‘বল বীর, বল উন্নত মম শির’ অথবা মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত/আমি সেই দিন হব শান্ত/ যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দল-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,/ অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না’- জাতীয় কবির এ বলিষ্ঠ উচ্চারণ আমাদের জাগ্রত করে যায় বারবার।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী আজ। ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ বর্ধমান জেলার আসানসোলের জামুরিয়া থানার চুরুলিয়া গ্রামে তিনি জন্মেছিলেন। তাঁর ডাক নাম ‘দুখু মিয়া’। বাবার নাম কাজী ফকির আহমেদ ও মা জাহেদা খাতুন।
‘অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং নজরুল’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এবার জাতীয় কবির জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হচ্ছে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন।
বাণীতে রাষ্ট্রপতি বলেন, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বাঙালির প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে নজরুলের কবিতা ও গান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, উনবিংশ শতাব্দীর বিদায় এবং বিংশ শতাব্দীর আগমন লগ্নে নজরুলের জন্ম। তখন বাংলাদেশসহ গোটা উপমহাদেশ পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দি। একদিকে দারিদ্র্য অন্যদিকে দেশমাতার পরাধীনতা কবিকে মুক্তির আকাক্সক্ষায় পাগলপ্রায় করে তুলেছিল। কবি অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নিজেকে উৎসর্গ করেন। রাজদ্রোহের অপরাধে কারাবরণ করেন। কবিতাকে বেছে নেন প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে।
জাতীয় পর্যায়ে কবির জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- কবির মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ, আলোচনা সভা ও সঙ্গীতানুষ্ঠান।
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় তিন দিনব্যাপি (২৫ থেকে ২৭ মে) অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী দিন আজ। এতে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন জাতীয় সংসদের সংসদ উপনেতা বেগম মতিয়া চৌধুরী। বিকেল ৪টায় রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরে অনুষ্ঠানটির উদ্বোধন হবে। এছাড়া সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নাহিদ ইজহার খানের নেতৃত্বে সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বরে কবির সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের কর্মসূচী রয়েছে। সকালে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে কবির সমাধিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের কর্মসূচী রয়েছে। বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন জাতীয় কবির সমাধিতে , বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে স্থাপিত নজরুল প্রতিকৃতিতেও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন কর্মসূচী রয়েছে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
ময়মনসিংহ, জাতীয় কবির স্মৃতি বিজড়িত কুমিল্লার দৌলতপুরসহ বিভিন্ন স্থানে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় ও স্থানীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় যথাযোগ্য মর্যাদায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫ তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করা হচ্ছে।
বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও কাজী নজরুল ছিলেন একাধারে কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। তিনি বৈচিত্র্যময় অসংখ্য রাগ-রাগিনী সৃষ্টি করে বাংলা সঙ্গীত জগতকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। তার কবিতা, গান ও সাহিত্য কর্ম বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ সৃষ্টি করেছিল। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ লেখক। তাঁর লেখনি জাতীয় জীবনে অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। তাঁর কবিতা ও গান মানুষকে যুগে যুগে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে চলছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বাংলাদেশে তাঁর বসবাসের ব্যবস্থা করেন। ধানমন্ডিতে কবির জন্য একটি বাড়ি প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধুর নান্দনিক এবং বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত ছিল নজরুলকে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে আনয়ন এবং নাগরিকত্ব ও ‘ডক্টরেট’ খেতাব প্রদান। বঙ্গবন্ধু ও নজরুল এবং বাংলাদেশ একই মাল্যে সৌরভে গৌরবে গ্রন্থিত।