জাতীয়

মায়ের দাবি, অপসাংবাদিকতার শিকার ভাইরাল সেই ঢাবি শিক্ষার্থী

ফেসবুকে সুইসাইড নোট লিখে রীতিমত ভাইরাল হয়ে গেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের এক শিক্ষার্থী। তবে সুইসাইড নোটটি ঐ শিক্ষার্থী নিজের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে সরিয়ে ফেললেও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের কারণে তা ভাইরাল হয়ে পড়ে।

৫ সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার) রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢাবি শিক্ষার্থী ফেরদৌস নাঈম তার নিজ প্রোফাইলে একটি সুইসাইড নোট প্রকাশ করেন। বিষয়টি নজরে এলে তার বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিত মহলে উৎকণ্ঠা তৈরি হয়। বারবার চেষ্টা করেও ফোনে না পেয়ে অনেকেই তার নিজ জেলা রাজবাড়ী জেলা পুলিশ ও জাতীয় জরুরি পরিসেবা নাম্বারে যোগাযোগ করে। 

রাত ১২টার কিছুসময় পরে জেলা পুলিশের বরাতে জানা যায়, সুস্থ আছেন তিনি। পরিবারের সাথে আছেন। তার পরপরই ফেসবুক থেকে সুইসাইড নোট সরিয়ে নেন নাঈম। পরেরদিন বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয় সংবাদটি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘটনাটি ভাইরাল হয়ে যায়।

প্রকাশিত সকল সংবাদের মূল বিষয় বস্তু এবং ফেসবুকে দেওয়া সুইসাইড নোট নিয়ে জানতে ফেরদৌস নাঈম এবং তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে রাইজিংবিডি। ঘটনার দুই দিনপর ফেরদৌস নাঈম এবং তার মা হুসনে নাহিদার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়। 

সেদিনের ঘটনার বর্ণনায় ফেরদৌস নাইম রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমি বিগত কয়েকদিন ধরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। ঠিকমতো খেতে কিংবা ঘুমাতে পারি না। এই সময়ে আমি পরিচিত কারোর সাথে যোগাযোগও করিনি। নিজেকে সবার থেকে আড়ালের রাখার চেষ্টা করেছি।’

ঘটনার পিছনের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘একটি মেয়ের সাথে আমার চার বছরের সম্পর্ক ছিল। সম্প্রতি আমাদের সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছিল। এক ঘটনায় মেয়েটি আমার মাকে নিয়ে অশালীন মন্তব্য করে। যেটি আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। একে তো সম্পর্কের টানাপড়েনে বিপর্যস্ত, তারউপর আমার বিধবা মাকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য আমাকে দিশেহারা করে তোলে।’

এসময় আবেগী হয়ে পড়েন ফেরদৌস নাঈম। ধরা গলায় বলেন, ‘‘আমাদের সম্পর্কের বিষয়ে উভয়ের পরিবার জানত। এ কারণে ঘটনার দিন (৫ সেপ্টেম্বর) উভয় পরিবার বসে বিষয়টি আলোচনা করে। তবে মেয়েটি তার অশালিন আচরণের জন্য আমার মায়ের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেনি। তার পরিবারের অন্য সদস্যরাও তাকে মৌন সমর্থন দেয়। তারা চলে গেলে আমি আম্মু এবং আমার চাচাকে অপমানের বিষয়টি নিয়ে আইনি বিচার কিংবা পারিবারিকভাবে দুঃখ প্রকাশের কথা বলি। এক কথায় আম্মুর অপমানের বিচার চাইছিলাম।

‘তবে আমার আম্মু কিংবা চাচা কেউই এ বিষয়ে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে রাজি হয়নি। এদিকে আমার পক্ষে আম্মুর অপমান মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। নিজের কাছে নিজেকে ছোট ও অপরাধী মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিলে পুরো দুনিয়া একদিকে আর আমি অন্যদিকে। আমি একেবারে অসহায়। আমার হয়ে কথা বলার কেউ নেই। আমার ভাষা বোঝার কেউ নেই।

‘আম্মু নিজের অপমানের বিচার চাইলেন না, আবার বিচার পেলামও না। সেই অভিমানে আমি রুমে ঢুকে এই চিঠি লিখে আমার চাচার কাছে দিয়ে আসি। এরপর ছবিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেই।”

এরপর কি হয়েছিল জানতে চাইলে নাঈম বলেন, ‘চিঠিতে আমি সুস্পষ্টভাবে লিখেছি, আমার আম্মুর অপমানের বিচার কেউ না চাইলেও আমি চাই। আর যদি আমি মারা যাই আমার কবর যেন আব্বুর কবরে দেওয়া হয়। আমি সেই মুহূর্তে ঘরে বসে ভাবছিলাম আম্মুর অপমানের বিচার না পাওয়ায় আমার মতো অভাগার বেঁচে থাকার কোনো প্রয়োজন আদৌ কি আছে? আমি সেই মুহূর্তে আত্মহননের পথই বেছে নিচ্ছিলাম। সেসময় আমার পোস্ট দেখে আমার এলাকার ছোট ভাই মিকাইল-সহ আরও কয়েকজন আমার বাসায় আসে। মিকাইলের লাথিতে আমার ঘরের দরজা ভেঙে যায়। তারপর পরিবারের সবাই মিলে আত্মহত্যার পথ বেছে না নিতে আমাকে অনেক বোঝায়। পরে পুলিশ সদস্যরা আসেন, তারাও একইভাবে আমাকে নানাভাবে মোটিভেশন দেন।’

নাঈমকে উদ্ধারকারী প্রতিবেশি মিকাইল বিন মাসুম বলেন, ‘আমি রাতের খাবার খাচ্ছিলাম আর ফেসবুক স্ক্রল করছিলাম। হঠাৎ নাঈম ভাইয়ের এরকম পোস্ট দেখে তাড়াতাড়ি তাদের বাসায় যাই। গিয়ে দেখি নাঈমের ভাইয়ের আম্মু আর কাকা উঠানে দাঁড়িয়ে তাকে ডাকছে। নাঈম ভাই ঘরে দরজা বন্ধ করে দিয়ে রেখেছে। আমিও তাকে ডাকাডাকি করি এবং দরজায় ধাক্কা দিই। সে দরজা না খুললে এক পর্যায়ে আমি দরজায় লাথি মারতে শুরু করি। এতে দরজা ভেঙে যায়। ঘরে ঢুকে দেখি নাঈম ভাই চিঠিতে যেভাবে লিখেছে সেভাবেই বিছানায় পড়ে আছে। আমি এবং উপস্থিত সবাই মিলে তাকে উদ্ধারের পর নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করি। খানিক পর পুলিশ আসে। তারাও নানাভাবে তাকে মোটিভেশন দেয় এবং আত্মহত্যা থেকে ফিরে আসার বিষয়ে বোঝায়।

অপর প্রত্যক্ষদর্শী এবং ফেরদৌস নাঈমের প্রতিবেশি রবি দাস বলেন, ‘খবর শুনে আমি ওর বাড়ি যাই। সেখানে গিয়ে দেখি নাঈমের রুমের বুক সেলফের কাচ ভাঙা। ঘরের মেঝেতে সেই কাচ ছড়ানো। পরিবারের সবাইমিলে তাকে বোঝাচ্ছিলে। এরপর পুলিশ ও আসে। আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি, কিছুদিন আগেই নাঈমের আম্মুর অপারেশন হয়েছে। তিনি অসুস্থ। নাঈমের এরকম মানসিক বিপর্যয়ে তার মা শঙ্কিত। রাতে না ঘুমিয়ে ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন।’

এদিকে এ ঘটনা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে মুখরোচক উপজীব্য হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। এই নিউজে বেশিরভাগ সংবাদপত্রের হেডলাইনে ঘটনাটিকে হাস্যকর হিসেবে উপস্থাপনের প্রচেষ্টা ছিল। এছাড়া দায়-দায়িত্বের অভাব ছিল স্পষ্ট। তাদের উপস্থাপনায় উঠে আসে, ছেলেটি ফেসবুকে আত্মহত্যার নোট লিখে পরিবার-বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডা দিচ্ছিল। যা মূল ঘটনা থেকে বিচ্ছিন্ন এবং অপসাংবাদিকতা ছাড়া আর কিছু নয়। 

প্রকাশিত সংবাদের বিষয়ে ফেরদৌস নাঈম বলেন, ‘‘অনেক সংবাদে লেখা হয়েছে- সুইসাইড নোটটি ছিল ভুয়া! এটা লেখার মানে কী? সংবাদমাধ্যম কর্মীরা কি চাচ্ছিলেন- যেহেতু নোট লিখেই ফেলছি, তাহলে আমর সুইসাইড করাই উচিত ছিল? বিভিন্ন গণমাধ্যম তাদের শিরোনামে বলেছে আমি আড্ডা দিচ্ছিলাম কিংবা প্রেমিকাকে অপদস্থ করতে চেয়েছিলাম। এবিষয়ে আমি সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, আমি এই পোস্টের পর আড্ডা দিচ্ছিলাম না। আমার পরিবার ও প্রতিবেশিরা আমাকে বোঝাচ্ছিলেন। সে কারণে ঘরে অনেক মানুষ ছিল। আর প্রেমিকাকে অপদস্থ করতে চাইলে তার নাম এবং আমাদের মধ্যে ঘটে যাওয়া সকল বিষয় উল্লেখ করতাম। এরকম কিছুই করিনি আমি। আমি শুধু আমার আম্মুর অপমানের বিচার চাইছি। আর দুভার্গ্যবশত আমার আম্মুর অপমানকারী আমার প্রেমিকা ছিল। সংবাদমাধ্যম কর্মীরা এটাকে হাস্যকর বানিয়ে ফেলেছেন। আমি কি তাহলে আমার আম্মুর অপমান নিয়ে মসকরা করছিলাম সবার সাথে?

‘সংবাদমাধ্যমের যেসব কর্মী রাজবাড়ীতে আছেন, তারা কম-বেশি সবাই পরিচিত। সংবাদের জন্য না হোক অন্তত ব্যক্তিগতভাবে খোঁজ নিতে পারতেন আমার এবং পরিবারের। তারা সেটা না করে মুখরোচক সংবাদ উপস্থাপন করে আমার নিজ জেলা, বিশ্ববিদ্যালয় এবং দেশবাসীর কাছে আমাকে হাস্যকর বানিয়ে ফেলেছেন। আমার মানসিক অবস্থাটা তারা বোঝার চেষ্টাও করলেন না। বর্তমানে আমার অবস্থা এতই নাজুক যে, আমাকে একজন মনোবিজ্ঞানীর পরামর্শ নিতে হচ্ছে।”

পুরো বিষয়টিকে অপসাংবাদিকতা এবং এরফলে সামাজিক ও মানসিক চাপের কথা উল্ল্যেখ করে ফেরদৌস নাঈমের মা হুসনে নাহিদা রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘সংবাদমাধ্যমগুলো যে সংবাদ প্রকাশ করল, তার আগে তারা কেউই আমার কিংবা পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেনি। কোনো কথাও বলেনি। একজন সাংবাদিক আমাকে ফোন দেন। তবে সেসময় আমার মানসিক অবস্থা ভালো ছিল না। সে কারণে ওই মুহূর্তে আমি তার সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে অপারগতা জানাই। পরের দিন তার লেখা সংবাদে দেখি আমার নাম দিয়ে সে তার নিজের মতো বক্তব্য লিখে দিয়েছে। সেদিনের ঘটনার প্রেক্ষাপট না জেনেই বিভিন্ন সাংবাদিক বিভিন্নরকমভাবে সংবাদ লিখেছেন। যা সেদিনের ঘটনার ভয়াবহতা এবং আমার পরিবারের ওপর দিয়ে কী যাচ্ছে সেটাকে তুলে না ধরে বরং হাস্যকর করে ফেলেছে। এরফলে, আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে পরিচিতজনদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সহ্য করতে হচ্ছে। অপারেশনের কারণে আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ। এখন আমি মানসিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়ছি। এর দায় বহুলাংশে সাংবাদিকদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার ওপর পড়ে।’

ফেরদৌস নাঈম এবং তার মা হুসনে নাহিদা রাইজিংবিডির কাছে নিজেদের অবস্থা এবং ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত সুষ্ঠুভাবে তুলে ধরার কথা বলেন। তারা বলেন, ‘আপনাদের কাছে অনুরোধ সেদিনের আসল ঘটনাটি দয়া করে তুলে ধরুন। সামজিকভাবে আমরা সম্মান নিয়ে বাঁচতে চাই। এ ধরনের অপেশাদারসুলভ আচরণ দায়িত্বশীল গণমাধ্যমকর্মীদের কাছ থেকে আমরা আশা করি না।’