জাতীয়

দেশে মাদকাসক্ত ৭০ লাখ, ১০ বছরে সন্তানের হাতে মারা গেছেন ২০০ বাবা-মা

আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবসের সিম্পোজিয়ামে বক্তারা বলেছেন, মাদকাসক্তি আধুনিক সভ্যতার বিপজ্জনক রোগ। এইডস, ক্যানসার ও হৃদরোগের মতো মাদকাসক্তিও ভয়াবহ রোগ। এটি পারমাণবিক বোমার চেয়েও বেশি ক্ষতিকর। দেশের ৭০ লাখ লোক মাদক সেবন করেন। বছরে সেবন করা মাদক এক লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণ, যা দেশের বাজেটের প্রায় এক চতুর্থাংশ। উন্নয়ন বাজেটের ৫৬ শতাংশ। গত ১০ বছরে মাদকাসক্ত সন্তানের হাতে প্রায় ২০০ বাবা-মা মারা গেছেন।

বুধবার (২৬ জুন) সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে যুব উন্নয়ন সংসদ আয়োজিত ‘মাদকের ভয়াবহতা, যুব সমাজের নৈতিক অধঃপতন ও আজকের বাংলাদেশ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব বলেন।

বিএফইউজে সভাপতি রুহুল আমিন গাজীর সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক সচিব ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের সদস্য সচিব কাদের গনি চৌধুরী, সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. হুমায়ুন কবীর, অধ্যাপক ড. শামসুল আলম, অধ্যাপক ডা. আতিয়ার রহমান, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. শহিদুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট মো. সাইফুর রহমান, ড. দেওয়ান মুহাম্মদ সাজ্জাদ প্রমুখ। সিম্পোজিয়ামে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর নূর নবী মানিক। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন যুব উন্নয়ন সংসদের চিফ কোঅর্ডিনেটর মুহাম্মদ কামাল হোসাইন।

সাবেক সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, মাদকাসক্তি আধুনিক সভ্যতার বিপজ্জনক রোগ। মাদকের ভয়াল থাবায় ধ্বংসের পথে তরুণ প্রজন্ম। শহর থেকে গ্রাম, স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্রই মাদক পাওয়া যাচ্ছে হাতের নাগালে। মাদক এক নীরব ঘাতক। মাদকের কারণে বেড়ে যাচ্ছে সামাজিক অবক্ষয়। তরুণসমাজের হারিয়ে যাচ্ছে নৈতিক মূল্যবোধ। এই ভয়াল মাদক তারুণ্য, মেধা, বিবেক, মনুষ্যত্বসব কিছু ধ্বংস করে দিচ্ছে। ভেঙে যাচ্ছে পারিবারিক বন্ধন, নষ্ট হচ্ছে আস্থা-বিশ্বাস। পরিবার ও সমাজে তৈরি হচ্ছে নতুন আতঙ্ক।

ড. আবদুল মজিদ বলেন, মাদকাসক্তি একটি বহুমাত্রিক জটিল সমস্যা। এ ব্যাধি দূর করতে দরকার সমন্বিত কর্মপ্রয়াস। সরকারের একার পক্ষে এর নিরসন সম্ভব নয়। মাদকাসক্তি প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে মাদকদ্রব্য ও মাদকাসক্তির বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলা। পরিবার ও সমাজজীবন থেকে মাদকদ্রব্য উৎখাত এবং মাদকাসক্তি নির্মূল করতে হলে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি দরকার মানুষের বিবেক ও মূল্যবোধের জাগরণ, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন। সমন্বিত সামাজিক প্রতিরোধ ছাড়া মাদক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় জানিয়ে তিনি, মাদক সমস্যার সমাধানে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংগঠন, শিক্ষক, সকল ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, পিতা-মাতা, সুশীল সমাজ, অভিভাবকসহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

রুহুল আমিন গাজী বলেন, উঠতি বয়সী সন্তানরা কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে, স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ব্যত্যয় ঘটাচ্ছে কি না তা অভিভাবকদের সর্বাগ্রে নজর দিতে আমি অনুরোধ জানাই। হতাশা মাদকাসক্তির অন্যতম কারণ। তাই হতাশা রোধে যুবসমাজের জন্য নিয়মিত লেখাপড়া, খেলাধুলা, সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সম্প্রসারণ জরুরি বলে আমি মনে করি। মাদক দেশের আর্থসামাজিক নিরাপত্তা ও জাতীয় উন্নয়নের একটি বড় অন্তরায়।

তিনি বলেন, মাদকের কারণে এদেশে প্রতিনিয়ত বহু পরিবার ধ্বংস হচ্ছে; অকালে ঝরে যাচ্ছে বহু তাজা প্রাণ। সৃষ্টি হচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা। মাদকের ভয়ঙ্কর আগ্রাসন থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করতে হলে আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের পাশাপাশি মাদকবিরোধী ব্যাপক গণসচেতনতা ও সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন।

কাদের গনি চৌধুরী বলেন, বর্তমান বিশ্বে পারমাণবিক মারণাস্ত্রের চেয়েও ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে মাদকতা। যা প্রতিনিয়ত ধ্বংস করে দিচ্ছে আমাদের যুবসমাজকে। অকালে ঝরে যাচ্ছে অসংখ্য তাজা প্রাণ। দাম্পত্য জীবনের কলহের জের ধরে ভেঙ্গে যাচ্ছে অসংখ্য সুখের সংসার। নেশার করালগ্রাসে ধুঁকে ধুঁকে মরছে লক্ষ-কোটি তাজা প্রাণ। ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত সর্বনাশা এই মাদক দাবানলের ন্যায় ছড়িয়ে পড়ছে।

পেশাজীবী পরিষদের এই নেতা জানান, দেশের ৭০ লাখ লোক মাদক সেবন করেন। আর তারা এক লাখ কোটি টাকার মাদক সেবন করে, যা বাংলাদেশের বাজেটের প্রায় এক চতুর্থাংশ, উন্নয়ন বাজেটের ৫৬ শতাংশ। গত ১০ বছরে মাদকাসক্ত সন্তানের হাতে ২০০ বাবা-মা মারা গেছেন।

আঙ্কটাড (ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) এর উদ্ধৃতি দিয়ে কাদের গনি চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ থেকে মাদকের কারণে প্রতিবছর পাচার হয়ে যায় ৪৮১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ৫ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। আর মাদক কেনাবেচা করে অর্থ পাচারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম। এশিয়ার দেশগুলো বিবেচনায় নিলে মাদকের মাধ্যমে টাকা পাচারের ঘটনায় বাংলাদেশ একেবারে শীর্ষে রয়েছে। মাদকের অবৈধ অর্থপ্রবাহের দিক থেকে বিশ্বে প্রথম অবস্থানে রয়েছে মেক্সিকো। এরপর যথাক্রমে রয়েছে কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, পেরু ও বাংলাদেশ।

কাদের গনি চৌধুরী বলেন, দেশের উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীদের একটি বড় অংশ ইয়াবা ও আইস আসক্ত হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে ধনী পরিবারের অতি আদরের সন্তানরাই সর্বাধিক বেশী মাদকাসক্ত। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্র-ছাত্রীই নয় কলেজ ,স্কুলেও মাদক ঢুকে পড়েছে। কিছুদিন আগে বগুড়ায় স্কুলের বিদায় অনুষ্ঠানে বন্ধুদের সঙ্গে ‘মাদক সেবনে’ অসুস্থ হয়ে এক এসএসসি পরীক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। এভাবে তারুণ্যের বাঁধভাঙ্গা জোয়ার নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। ক্রমান্বয়ে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত।

এক গবেষণার বরাত দিয়ে কাদের গনি বলেন, মাদকদ্রব্য গ্রহণ ও অসামাজিক কাজে লিপ্ত হওয়ার মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এছাড়া মাদকাসক্ত ব্যক্তি নেশার টাকা সংগ্রহ করতে নানারকম অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, পতিতাবৃত্তি , ধর্ষণ, খুন, গুম ইত্যাদি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে। পত্রিকা খুলতেই আমাদের চোখে পড়ে ‘নেশার টাকা না দেওয়ায় ছেলের হাতে পিতা খুন’, কিংবা ‘পুত্র পিটিয়ে হত্যা করল মাকে’। এমনিভাবে মাদকাসক্ত সন্তানের নির্মমতার শিকার হয়ে অনেক মা-বাবা তাদের অতি আদরের সন্তানকে পুলিশের হাতে তুলে দিতেও দ্বিধা করছেন না। সম্প্রতি বহুল আলোচিত পুলিশ দম্পতির লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটিয়েছে তাদেরই কিশোরী কন্যা সন্তান ঐশী। তদন্তে জানা গেছে যে, সে ছিল মাদকাসক্ত এবং প্রায়ই পুরুষ বন্ধুদের নিয়ে ক্লাবে গিয়ে দীর্ঘ রাত পর্যন্ত সময় অতিবাহিত করত। এইতো কিছুদিন আগের কথা, এক মাদকাসক্ত ছেলে তার মা-বাবাকে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। এভাবে প্রতিনিয়ত কত যে মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে তার সঠিক কোনও পরিসংখ্যান নেই।

মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, উঠতি বয়সী সন্তানরা কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ব্যত্যয় ঘটাচ্ছে কি না, তা অভিভাবকদের সর্বাগ্রে নজর দিতে আমি অনুরোধ জানাই। হতাশা মাদকাসক্তির অন্যতম কারণ। তাই হতাশা রোধে যুবসমাজের জন্য নিয়মিত লেখাপড়া, খেলাধুলা, সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র সম্প্রসারণ জরুরি বলে আমি মনে করি। মাদক দেশের আর্থসামাজিক নিরাপত্তা ও জাতীয় উন্নয়নের একটি বড় অন্তরায়।

মাদকের কারণে এ দেশে প্রতিনিয়ত বহু পরিবার ধ্বংস হচ্ছে; অকালে ঝরে যাচ্ছে বহু তাজা প্রাণ। সৃষ্টি হচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা। মাদকের ভয়ঙ্কর আগ্রাসন থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করতে হলে আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের পাশাপাশি মাদকবিরোধী ব্যাপক গণসচেতনতা ও সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন।