্ষ কর্তাদের তলব করা ছাড়া উল্লেখযোগ্য তেমন বড় কোনও সাফল্য নেই দুদকের। বছর শেষে (২৬ ডিসেম্বর) বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, তার স্ত্রীসহ পাঁচ জনের বিরুদ্ধে প্লট জালিয়াতির অভিযোগে মামলা দায়ের করেছে দুদক।
২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরে দুর্নীতি দমন কমিশন বড় ধরনের ঘুষখোর, অর্থ-পাচারকারী, দুর্নীতিবাজ কোনও রাঘববোয়াল ধরতে পারেনি। বিআরটিএ, ওয়াসা, তিতাস, রাজউক, সিটি করপোরেশন, গণপূর্ত, হাসপাতাল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ভূমি অফিস, রেজিস্ট্রি ও পাসপোর্ট অফিসসহ সেবাখাতে ঘুষ দুর্নীতি বাড়লেও বিমান অফিস, তিতাসসহ এক বছরে হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে হানা দেয় দুদক। এসব প্রতিষ্ঠানে সাড়াশি অভিযান ছিল না বললেই চলে। দুদকের ফাঁদ অভিযানও উল্লেখ করার মত নয়। হটলাইনের মাধ্যমে নামমাত্র কিছু অভিযান পরিচালিত হয়েছে। ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরে গণশুনানি কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক সুপারিশও তেমন নেই বললে চলে। প্রশ্ন উঠেছে, দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ করা সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ভূমিকা নিয়েও।
দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যেও ব্যাংক থেকে টাকা লোপাট হচ্ছে। টাকা পাচারের ঘটনা বেড়ে চলছে। অথচ অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দুদকের বড় প্রতিবন্ধকতা হলো, এ আইনের সব অপরাধের তদন্তভার না দেওয়া। মানিলন্ডারিং আইনের ২৭ অপরাধের মধ্যে মাত্র একটি অপরাধের অনুসন্ধান করতে পারে দুদক। আইন সংশোধন করে আরও ছয়টি অপরাধের তদন্তভার চাইলেও সেটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও আর্থিক বিভাগের মধ্যে চিঠি চালাচালিতে আটকে আছে।
২০২২ সাল, এই এক বছরে দুদকে অভিযোগ বাড়লেও অনুসন্ধান, তদন্ত, মামলা ও চার্জশিট কমেছে। বরং বিধিমালা ভঙ্গসহ একাধিক অভিযোগে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুতি, এ ঘটনার প্রতিবাদে দুদক কর্মকর্তা কর্মচারীদের মানববন্ধন, স্মারকলিপি পেশ, চাকরি ফিরে পেতে উচ্চ আদালতে মামলা, বিএনপিসহ রাজনৈতিক নেতাদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ, কমিশনের অনড় সিদ্ধান্ত সবকিছু মিলিয়ে বছরটি আলোচনার ঝড় তোলে। দুদকের শরীফকাণ্ডই ছিল ২০২২- এর সবচেয়ে আলোচিত বিষয়।
দেশের ১১৬ আলেম ও ইসলামি বক্তার দুর্নীতির তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নিতে গত ১১ মে দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি শ্বেতপত্র জমা দেয় গণকমিশন। গণকমিশনের এই তালিকা নিয়ে দেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলে। পরবর্তীতে ১১৬ আলেমের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করার সিদ্ধান্ত হলেও সেটির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই।
দুদকে করা আবেদন, মামলার অনুসন্ধান- তদন্ত কার্যক্রমের ধীরগতি নিয়েও অসন্তুষ্ট আদালত। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে এক ব্যক্তির করা আবেদন আমলে না নেওয়ায় আদালত দ্রুত তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেয়। অন্যথায় দুদকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলে আদালত। সেবাখাতে কমিশনের অভিযান ও গৃহীত পদক্ষেপও ঘুষ-দুর্নীতি কমানো যাচ্ছে না।
তবে দুদক স্বাধীনভাবেই কাজ করছে জানিয়ে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বলেন, স্বাধীন কমিশন হিসেবে দুদক স্বাধীনভাবেই কাজ করছে। কোনও ধরনের চাপ কিংবা সরকারি প্রভাব নেই। নেই কোনও প্রতিবন্ধকতাও। আমাদের কাজে কোনও ধরনের হস্তক্ষেপ নেই, এটাই হলো আমাদের একমাত্র সাফল্য। আমরা ভাল করি আর খারাপ করি আমরা আমাদের মতই করি, স্বাধীনভাবেই করতে পারি। কোনও হস্তক্ষেপ নেই।
ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদকের এক বছরের সার্বিক কর্মকাণ্ড নিয়ে জানতে চাইলে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মন্তব্য করতে রাজি হননি।
দেশে দুর্নীতি প্রতিরোধে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন কমিশন। তারা বিভিন্ন সময় সন্দেহভাজনদের সম্পদের হিসাব নেয়, জিজ্ঞাসাবাদ এবং মামলা দায়ের করে। যা ফলাও করে প্রচারও করা হয়। কিন্তু দুদকের মামলায় গত পাঁচ বছরে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের ৯৭ শতাংশের বেশি ছোট পদের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও জনপ্রতিনিধি। এ তালিকায় হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া উচ্চ পর্যায়ের সরকারি আমলা, মন্ত্রী, এমপি ও প্রভাবশালী কেউ নেই বললে চলে।
দুদককে একটি কার্যকর এবং দুর্নীতিবাজদের জন্য ভীতিকর প্রতিষ্ঠান দাবি করে প্রতিষ্ঠানটির কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান বলেন, ‘দুদক নখ-দন্তহীন বাঘ; এ প্রতিষ্ঠান নিয়ে তেমন কিছু আশা করা যায় না— এমন নেতিবাচক মন্তব্য শোনা গেলেও এখন সেই অবস্থানের উন্নতি হয়েছে। এখন দুদক একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠান। দুর্নীতিবাজদের জন্য একটি ভীতিকর প্রতিষ্ঠানও বটে।
তিনি বলেন, যারা দুর্নীতি করে, সহায়তা করে— দুদকের নজরদারিতে তারা রয়েছেন। যারা অনুসন্ধান ও তদন্তের মধ্যে আছেন, তারা জানেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থানের ক্ষেত্রে দুদক কতটা হিংস্র। কাজেই দুদককে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। দুদক একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে।
দুদক কর্মকর্তা শরীফকে অপসারণ বিধিমালা ভঙ্গসহ একাধিক অভিযোগে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। পরদিন ১৭ ফেব্রুয়ারি এ ঘটনার প্রতিবাদে প্রথমবারের মতো মানববন্ধন করেন ঢাকাসহ ২১ জেলার দুদক কর্মকর্তারা।
ওইদিন জরুরি সংবাদ সম্মেলনে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন দাবি করেন, দুদকের বিধিমালা ভঙ্গ করায় শরীফের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আরও ৭-১০টি অভিযোগ থাকলেও তা জনসম্মুখে বলা সম্ভব নয়।
এ ঘটনা গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে অভিযান ও অনুসন্ধান পরিচালনা করায় শরীফ উদ্দিনকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠে। এতে সমালোচনার মুখে পড়ে দুদক। শুধু তাই নয়, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল আলমগীরসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা এবং বিভিন্ন মহল শরীফের চাকরিচ্যুতির ঘটনা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
শরীফ তার মেয়াদকালে বিভিন্ন খাতে অনিয়ম অনুসন্ধান ও খবর প্রকাশের জন্য আলোচিত হন। সে সময় তিনি নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তা, কর্মচারী, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (সিসিসি) ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ইয়াবা চোরাকারবারি, রোহিঙ্গা, কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেডের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এক ডজনেরও বেশি মামলা করেন।
শরীফকে চাকরিচ্যুত করার চার দিন পর গত ২০ ফেব্রুয়ারি রীতিমতো সংবাদ সম্মেলন করে তার বিরুদ্ধে ১৩টি অভিযোগ জানান দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন। এসব অভিযোগের মধ্যে রয়েছে অনুসন্ধান ও তদন্তের নির্দেশিকা অনুসরণ না করে নিজের খেয়ালখুশি মতো কাজ করা, অনেক ব্যক্তিকে হয়রানি, মামলার ভুক্তভোগীদের প্রহার ইত্যাদি। তবে সেসব অভিযোগের জবাব দিয়েছেন শরীফ উদ্দিন। নিজেকে নির্দোষ দাবি করে প্রধানমন্ত্রীকে ‘মা’ আখ্যায়িত করে চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার আকুতি করেন। চাকরি ফিরে পেতে দুদকেও আবেদন করেন তিনি কিন্তু তাতে কোনও কাজ হয়নি। সর্বশেষ চাকরি ফিরে পাওয়াসহ ন্যায় বিচারের জন্য উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হন তিনি। মামলাটি এখন শুনানি পর্যায়ে রয়েছে। শরীফ চাকরি হারিয়ে তার নিকটাত্মীয়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বসেন। এখন তিনি একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করছেন।
বিএনপি নেতা আমির খসরুর বিরুদ্ধে মামলা তথ্য গোপন, প্রতারণা ও প্লট জালিয়াতির অভিযোগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, স্ত্রীসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২৬ ডিসেম্বর দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ সংস্থাটির উপ পরিচালক সেলিনা আখতার বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন।
মামলার অপর আসামিরা হলেন- আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর স্ত্রী তাহেরা খসরু আলম, তার ভায়রা গোলাম সরোয়ার, শ্যালিকা সাবেরা সরোয়ার (নীনা) ও রাজউকের নকশা অনুমোদন শাখার ইন্সপেক্টর আওরঙ্গজেব নানু।
বছরের শেষ সময়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও তার স্ত্রীসহ পাঁচ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে কিছুটা আলোচনায় আসে দুর্নীতি দমন কমিশন। একই সঙ্গে ২১ বছর পর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি নেতারা।
ঘটনার ২১ বছর পর দুদকের এই মামলা রাজনৈতিক চাপ কিংবা উদ্দেশ্য প্রণোদিত কিনা- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন জানান, ঘটনা পুরনো হলে কী হবে, দুদকে যদি অভিযোগ না আসে! দুদকে অভিযোগ আসার পর দুদক প্রাথমিক অনুসন্ধানে সত্যতা পাওয়ার পরই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর সঙ্গে কোনও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই।
গণকমিশনের ১১৬ ইসলামী বক্তার তালিকা একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিদের উদ্যোগে ‘মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস তদন্তে গঠিত গণকমিশন’ ১১৬ আলেম ও ইসলামি বক্তার দুর্নীতি তদন্তে গত ১১ মে দুর্নীতি দমন কমিশনে শ্বেতপত্র ও একটি তালিকা জমা দেয়। গত ১১ মে দুপুর ১২টায় দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লার হাতে এই শ্বেতপত্র ও ১০০ সন্দেহভাজন ব্যক্তির তালিকা তুলে দেন গণকমিশনের চেয়ারম্যান সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও সদস্য সচিব ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজসহ পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল।
শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক এসময় সাংবাদিকদের জানান, তারা ৯ মাস তদন্ত করে ২ হাজার ২০০ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্র তৈরি করেছেন। তাতে বহু ভুক্তভোগীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। তদন্তে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর দুর্নীতি ও মানি লন্ডারিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে। জঙ্গিবাদ ছড়াতে জামায়াতে ইসলামী ও ধর্ম ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে অর্থায়ন করার তথ্যও মিলেছে। তাদের সন্ত্রাসী তৎপরতা ও দুর্নীতির তথ্য দুদকে জমা দেওয়া হয়েছে। তাদের আর বাড়তে দেওয়া যায় না। দেশের বিভিন্ন স্থানের ডিসি, এসপি, ইউএনও-সহ বেশ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে এ শ্বেতপত্রে জানানো হয়েছে, তারা মৌলবাদী ধর্ম ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে উসকানি দিচ্ছেন।
১১৬ আলেমের বিরুদ্ধে জমা দেওয়া গণকমিশনের অভিযোগ আমলে নেয় কমিশন। দুদকের দাপ্তরিক চিঠিতে দেখা যায়, ১২ মে দুদকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ অভিযোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা-পূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মহাপরিচালক (দৈনিক ও সাম্প্রতিক অভিযোগ সেলে) পাঠান। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের অনুসন্ধানকারী দল গঠন করা হয়। এ–সংক্রান্ত একটি দাপ্তরিক চিঠি তিন কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়।
দুদকের কাছে গণকমিশনের এ ঘটনায় ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। আলোচনা সমালোচনার ঝড় ওঠে। এর বিপক্ষে গণকমিশনের নেতাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ঝাড়েন ইসলামী দলসমূহ ও এসব ইসলামী বক্তা। গণকমিশনের অভিযোগ আমলে নিয়ে ১১৬ ইসলামী বক্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও এই বছর সেটির আর তেমন অগ্রগতি নেই।
আদালতে প্রশ্নের মুখে দুদক বছরের পর বছর মামলা ঝুলে থাকা, চুনোপুঁটি আসামিদের পেছনে বেশি সময় ব্যয়- এমন কর্মকাণ্ডে দুদকের কর্মকাণ্ড নিয়ে একাধিকবার প্রশ্ন তুলেছেন আদালত। চলতি বছরের ২৯ নভেম্বর বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারি ও অর্থ আত্মসাতের তিন মামলায় এক আসামির জামিন শুনানিতে দুদক কেন নীরব, তা জানতে চান হাইকোর্ট। বেসরকারি ব্যাংকটির শান্তিনগর শাখার সাবেক ম্যানেজার মোহাম্মদ আলীর জামিনের ওপর শুনানিতে এ প্রশ্ন করেন হাইকোর্ট।
শুনানির এক পর্যায়ে আদালত প্রশ্ন করেন, সাত বছরেও তদন্ত কেন শেষ হলো না? বলা হচ্ছে, প্রকৃত আসামিদের শনাক্ত করার প্রক্রিয়া বেশ জটিল। সব আলামত শনাক্ত করা সময়সাধ্য ও সাক্ষীদের আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। কথাগুলো আপত্তিকর। দুদক যদি এসব কথা বলে, তাহলে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়? ড্রামা দেখার মতো। আমরা সবাই দেখছি ড্রামা হয়ে যাচ্ছে। কোটি কোটি টাকা নিয়ে যাবে, দুদক চেয়ে চেয়ে দেখবে?
গত ২৭ নভেম্বর অর্থশালীরা পাওয়ারফুল (শক্তিশালী), তারা বিচারের ঊর্ধ্বে কিংবা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকবে কিনা- দুদকের প্রতি এমন প্রশ্ন রাখেন উচ্চ আদালত। দুদকের আইনজীবীর উদ্দেশে আদালত বলেন, আপনারা ধরছেন চুনোপুঁটি। তাহলে রাঘববোয়ালদের ধরবে কে? গত ১৭ ডিসেম্বর রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সর’ ১ থেকে ২৫ নম্বরে থাকা ব্যক্তি ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যেকোনও অভিযোগ আগে অনুসন্ধান ও তদন্ত করতে দুদককে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
একইভাবে চলতি বছর জাতীয় পার্টির নারী এমপিদের কাছ থেকে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ এনে দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ দেওয়া হলে কমিশন সেটি আমলে না নিয়ে ফেলে রাখে। বিষয়টি আদালতে পর্যন্ত গড়ালে জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নিতে আদেশ দেয় আদালত। অন্যথায় দুদকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানানো হয়।
অভিযোগ বাড়লেও কমেছে অনুসন্ধান-মামলা চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে দুদকে ১৮ হাজার ১৯টি অভিযোগ জমা পড়েছে। ডিসেম্বর মাসে অভিযোগের সংখ্যা আরও বাড়বে। এসব অভিযোগ যাচাই-বাছাই করে ৮৪০টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করেছে কমিশন, যা মোট জমা হওয়া অভিযোগের ৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এসব অভিযোগের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নিতে ৩ হাজার ৬০টি অভিযোগ বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। ১৪ হাজার ১১৯টি অভিযোগ কোনও কার্যক্রমের জন্য সুপারিশ করা হয়নি। দুদক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
চলতি বছর দুদকে আসা মোট অভিযোগ থেকে মাত্র সাড়ে চার শতাংশ অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গৃহীত হয়েছে। দুদকের এখতিয়ার বহির্ভূত মর্মে মোট অভিযোগের ৭৮ শতাংশই ছেঁটে ফেলা হয়েছে। ২০২১ সালের দুদকে মোট ১৪ হাজার ৭৮৯টি অভিযোগ জমা পড়ে। অনুসন্ধানের জন্য গৃহীত হয় ৫৩৩টি।
জানা গেছে, চলতি বছরের ১১ মাসে দুদক ৩৫৪টি অভিযোগ অনুসন্ধান করেছে। একই সময়ে নিষ্পত্তি হয়েছে ৩১২টি অভিযোগ। সম্পদ বিবরণীর নোটিশ জারি ৮৯টির, এফআইআর ২৭৬টি, চার্জশিট ১৬২টি আর চূড়ান্ত প্রতিবেদন হয়েছে ৭৮টি অভিযোগের।
দুদকে বর্তমানে অনুসন্ধান পর্যায়ে রয়েছে ৩ হাজার ৫৭৮টি অভিযোগ। চলমান মামলা আছে ১ হাজার ৬৯৯টি। মেয়াদোত্তীর্ণ অনুসন্ধান ও মামলা আছে যথাক্রমে ৭২৪ ও ১৫৭টি। মেয়াদোত্তীর্ণ অনুসন্ধান ও মামলার শতকরা হার ১৬ দশমিক ৭০ শতাংশ। অর্থ-পাচার, ব্যাংক-বিমা সংক্রান্ত অনিয়মসহ বিভিন্ন অভিযোগে এসব অনুসন্ধান ও মামলা চলছে।
অভিযোগের তুলনায় অনুসন্ধান কম হওয়ার কারণ জানিয়ে দুদক কমিশনার মো. জহুরুল হক জানান, সব অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য নিতে পারি না। কারণ, যেসব অভিযোগ আসে তার বড় অংশই দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধ নয়। দুদকের সেসব অভিযোগ গ্রহণের এখতিয়ার নেই।
তিনি বলেন, দুদক বিভিন্ন মাধ্যম থেকে যেসব অভিযোগ গ্রহণ করে তা অনেক সময় অসম্পূর্ণ থাকে। কমিশনে যে কয়টি সোর্সের মাধ্যমে অভিযোগ গ্রহণ করা হয়; তার একটি সরাসরি বা ডাকযোগে আসা অভিযোগ। এ ছাড়া বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসা সংবাদ অভিযোগ হিসেবে নেওয়া হয়। কমিশন অভিযোগগুলোর প্রাথমিক সত্যতা পেলে তা অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করে।
ফিরিয়ে আনা যায়নি পিকে হালদারকে ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদার ও তার সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করেছে দুদক। চলতি বছরের ১৪ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ভারতের অর্থসংক্রান্ত গোয়েন্দা সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) হাতে গ্রেপ্তার হন পিকে হালদার। অর্থ-পাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগে কলকাতায় তার বিচার চলমান। একইমাসে পিকে হালদার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে নতুন একটি মামলা দায়ের করে কমিশন।
ওই সময় দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ জানান, পিকে হালদারকে আইনের মুখোমুখি করতে যত দ্রুত সম্ভব দেশে ফেরত আনার চেষ্টা করা হবে। এক্ষেত্রে চেষ্টার কোনও ত্রুটি করা হবে না। অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে দুদেশের বহিঃসমর্পণ চুক্তির আওতায় ফেরত আনার পদক্ষেপ নেওয়া হবে।