ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ-দেশের আট জেলার বন্যায় ভয়াবহ মানবিক বিপর্য়ের মুখে এলাকাবাসী। বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে কাজ করছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, ফায়ার সার্ভিসের বেশ কয়েকটি দল। পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও উদ্ধার কার্যক্রম চালাচ্ছে। তবে দু-একদিনের মধ্যে বন্যার পানি নামতে শুরু হতে পারে বলে জানিয়েছে পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
শুক্রবার (২৩ আগস্ট) পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান জানান, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদীসমূহের পানি সমতল ধীর গতিতে হ্রাস পাচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় পূর্বাঞ্চলীয় কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া ও ফেনী জেলার ভারতীয় ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এবং ত্রিপুরা প্রদেশের অভ্যন্তরীণ অববাহিকাসমূহে ভারী বৃষ্টিপাত পরিলক্ষিত হয়নি এবং উজানের নদ-নদীর পানি সমতল হ্রাস পাওয়া শুরু হয়েছে। ফলে বর্তমানে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলার নিম্নাঞ্চলের বিদ্যমান বন্যা পরিস্থিতির ধীর গতিতে উন্নতি হচ্ছে।
আবহাওয়া সংস্থাসমূহের তথ্য অনুযায়ী, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। এ সময় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার মনু, খোয়াই, ধলাই নদীসমূহের সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
আবহাওয়া সংস্থাসমূহের তথ্য অনুযায়ী, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। এ সময় এ অঞ্চলের ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলার মুহুরী, ফেনী, গোমতী, হালদা ইত্যাদি নদীসমূহের সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
উদয় রায়হান জানান, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে, অপরদিকে গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি সমতল স্থিতিশীল আছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি সমতল স্থিতিশীল আছে, যা আগামী ২৪ ঘন্টায় হ্রাস পেতে পারে। দেশের উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীসমূহের পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে। আগামী ৪৮ ঘন্টায় এসব নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বিরাজমান থাকতে পারে।
পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী মেহেদী হাসান বলেন, আগামী ২৪ ঘণ্টায় ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। উজানে বৃষ্টি কমেছে এবং সেখানে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। ভারতে পানি কমছে। এর প্রভাব দেশেও পড়বে। আশা করা যাচ্ছে, আজকে পানি স্থিতিশীল হয়ে যেতে পারে। কাল থেকে পানি কমা শুরু হতে পারে। পরবর্তী সময় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বলেন, বন্যায় জনগণের জানমাল রক্ষায় সার্বিকভাবে প্রশাসন কাজ করছে। দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের সার্বিক প্রস্তুতি রয়েছে।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, প্রায় এক সপ্তাহ আগে বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছিল। এর প্রভাবে বৃষ্টি বাড়তে থাকে। তবে তিন দিন ধরে প্রবল বৃষ্টি শুরু হয় চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফেনী, খাগড়াছড়িসহ দক্ষিণ-পূর্বের বিভিন্ন অঞ্চলে। গত পরশু থেকে সিলেট অঞ্চলেও বৃষ্টি শুরু হয়, এর সঙ্গে যুক্ত হয় ত্রিপুরা থেকে নেমে আসা ঢল। এতে চট্টগ্রাম, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, কক্সবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট ও মৌলভীবাজারে বন্যা হয়।
বন্যার পানিতে লাখো লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবতার জীবনযাপন করছে। ফেনী সদরসহ ছয় উপজেলা বানের পানিতে পুরোপুরি ডুবে আছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা পরশুরাম, ছাগলনাইয়া ও ফুলগাজীর। এসব এলাকা বাইরে থোকা স্বজনরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। নির্ঘুম রাতে তাদের শঙ্কা, প্রিয় স্বজনরা কেমন আছেন? বিদ্যুৎ নেই, মোবাইলেও যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। এসব এলাকার যতদূর চোখ যায় পানি আর পানি। একতলা ঘরবাড়িগুলো ডুবে গেছে পানিতে। কোথাও বুকপানি, কোথাও গলা অবধি।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় পূর্বাঞ্চলীয় কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া ও ফেনীর ভারতীয় ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এবং ত্রিপুরা রাজ্যের অভ্যন্তরীণ অববাহিকায় ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টি হয়েছে। ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে ফেনীর মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পানি বিপৎসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর পানি উপচে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা জানান, পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ৪ লাখ ৪০ হাজার ৮৪০টি পরিবার। ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা ২৯ লাখ ৪ হাজার ৯৬৪।
মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বন্যাদুর্গত আট জেলায় ১ হাজার ৫৩৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে কাজ করছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, ফায়ার সার্ভিসের বেশ কয়েকটি দল। পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও উদ্ধার কার্যক্রম চালাচ্ছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করা হয়েছে। তবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় এবং পানির প্রবল স্রোতের কারণে উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে বানভাসি মানুষের বাঁচার আকুতি প্রবল হয়ে উঠেছে।
আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, শুক্রবার সকাল ৬টা পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১৬৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া কক্সবাজারে ১৫১, চট্টগ্রামে ১৪৩ এবং রাঙামাটিতে ৯৭ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।