বিদেশি কোম্পানি, টেকনোলজি এবং আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে সরকার দুধের ঘাটতি পূরণ করতে চায় বলে জানিয়েছে প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার।
সোমবার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ফিশারিজ অ্যান্ড লাইভস্টক জার্নালিস্টস ফোরাম (এফএলজেএফ) আয়োজিত ‘দেশের ডেইরি খাতের সমস্যা-সম্ভবনা ও করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন।
আমদানি নির্ভরতা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে ফরিদা আখতার বলেন, ‘দুধ উৎপাদনে যে ঘাটতি আছে, সেটা পূরণ করতে গিয়ে যেভাবে আমদানি নির্ভরতা হচ্ছে এটা আমরা বদলাতে চাই। এভাবে আমদানি নির্ভরতা থাকলে আমাদের প্রান্তিক খামারিদের গরু, ছাগল পালনের মধ্য দিয়ে যে সম্ভাবনা রয়েছে সেটা শেষ হয়ে যাবে। আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশে দুধের যে ঘাটতি রয়েছে তা পূরণ করতে হবে। এজন্য সরকার কাজ করছে।’
তিনি বলেন, ‘বিদেশি কোম্পানি নির্ভর, টেকনোলজি নির্ভর ও আমদানি নির্ভর, বলতে গেলে মৎস ও প্রাণি সম্পদ খাতে তিন নির্ভরতা আমরা কমাতে চাই। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে কৃষক যে গবাদি পশু লালন-পালন করেন, তারা পরিবারের সদস্য হিসেবে দরদ দিয়ে এটি করেন। ফলে তারা বিক্রির সময় গরুর রশি ধরে কান্নাকাটি করেন। চরাঞ্চলে যাদের কিছুই নাই, এমনকি স্বামী পরিত্যক্ত তারাও গবাদি পশু পালন করে বেঁচে থাকেন।’
ফিড নির্ভর খাবারের পরিবর্তে ঘাসের ব্যবহার বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে উপদেষ্টা বলেন, ‘দেশি জাতের গরুর দুধের নির্ভরশীলতা বিদেশি গরুর চেয়ে কম হলেও বেশি দুধের আশায় ফিড নির্ভর না হয়ে খামারিদের গোচারণ ভূমি নির্ভর হতে হবে। কারণ ৭০ শতাংশ উৎপাদন খরচ ফিডের উপর চলে যায়। আমি মনে করি, একেবারে বিশ লিটার, পঞ্চাশ লিটার দুধ উৎপাদন করতে গিয়ে ফিড নির্ভর খাবারের সংখ্যা বাড়াবো কিনা এটা আমাদের ভাবতে হবে। দেশি ঘাস খাবার হিসেবে গ্রহণ করলে উৎপাদন খরচ কমে আসে। কাজেই গোচারণ ভূমি রক্ষা করা খুব জরুরি।’
এ জন্য তিনি কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে জানিয়ে বলেন, ‘কৃষিতে আগাছানাশক ঘাস মারতে হার্বিসাইড প্রয়োগ করার ফলে গরুর ঘাস নষ্ট হচ্ছে। মহিষের দুধও কিন্তু দুধ ঘাটতি মেটাতে একটা বড় উৎস। মহিষের দুধ দিয়ে দুগ্ধজাত অনেক প্রোডাক্ট করা যায়। কিন্তু আমরা ‘দুধ’ বলতে শুধু গরুর দুধ বুঝি। এটা একটা সমস্যা বলে আমি মনে করি।’
তিনি আরো বলেন, ‘ক্ষুদ্র খামারিরা গ্রামের ঘরে ঘরে আছে। তাদের সমস্যার সমাধান মন্ত্রণালয় করতে পারলে দুধের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।’ এ ক্ষেত্রে সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশে দুধের ঘাটতি মেটানো সম্ভব বলেও মনে করেন তিনি।
গবাদিপশু পালনসহ মৎস ও প্রাণিখাত নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের আহ্বান জানিয়ে ফরিদা আখতার বলেন, ‘গবাদিপশু পালনসহ মৎস ও প্রাণিখাত নিয়ে অনেক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। আমি খুঁজে খুঁজে এসব প্রতিবেদন পড়ি। অনুরোধ করবো, সে প্রতিবেদনগুলো যেনো নির্ভরযোগ্য হয়। তথ্য যেনো সঠিক হয়। না হলে বিভ্রান্তিমুলক তথ্য ও সংবাদ প্রান্তিক খামারিদের মধ্যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে।’
তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনগুলোতে প্রান্তিক খামারিদের সংবাদ প্রকাশে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। বলতে গেলে গবাদিপশু পালন, মৎস ও প্রাণিসম্পদ খাত সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে অনেকখানি বৈষম্যের শিকার। অথচ এই প্রান্তিক খামারিদের জন্যই আমরা বেঁচে আছি। আমিষ জাতীয় খাদ্যের যোগান আসে প্রাণি সম্পদ ও মৎস খাত থেকে। তাদের যদি বাঁচিয়ে রাখা না যায়, তাদের উন্নয়নের কথা যদি চিন্তা না করি, তাহলে আমাদের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যাবে।’
সচিব মোস্তফা কামাল বলেন, ‘আমি নিজেই কৃষক পরিবারের সন্তান। এখনও আমার উৎপাদিত ধান থেকেই ভাত খাই। আমার ভাই খামারি। মূলত কৃষি প্রাইভেট সেক্টরেই গড়ে ওঠে। সেজন্য আমি বুঝি একজন কৃষক ও প্রান্তিক খামারির দুঃখ কষ্ট। তারা কত প্রতিকূলতার মধ্যদিয়ে উৎপাদন করেন।’
‘আমাদের উপদেষ্টা মহোদয় নিজেই এ সেক্টর নিয়ে কাজ করেছেন। তার লক্ষ্য হলো প্রান্তিক খামারিদের উপকার করা। খামারিদের কীভাবে উৎপাদন বাড়বে, তারা কীভাবে বাজার ব্যবস্থাপনা করবে এবং কীভাবে তাদের দোড়গোরায় চিকিৎসাসেবা পৌঁছানো যায় আমরা সেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
বন্যা ও দুর্যোগে তাৎক্ষণিক সহযোগিতার কথাও তুলে ধরে মোস্তফা কামাল আরো বলেন, ‘প্রান্তিক খামারিদের সমবায়ভিত্তিক বাজার ব্যবস্থাপনার উপর আমরা জোর দিচ্ছি। ইতোমধ্যে ১১৬টি উপজেলায় সেটা শুরু হয়েছে। আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামেও এই প্রকল্পের কাজ শুরু করবো। সমবায় বাজার পুরোদমে চালু করা গেলে উপজেলাভিত্তিক প্রান্তিক খামারিদের দুধ সেখানেই ন্যয্য মূল্যে বিক্রি করা সম্ভব হবে।’
প্রান্তিক খামারিদের জন্য ঘাসপ্রকল্প এবং ঢাকা শহরের মতো জেলা উপজেলাগুলোতে মাংস প্রসেস জোন করার কথাও বলেন তিনি। বিশেষ করে প্রান্তিক খামারিদের নিরাপত্তায় চুরি ডাকাতি বন্ধে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হবে বলেও জানান সচিব।
এর আগে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার’স এসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল শাহ এমরান বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রান্তিক খামারিরা নিরাপত্তাহীন। যখন তখন রাস্তাঘাটে তাদের গবাধিপশু ছিনতাই হচ্ছে। এ নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন।’
এ বিষয়ে সরকারিভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
এফএলজেএফ-এর সভাপতি এম এ জলিল মুন্না রায়হনের সভাপতিত্বে, সাধারণ সম্পাদক জাহিদ রহমানের সঞ্চালনায় সেমিনারে দেশের ডেইরিখাতের সমস্যা-সম্ভাবনা ও করণীয় শীর্ষক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক বায়েজিদ মুন্সী।
সেমিনারে অংশ নেন মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব এটিএম মোস্তফা কামাল, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হক, পানি সম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ডা. মো. জসিম উদ্দিন, প্রাণি সম্পদের ডিপিডি ডা. হিরন্ময়, প্রান্তিক খামারিদের পক্ষে বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার’স এসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল শাহ এমরান, ফাওজিয়া সুলতানা, গাইবান্ধার জসিম শেখ, কুমিল্লার সজিব, মানিকগঞ্জের লুৎফা পারভিন, ফরিদপুরের শহিদুল ইসলাম, ফেনীর ইয়াসমিন আকতার প্রমুখ।