জাতীয়

ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা পরিকল্পনা নিয়ে অসন্তোষ

ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা পরিকল্পনা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে ডিজাইন এবং পর্যালোচনার পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান।

প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট কর্পোরেশন (সিএমসি) এই প্রকল্পের জন্য ডিজাইন এবং পর্যালোচনার পরামর্শদাতা হিসেবে নিযুক্ত TYPSA কর্তৃক প্রদত্ত কিছু বাধ্যতামূলক নির্দেশ অমান্য করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।  

গত বছরের শুরুর দিকে, সিএমসিকে দেওয়া TYPSA-এর একটি চিঠিতে পাইলের কাজে বড় অসঙ্গতিগুলোর কথা বলা হয়। তারা যে নির্দেশগুলো সম্পূর্ণভাবে অমান্য করছে, সেই প্রমাণও পাওয়া যায়। TYPSA জানিয়েছে, প্ল্যাটফর্মে যে কেসিং পাইল ছিল, তার মান অনেক বেশি খারাপ ছিল। 

আরও বলা হয়, ঠিকাদারকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছিল এবং প্ল্যাটফর্ম স্তরে তাদের পাইলের উপরে কেসিং রাখার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত, ঠিকাদার ইআরএ নির্দেশনাগুলো অনুসরণ করেনি, বরং তারা বোরিং কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই সমস্যাগুলো যদি পরীক্ষা করা না হয় এবং পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সব সমাধান না করা হয়, তাহলে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। প্রকল্পের সাথে জড়িত বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের (বিবিএ) সংশ্লিষ্ট সকলকে অবশ্যই আরও সচেতন হতে হবে এবং প্রকল্পের কাজ করার সময় ঠিকাদারের সাথে একদমই নমনীয় হওয়া যাবে না।

জানা গেছে, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কন্ট্রাক্টরের (সিএমসি) অবহেলার কারণে চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি একজন নির্মাণ শ্রমিকের ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়েছে। এর পরদিনই প্রকল্পের ডিজাইন রিভিউ কনসালটেন্ট TYPSA কর্তৃক সিএমসি-কে দেওয়া একটি চিঠিতে ঘটনার বেশকিছু কারণ ও অবহেলা স্পষ্ট করা হয়েছে। 

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, প্রকল্প কাজে যথাযথ স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা পরিকল্পনা অনুসরণ করা হয়নি। একটি বৈদ্যুতিক শক তরঙ্গ আশপাশের উচ্চ ভোল্টেজের তার থেকে নির্গত হয়েছিল, যা কার্যক্ষেত্রের কাছাকাছি ছিল, এটি ছিল প্রায় ৬.৫ ফুট এর মাঝে। কিন্তু, সিএমসি স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা পরিকল্পনায় নির্ধারিত দূরত্ব হলো মিনিমাম ২৫ ফুট। নিরাপত্তা নির্দেশিকা অনুযায়ী দূরত্ব কম থাকায় এটিই প্রমাণ হয় যে, সিএমসি‘র ব্যর্থতার কারণে একজন শ্রমিকের দুঃখজনক অকাল মৃত্যু হয়েছে। দুর্ঘটনার জন্য কোনো তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়নি। এমনকি স্থানীয় শ্রমিকদের জন্যেও রাখা হয়নি কোন বীমা সুবিধা। যদিও শ্রমিকদের জন্য বীমা সুবিধা থাকাটা ছিল বাধ্যতামূলক এবং এটা চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ প্রতিটি পেমেন্টে শ্রমিকদের বীমা সুবিধার আওতায় আনতে অর্থ দিয়ে থাকে। তা সত্ত্বেও ইচ্ছাকৃতভাবে স্থানীয় শ্রমিকদের বীমার ব্যবস্থা করে না চায়না কোম্পানি সিএমসি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিএমসি যাতে স্থানীয় শ্রমিকদের শোষণ না করে, তা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের (বিবিএ) কাজ করা উচিত। চাইনিজ নববর্ষে চীনা কোম্পানিকে ফুল দেওয়ার পরিবর্তে একজন নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যুর জন্য বিবিএ-কে অবশ্যই সিএমসি’র প্রতি কঠোর হওয়া উচিত। ভবিষ্যতে তারা যাতে শুধু লাভের কথা চিন্তা না করে শ্রম আইন ও নিরাপত্তা নির্দেশিকা অনুসরণ করে, তা নিশ্চিতে কাজ করতে হবে। প্রতিটি জীবনেরই মূল্য থাকা উচিত।

জানা গেছে, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান চীনা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি সিএমসি’র কাছ থেকে অর্থ সংরক্ষণের জন্য বিবিএ এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে (ইআরডি) নির্দেশ দিয়ে একটি রিট পিটিশনের রুল দিয়েছে। আদালত বিবিএকে সংশ্লিষ্ট অংশের জন্য অর্থ সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়েছেন। আদালতের আদেশ কার্যকর করতে বিবিএ গত ৭ ফেব্রুয়ারি একটি নির্দেশ জারি করে।

অতীত অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করলে জানা যায়, চাইনিজ কোম্পানি সিএমসির বিরুদ্ধে অতীতেও অর্থ প্রদান না করার অভিযোগ রয়েছে। ২০১৮ সালে তারা বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) অনুমোদিত কোম্পানি STUP এবং NCME কে ডিজাইন ভিত্তিক রিপোর্ট (DBR) তৈরি করার জন্য নিয়োগ করে। সেই রিপোর্টের বিল পরপর দুইবার ২০১৮ ও ২০২১ সালে লিখিত নোটিস দেয়াও সত্বেও STUP এবং NCME কে ডিজাইনের অর্থ প্রদান করেনি সিএমসি। কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে প্রতারণামূলক কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে একটি নিয়ম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে চাইনিজ কোম্পানি সিএমসি। কারণ, হিসেবে বলা হচ্ছে, বেশকিছু প্রতারণামূলক কার্যক্রম পরিচালনার পরেও সিএমসিকে সব সময় অভিযোগ থেকে ছাড় দেওয়া হয়  এবং তাদের সব রকম সহযোগিতা করা হয়।

সামগ্রিক বিষয়ে সিএমসি কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ্য, ঢাকার দ্বিতীয় (ঢাকা-আশুলিয়া) এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন পায় ২০১৭ সালে। ১৭ হাজার ৫৫৩ কোটি ৪ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে প্রকল্পটি। এটি শেষ করার কথা রয়েছে ২০২৬ সালের জুনে।