জাতীয়

‘আমারে মাইরেন না, আমি সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা’

ভালোবাসার কমতি ছিলো না জুয়েল-সীমা দম্পতির। ছেলে আবিরকে নিয়ে ভালোভাবেই কেটে যাচ্ছিলো সংসার। সুখের সংসারে আবারও আসছিলো নতুন অতিথি।আনন্দে মাতোয়ারা স্বজনেরা।কিন্তু তাতে ঘটে ছন্দপতন।ঘাতকের নির্মম নির্যাতনের বলি হন সীমা। শিশুটিও মারা যায়। সীমাকে যখন ঘাতক ছুরি দিয়ে কোপাচ্ছিলেন, তখন সে বাঁচার আকুতি জানিয়ে বলেছিল, ‘আমারে মাইরেন না, আমি সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা।’

গত ২৭ আগস্ট রাতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে সীমাকে কুপিয়ে আহত করে এক দুর্বৃত্ত। জীবন বাঁচাতে সেই অবস্থায় পাশেই ননদের বাসায় যান তিনি। তারা তাকে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় সাফা মারওয়া হাসপাতালে নিয়ে যায়। উন্নত চিকিৎসার জন্য সীমাকে ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে সিজার হয়। পরে দেখা যায় নবজাতকের বুকে দুর্বৃত্তের ছুরির আঘাত।শিশুটিকে শাহবাগের হোম কেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে রাতে মারা যায় শিশুটি। পরেরদিন দুপুরে সীমাও মারা যায়।

এ ঘটনায় সীমার স্বামী মো. জুয়েল গত ১ সেপ্টেম্বর অজ্ঞাতনা আসামি করে হত্যা মামলা করেন। ওইদিন মামলার এজাহার আদালতে পাঠানো হয়। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিনা হক গ্রহণ করে মামলাটি তদন্ত করে ২৯ অক্টোবরের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। মামলাটি তদন্ত করছে যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশ। তবে এখনো ঘাতককে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

প্রথমে মামলার তদন্ত করতে দেওয়া হয় যাত্রাবাড়ী থানার সাব-ইন্সপেক্টর শামীম রেজাকে। তাকে সম্প্রতি বদলি করা হয়েছে। তদন্তভার পড়েছে আরেক সাব-ইন্সপেক্টর মো. ইফাতের ওপর। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, বুধবার মামলা তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছি। কেস স্ট্যাডি করছি। আসামি গ্রেপ্তারে অভিযান চালাবো। দ্রুত তাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করবো বলে আশা করছি।

মামলার বাদী জুয়েল বলেন, ‘আমাদের কারো সঙ্গে শত্রুতা নেই। তবে আমরা দুই তিনটি ঘটনাকে সন্দেহ করছি। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে বোঝার চেষ্টা করছি। আমার স্ত্রী বলে গেছে সাদা গেঞ্জি পরা চিকনা-চাকনা একটা ছেলে এমনটা করেছে। তবে তাকে সে চিনতে পারেনি।’

তিনি বলেন,  ‘ওদের অভ্যাস বাসার বড় গেট খোলা রাখা। ওইদিনও খোলা ছিলো। আমার স্ত্রী আমার বোনের বাসা থেকে বাসায় ফেরে। বোরখা খুলে ফ্রিজ থেকে তরকারি বের করে গরম করতে যায়। তখনই ওই ঘাতক বাসায় ঢুকে ওর মুখ চেপে ধরে। হাতে, বুকে, পেটে ছুরি চালায়। তখন আমার স্ত্রী তার কাছে বাঁচার আকুতি জানিয়ে বলে, সে অন্তঃসত্ত্বা। তাকে না মারার অনুরোধ জানায়। কিন্তু দুই মানুষকে খুন করলো। তারপরও যদি পাশের মানুষ হেল্প করতো তাহলে হয়তো ভালো কিছু হলেও হতে পারতো। এ ঘটনা ঘটে ৯ টা ১৪ মিনিটে। বাঁচার অনেক চেষ্টা করেছে। সে পাশের প্রতিবেশীর কাছে যায় সাহায্যের জন্য। কিন্তু ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি। পরে সে হেঁটে পাশেই আমার বোনের বাসায় যায়। সেখান থেকে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।পরে তাকে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়া হয়।’

জুয়েল বলেন, সিএনজিতে বসে তার সাথে ঘটে যাওয়া সবকিছু আমাকে বলেছে। আমার ছেলে আবিরকে দেখে রাখতে বলেছে। ছেলে যেন কষ্ট না পায়। কান্নাকাটি না করে খেয়াল রাখতে বলেছে। যখন তাকে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো তখনো অনেক কিছু বলতে চাচ্ছিলো। কিন্তু পারেনি। ছেলেটা ঘুম থেকে উঠে আম্মু, আম্মু বলে চিৎকার করে। তখন মনে হয়, আমি মরে গেলেই ভালো হতো। সীমাকে মারতে আসলো না অন্য কাউকে মারতে এসে ওকে খুন করলো জানতে পারলাম না এখনো। আমি ঘাতকের ফাঁসি চাই। আর জানতে চাই, কেন তাকে খুন করলো।

সীমার মা নাসিমা বেগম বলেন, আমার সাত মাসের গর্ভবতী মেয়েটাকে শেষ করে দিলো। বুকটা ফেটে যায়। আমার দুই মেয়ে আর এক ছেলের মধ্যে ও ছোট। সবচেয়ে আদরের সন্তান আমার।সারাজীবন মেয়েটা চোখের সামনেই ছিলো। আজ ২৬ টা দিন মেয়েটা মাটির নিচে। মা হয়ে আমি কেমনে থাকি। বুকটা ফেটে যায়।

তিনি বলেন, সীমা ওর ছেলেকে ৫ মিনিটের জন্যও কারো কাছে দেয়নি। সেই ছেলেটা এখন মা ছাড়া। আবিরের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। জিজ্ঞাসা করে, মা কই। কেন মাকে খুন করলো, কে খুন করলো। কি উত্তর দিবো ওকে। মায়ের শোকে ছেলেটা খায় না। শুকায় গেছে। তাইতো ওর বড় খালা ওকে নিয়ে গেছে। ওর বয়সী তারও একটা ছেলে আছে। ভালো থাকবে এজন্য।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, শত্রুও গর্ভবতীতে ছাড় দেয়। কিন্তু পাষণ্ড ছাড়লো না। সীমা বলেছিলো আমাতে মাইরেন না, আমি সাত মাসের প্রেগন্যান্ট। তারপরও ওকে বাঁচতে দিলো না। একটাকে মা ছাড়া করলো। আরেকটাকে পৃথিবীর আলো দেখতে দিলো না। আমার মতো মায়ের দুনিয়াতে থাকা না থাকা মিথ্যা। ঘরে থাকতে পারি না। খেতে পারি না, ঘুমাতে পারি না। নাতির মুখের দিকে তাকাতে পারি না। যে এমন কাজ করেছে তার ফাঁসি চাই।

জুয়েলের করা মামলায় জানা যায়, তারা উত্তর যাত্রাবাড়ীর একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। তার শাশুড়ি যাত্রাবাড়ী এলাকার বিভিন্ন সমিতির কেন্দ্র প্রধান এবং একটি ভাড়া বাসায় সমিতির কাজ পরিচালনা করেন। এলাকার লোকজনের সমিতি থেতে টাকা নেওয়াকে কেন্দ্র করে তার সাথে এলাকার কিছু লোকের মনোমালিন্য হয়। ২৬ আগস্ট ছেলেকে নিয়ে সীমা মায়ের বাসায় যায়। সেখান থেকে তার মাকে নিয়ে ননদের বাসায় যায়। রাত ৯ টার দিকে মায়ের বাসায় আসে একা। সোয়া ৯ টার দিকে দুষ্কৃতিকারীরা বাসায় প্রবেশ করে সীমাকে ছুরিকাঘাত করে চলে যায়। পরিবারের লোকজন তাকে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় সাফা মারওয়া হাসপাতালে নিয়ে যায়। উন্নত চিকিৎসার জন্য সীমাকে ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে নেওয়া হয়।সেখানে সিজার হয়। পরে দেখা যায় নবজাতকের বুকে দুর্বৃত্তের ছুরির আঘাত। শিশুটিকে শাহবাগের কাটাবনস্থ হোম কেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে রাতে মারা যায় শিশুটি। পরদিন দুপুরে সীমাও মারা যায়।

জুয়েল অভিযোগ করেন, সমিতির ঋণ নেওয়াকে কেন্দ্র করে শাশুড়ির সাথে পূর্ব শত্রুতা অথবা তার ফল ব্যবসাকে কেন্দ্র করে অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতিকারীরা পরিকল্পিতভাবে সীমাকে ছুরিকাঘাত করে। এর ফলে তার স্ত্রী ও নবজাতক সন্তান মারা যায়।