প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর দ্বিতীয় বিয়ে করেন মোহাম্মদ আলী। প্রথম সংসারে মোহাম্মদ আলীর তিন মেয়ে ও এক ছেলে। দ্বিতীয় সংসারে মেয়ের বয়স ১১ বছর এবং ছেলের ৫ বছর। প্রথম সংসারের ছেলে-মেয়েরা খোঁজখবর রাখেন না বলে জানিয়েছেন মোহাম্মদ আলীর দ্বিতীয় স্ত্রী।
শেষ বয়সে ঋণ করেছিলেন মোহাম্মদ আলী। অভাব-অনটনের সংসার রেখেই পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে। এখন ছোট্ট দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত মোহাম্মদ আলীর দ্বিতীয় স্ত্রী শাহনাজ বেগম।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। একইদিন খুনিদের ছোঁড়া কামানের গোলায় মোহাম্মাদপুরে শেরশাহ সুরী রোডে ১৩ জন নিহত হন। ধ্বংস হয় বসতঘর। ১৫ আগস্ট সংশ্লিষ্ট তখন কোনো মামলা নেয়নি পুলিশ। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর কামানের গোলায় ১৩ জন নিহতের ঘটনায় মামলা করেন মোহাম্মদ আলী।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলার বিচার শেষ হলেও একইদিন খুনিদের ছোঁড়া কামানের গোলায় মোহাম্মাদপুরে শেরশাহ সুরী রোডে ১৩ জন নিহতের মামলার বিচার এখনো শেষ হয়নি। সাক্ষী না আসায় থমকে আছে বিচার। কবে নাগাদ বিচার শেষ হবে বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। তবে সাক্ষী হাজির করে মামলার বিচার দ্রুত শেষ করার কথা জানিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ।
ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে প্রায় ১৭ বছর আগে চার্জগঠন করে বিচার শুরু করেন আদালত। তবে এতদিনেও মামলার বিচার শেষ হয়নি। ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলাটি বিচারাধীন ছিল। তবে কয়েক মাস মামলাটি ঢাকার ১৩তম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ কুদরত-এ-ইলাহির আদালতে বিচারের জন্য বদলির আদেশ হয়েছে। গত ২১ জুন মামলার তারিখ ধার্য ছিল। কিন্তু ওইদিন কোনো শুনানি হয়নি। আগামী ১ অক্টোবর মামলার পরবর্তী তারিখ ধার্য রয়েছে।
মামলাটিতে সর্বশেষ ২০১৯ সালে সিআইডির তৎকালীন এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান ১৮ তম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন। এরপর আর কোনো সাক্ষী আদালতে হাজির হননি। এরই মাঝে ২০২১ সালে ২ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ থেকে একটি আবেদন করা হয়। এ মামলার পলাতক আসামিদের মধ্য থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কোন কোন আসামির দণ্ড কার্যকর হয়েছে সেই বিষয়ে একটি প্রতিবেদন করার প্রার্থনা করে রাষ্ট্রপক্ষ। আদালত সেই আবেদন মঞ্জুর করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার এবং মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। পরে এক আসামির বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ। কিন্তু তথ্যবিভ্রাট থাকায় পুনরায় প্রতিবেদন দাখিলের আদেশ দেন আদালত।
মামলা সম্পর্কে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু বলেন, মামলাটিতে ১৮ জনের সাক্ষ্য শেষ হয়েছে। মামলাটি প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে। কয়েকজন সাক্ষীকে আদালতে হাজির করে সাক্ষ্য গ্রহণের কাজ সমাপ্ত করবো। সাক্ষী হাজির করতে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।
এদিকে, মামলার বাদী মোহাম্মদপুর থানাধীন ৩২/৫ শেরশাহ সূরি রোডের বাসিন্দা সে দিনের ঘটনায় আহত মোহাম্মাদ আলী ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট মারা যান। শাহনাজ আক্তার বলেন, স্বামীর ইচ্ছা ছিল বিচার দেখে যাবেন। কিন্তু বিচার শেষ হওয়ার আগেই তিনি মারা যান। মামলার বিচারটা শেষ হলে স্বামীর আত্মা শান্তি পেতো।
স্বামী মারা যাওয়ার পর সন্তানদের নিয়ে কষ্টে দিনযাপন করছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দ্রুত মামলার বিচার শেষ করার দাবি করেন তিনি।
শাহনাজ আক্তার বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর বাপের বাড়ি ভোলার বোরহান নগর এসে থাকতেছি। বাবা গরীব। আয় তেমন নাই। মেয়েটা ৫ম শ্রেণিতে পড়ে। ছেলেটার বয়স ৫ বছর। দুই সন্তানকে নিয়ে আমি এখন কি করবো বুঝতে পারছি না।
প্রসঙ্গত, ৪৩ বছর আগের ওই হত্যার ঘটনায় মামলা হয় ১৯৯৬ সালে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণের সময় সেনা সদস্যরা কামানের গোলা ছুঁড়লে তা গিয়ে মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরী রোডর ৮ ও ৯ এবং ১৯৬ ও ১৯৭ নম্বর বাড়ির (টিনশেড বস্তি) ওপর পড়ে। লে. কর্নেল মুহিউদ্দিন আহমেদের (আর্টিলারি) ছোড়া কামানের গোলার বিকট শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। মুহূর্তে ধুলায় মিশে যায় ওই বস্তি। ওই ঘটনায় নারী ও শিশুসহ ১৩ জন মারা যায়। প্রায় ৪০ জন আহতের মধ্যে কয়েকজন পুরুষ সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যায়।
নিহতরা হলেন-রিজিয়া বেগম ও তার ছয় মাসের মেয়ে নাসিমা, কাশেদা বেগম, ছাবেরা বেগম, সাফিয়া খাতুন, আনোয়ারা বেগম (প্রথম), ময়ফুল বিবি, আনোয়ারা বেগম (দ্বিতীয়), হাবিবুর রহমান, আবদুল্লাহ, রফিজল, সাহাব উদ্দিন আহম্মেদ ও আমিন উদ্দিন আহম্মেদ।
ওই ঘটনায় ৮ নম্বর বাড়ির মালিক মোহাম্মদ আলী বাদী হয়ে ১৯৯৬ সালের ২৯ নভেম্বর মোহাম্মদপুর থানায় মামলা দায়ের করেন। ২০০১ সালের এপ্রিলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। এরপর ২০০৬ সালের ১ নভেম্বর এ মামলায় ১৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত।
১৭ আসামির মধ্যে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এরা হলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মুহিউদ্দিন আহমেদ, মেজর (অব.) বজলুল হুদা ও মেজর (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ। ওই পাঁচজন ছাড়া এ মামলায় প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে (প্রয়াত) গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছিল। ২০২১ সালের ১২ এপ্রিল ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদেরও ফাঁসি কার্যকর হয়।
পলাতকরা হলেন-লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) শরিফুল হক ডালিম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (বরখাস্ত) খন্দকার আবদুর রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) এসএইচএমবি নূর চৌধুরী ইবি, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এএম রাশেদ চৌধুরী, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) আহমদ শরিফুল হোসেন ওরফে শরিফুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) মো. কিসমত হাসেম, ক্যাপ্টেন (অব.) নাজমুল হোসেন আনসার, রিসালদার (অবসরপ্রাপ্ত) মোসলেম উদ্দিন ওরফে মোসলেহ উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী ও এলভি মো. আলী হোসেন মৃধা।