জাতীয়

ইলেকট্রনিক লেনদেনের নিরাপত্তায় হচ্ছে নতুন আইন

ইলেকট্রনিক মুদ্রাসহ অন্যান্য লেনদেনে গ্রাহকদের ঝুঁকি কমানো ও সুরক্ষায় করা হচ্ছে নতুন আইন। এ আইনের আওতায় ইলেকট্রনিক লেনদেনের ক্ষেত্রে গ্রাহকদের সার্থ সুরক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মঙ্গলবার (২ জুলাই) অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জাতীয় সংসদে চলতি অধিবেশনে আইনটি অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করবেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এই আইনের নামকরণ করা হয়েছে, ‘পরিশোধ ও নিষ্পত্তি ব্যবস্থা আইন ২০২৪।’ অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এ আইনটি প্রণয়ন করেছে।

‘পরিশোধ ও নিষ্পত্তি ব্যবস্থা আইন, ২০২৪’ এর বৈশিষ্ট্য ও সুবিধা: বাংলাদেশে পরিশোধ ও নিষ্পত্তি ব্যবস্থা বিষয়ে কোনো আইন নেই। অ-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিশোধ কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণেও বর্তমানে কোনো আইন নেই। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আলোকে আর্থিক সেবায় উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন নতুন আর্থিক সেবার উদ্ভাবন হবে। এর ফলে সাধারণ জনগণকে সহজে, সুলভে ও নিরাপদে আর্থিক খাতে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ তৈরী হবে। এক ও অভিন্ন আইনের আওতায় দেশের ভিতরে আর্থিক লেনদেন পরিচালনা করা সম্ভব হবে এবং লেনদেনে তৃতীয় পক্ষের সম্পৃক্ততার ফলে যে আর্থিক ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে, সেটি কমানো সহজ হবে।

লেনদেনে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে অ-ব্যাংক পরিশোধ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন, দায়-দায়িত্ব নির্দিষ্টকরণ, তদারকি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার মাধ্যমে এ ধরনের লেনদেনে গ্রাহকদের প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি কমবে এবং যে কারও পক্ষে তৃতীয় পক্ষ সেজে প্রতারণার বা গ্রাহক হয়রানির সুযোগ বন্ধ হবে।

অ-ব্যাংক পরিশোধ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশনা দেওয়া ও তদারকির আইনগত ভিত্তি থাকবে বলে পরিশোধ সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠানে অনিয়মের আশঙ্কা কমবে।

এই আইন অনুমোদিত হলে বিরোধ নিষ্পত্তিতে সংশ্লিষ্ট অন্য আইনের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে। ফলে, আইন প্রয়োগে জটিলতা কমবে।

যেসব প্রতিষ্ঠান অনুমোদন না নিয়ে পরিশোধ সেবা দিচ্ছে, তাদের বিরূদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পরিশোধ ব্যবস্থায় গতি ও নতুনত্ব আনা যাবে এবং লেনদেনে যেসব প্রতিষ্ঠান অংশ নেবে, তাদের দায়-দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করা সম্ভব হবে।

পরিশোধ সেবা গ্রহণকারী গ্রাহকের স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত হবে। গ্রাহক স্বার্থ সুরক্ষার লক্ষ্যে ব্যাংকের পাশাপাশি অ-ব্যাংক পরিশোধ সেবাদানকারীদের আইনি কাঠামোর আওতা ভুক্ত করা যাবে। পরিশাধ কাজে অংশগ্রহণ, পরিশোধ ব্যবস্থা পরিচালন ও পরিশোধ সেবাদানের অনুমোদন, লাইসেন্স দেওয়া, নিকাশ ও নিষ্পত্তি ব্যবস্থার পরিসর নির্ধারণ ও সংহত করা যাবে।

পরিশোধ ব্যবস্থার মূলধন, মালিকানা, পরিচালনা সংক্রান্ত বিধান প্রণয়ন করা যাবে। পরিশোধ ব্যবস্থায় সেবা দেওয়ার নিয়ম তৈরি, পরিশোধ কাজে এজেন্ট নিয়োগ সংশ্লিষ্ট বিধান প্রণয়ন করা যাবে।

পরিশোধ কাজ নিরীক্ষা, তদারকি ও তদন্ত করার বিধান প্রণয়ন ও কমিটি গঠন, পরিশোধ নির্দেশ অনুমোদন ও প্রত্যাহার, ভুলভাবে পরিশোধ নির্দেশ কার্যকর হওয়ার প্রতিকারের ব্যবস্থা; নিষ্পত্তি সেবা, চেক, ইলেকট্রনিক তহবিল স্থানান্তর এবং ইলেকট্রনিক মুদ্রা ইস্যু সংক্রান্ত বিধান প্রণয়ন করা যাবে। পরিশোধ কোম্পানিতে প্রশাসক নিয়োগ, অবসায়ন ও দেউলিয়া সংক্রান্ত বিধান প্রণয়নে সুবিধা হবে।

এই আইন লঙ্ঘনের দায়ে দণ্ড, বিচার ও জরিমানা এবং বিরোধ নিস্পত্তি সংক্রান্ত বিধান প্রণয়ন করা যাবে। অদাবিকৃত স্থিতি বাংলাদেশ ব্যাংকে হস্তান্তরের বিধান প্রণয়ন সহজ হবে।

আইনের বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন বা লাইসেন্স গ্রহণ ছাড়া কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংক-কোম্পানি কোনো পরিশোধ ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ, পরিশোধ ব্যবস্থা পরিচালনা বা ইলেকট্রনিক মুদ্রায় পরিশোধ সেবা দিতে পারবে না। পরিশোধ সেবা দেওয়ার নিয়মাবলি হতে হবে নৈর্ব্যক্তিক, বৈষম্যহীন ও সঙ্গতিপূর্ণ। গ্রাহকের অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করে এমন কোনো বিধান অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না।

বিধিবিধান লঙ্ঘন করে কোনো প্রতিষ্ঠান লেনদেন ব্যবসা পরিচালনা করলে বা মিথ্যা তথ্য বা বিবৃতি দিলে প্রস্তাবিত আইনে অনধিক তিন বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৩০ লাখ টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

লাইসেন্স বাতিল হওয়ার পর কোনো প্রতিষ্ঠান এ ধরনের ব্যবসা পরিচালনা করলে সেক্ষেত্রে অনধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও অনধিক ৫০ লাখ টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া, নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় বাধা দিলে অন্যূন ১ লাখ টাকা থেকে অনধিক ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আর্থিক দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে।

অনুমোদন বা লাইসেন্সপ্রাপ্তির জন্য নির্ধারিত ফরম পূরণ, পদ্ধতি অনুসরণ ও ফি প্রদান সাপেক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করতে হবে। আইন কার্যকর হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে লাইসেন্স গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান তাদের যাবতীয় কার্যক্রম আইনের বিধানাবলীর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করবে এবং ইতোমধ্যেই পরিশোধ সেবা পরিচালনাকারী ব্যাংক-কোম্পানিগুলোকে আইন কার্যকর হওয়ার এক বছরের মধ্যে লাইসেন্স নিতে হবে।

এ বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেছেন, বর্তমানে ডিজিটাল পদ্ধতিতে অনেক ধরনের লেনদেন হচ্ছে। মূল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বাইরে ইন্টারনেট ও এজেন্ট ব্যাংকিং, ইলেকট্রনিক তহবিল স্থানান্তর, ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ডসহ বিকাশ, নগদ, রকেট, বিভিন্ন ব্যাংকের ই-ওয়ালেট, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, ইলেকট্রনিক মুদ্রা, ইলেট্রনিকভাবে তহবিল স্থানান্তর, চেক ইলেট্রনিকভাবে উপস্থাপন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিটাল মুদ্রা, ট্যাংকেটেড চেক, ট্রাস্ট কাম সেটেলমেন্ট অ্যাকাউন্ট, সরকারি সিকিউরিটিজ সেটেলমেন্ট সিস্টেম ইত্যাদি। এসব পদ্ধতির মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ, অর্থ গ্রহণ ও গ্রাহকের অর্থ চাহিদা নিষ্পত্তি হচ্ছে। এসব পদ্ধতি ব্যবহার করছে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, এজেন্ট ব্যাংকিংসহ বিভিন্ন ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউট। এদের কার্যক্রম তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ঝুঁকি কমানো এবং গ্রাহকের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য এ আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে।

এই আইনের আওতায় মূল ব্যাংকিং সেবার বাইরে অর্থ লেনদেন পরিশোধ ব্যবসায় আগ্রহী ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে পরিশোধ সেবা দেওয়ার আগে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ-সংক্রান্ত পৃথক অনুমোদন নিতে হবে। ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যাংক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে মূলধন, মালিকানা ও পরিচালনার বিষয়ে ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১’-এর ১৪ নম্বর আইনের সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান অনুসরণ করতে হবে। এছাড়া, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান-বহির্ভূত অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তি অর্থ লেনদেন পরিশোধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হতে পারবে। তবে, এ ক্ষেত্রে আগ্রহী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান অনুসরণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লাইসেন্স নিতে হবে এবং ব্যবসা পরিচালনাকারীকে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নিয়মে সময়ে সময়ে নির্ধারিত পরিমাণে, হারে ও পন্থায় মূলধন সংরক্ষণ করতে হবে।

আইনে বলা হয়েছে, পরিশোধ সেবা প্রদানকারী পরিশোধ সেবা দেওয়ার উদ্দেশ্যে গ্রাহকের হিসাব খোলা, ইলেকট্রনিক মুদ্রা ইস্যু করা ও ইলেকট্রনিক মুদ্রায় লেনদেন সম্পাদন এবং ট্রাস্ট ও সেটেলমেন্ট অ্যাকাউন্টের ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করবে।

পরিশোধ ব্যবস্থা পরিচালনাকারী পরিশোধ ব্যবস্থায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে লেনদেন নিস্পত্তি সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনাসহ বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অনুমোদিত অন্য কোনো পদ্ধতিতে গ্রাহকদের পরিশোধ কার্যক্রমে সহায়তা করতে পারবে।

পরিশোধ ব্যবস্থায় অংশগ্রহণকারী নিজের বা গ্রাহকের পক্ষে পরিশোধ, নিকাশ ও নিষ্পত্তি ব্যবস্থায় অংশগ্রহণসহ প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নিষ্পত্তি ব্যবস্থা পরিচালনা সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে।

পরিশোধ ব্যবস্থা পরিচালনাকারী, পরিশোধ ব্যবস্থায় অংশগ্রহণকারী ও পরিশোধ সেবাদানকারী নিষ্পত্তি সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সেবাগ্রহীতার অর্থ ধারণ করলে ওই অর্থের ব্যবস্থাপনা ট্রাস্ট ও সেটেলমেন্ট অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সম্পন্ন করবে।

অন্যদিকে, সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা-নিষেধের মধ্যে রয়েছে—এ আইনের অধীনে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি ‘অগ্রিম পরিশোধিত দলিল’ ইস্যু বা ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে না এবং জনগণ থেকে কোনো প্রকার বিনিয়োগ গ্রহণ, ঋণ প্রদান, অর্থ সংরক্ষণ বা আর্থিক লেনদেন উদ্ভব হয় এমন কোনো অনলাইন বা অফলাইন প্ল্যাটফর্ম পরিচালনা করতে পারবে না।

আইনে বলা হয়েছে, পরিশোধ সেবা প্রদানে লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মাবলি অনুসরণ করে নিজস্ব নিয়মাবলি প্রণয়ন ও প্রকাশ করবে। নিয়মাবলিতে তারল্য, নিষ্পত্তি, কারিগরি ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, সুশাসন, নিরবচ্ছিন্ন পরিচালন, আপৎকালীন ব্যবস্থা, বিরোধ নিষ্পত্তি, গ্রাহকসেবা ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এ ক্ষেত্রে শর্ত থাকে যে, নিয়মাবলি নৈর্ব্যক্তিক, বৈষম্যহীন ও সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে এবং গ্রাহকের অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করে, এমন কোনো বিধান অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। পরিশোধ সেবা পরিচালনাকারী বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নীতিমালার আওতায় কোনো তৃতীয় পক্ষ থেকে আউট-সোর্সিং সেবা নিতে পারবে বা এজেন্ট নিয়োগের মাধ্যমে গ্রাহককে সংশ্লিষ্ট পরিশোধ সেবা দিতে পারবে।