কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় অংশগ্রহণকারী দেশের তালিকায় এবার বাংলাদেশের নাম না থাকা নিয়ে ভারতের সংবাদমাধ্যমে যে খবর এসেছে, সে সম্পর্কে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক আফসানা বেগম বলছেন, এটি এখন তাদের বিষয়।
রাইজিংবিডি ডটকমকে তিনি বলেছেন, “আমাদের পক্ষ থেকে কোনো সমস্যা নেই। প্রতিবারের মতো এবারও আমাদের প্রকাশকদের নিয়ে আমরা যেতে চেয়েছি। এটি দুই বাংলার সাংস্কৃতিক ও পঠন-পাঠনের ঐতিহ্যের বিষয়। তবে, আয়োজকরা বলছেন, তাদের দেশের সরকারের কথা।”
মেলার আয়োজক সংগঠন বুকসেলার ও পাবলিশার্স গিল্ডের সভাপতি ত্রিদিব কুমার চট্টোপাধ্যায় টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলেছেন, বাংলাদেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তারা সরকারি নির্দেশনা ছাড়া কোনো কথাই বলতে পারছেন না।
“তবে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে,” বলেন তিনি।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনটি প্রকাশ হয়েছে শনিবার (১৬ নভেম্বর)। অবশ্য, তার আগে আরও কয়েকটি ভারতীয় গণমাধ্যম খবর প্রকাশ করে।
ত্রিদিবের বক্তব্য অনুযায়ী, মেলায় বাংলাদেশের অংশ নেওয়া বা না নেওয়ার বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত নয়। অবশ্য, আফসানা বেগম বলছেন, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কিছু করার নেই। আমন্ত্রণ পেলে বাংলাদেশ সেখানে অংশ নিতে পারে।
কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় যদি শেষপর্যন্ত বাংলাদেশ অংশ না নেয়, তাহলে সেটি হবে ২৮ বছরের ঐতিহ্যে এক ছেদরেখা। ১৯৯৬ সাল থেকে মেলাটি হয়ে আসছে।
২০২৫ সালের ২৮ জানুয়ারি থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এবারের বইমেলাটি করা হবে বলে বুকসেলার ও পাবলিশার্স গিল্ডের পক্ষ থেকে ঘোষণা এসেছে।
মেলায় এবার ‘থিম কান্ট্রি’ করা হয়েছে জার্মানিকে। অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ পেয়েছে গ্রেট ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, পেরু, আর্জেন্টিনা, কলম্বিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশ।
এই তালিকায় বাংলাদেশের নাম না থাকা নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবরের বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক আফসানা রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, “আন্তর্জাতিক বইমেলায় অংশগ্রহণ করা বা এ ধরনের মেলা আয়োজন করা জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের অন্যতম কাজ।”
“সে হিসেবে কলকাতা বইমেলায় অংশ নেওয়ার বিষয়ে আমরা যোগাযোগ করি। এই যোগাযোগটি হয়ে থাকে হাইকমিশনের মাধ্যমের। কলকাতায় বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশনের মাধ্যমে তারা আমন্ত্রণ পাঠায় এবং সেই অনুযায়ী আমরা প্রস্তুতি নেই।”
“এবার কোনো চিঠি উপ-হাইকমিশনে এসেছে কি না বা এসে থাকলে সেটি আটকে আছে কি না, সপ্তাহতিনেক আগে আমি খোঁজ নিয়েছিলাম। সেখান থেকে বলা হয়েছে, তাদের কাছে বইমেলায় যোগ দেওয়ার জন্য কোনো পত্র আসেনি,” বলেন তিনি।
বুকসেলার ও পাবলিশার্স গিল্ডের কার্যনির্বাহী সদস্য অপু দে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলেছেন, “প্রতিবেশী দেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির আলোকে শুধু কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এখন দেখা যাক, আগামী দিনে পরিস্থিতি কেমন হয়।”
জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের পরিচালক আফসানা বেগম রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেছেন, “কলকাতা বইমেলার আয়োজকদের সঙ্গে যোগাযোগের আগে বিষয়টি মাননীয় উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকে জানিয়েছিলাম। পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলে কলকাতায় উপ-হাইকমিশনে কথা বলেছি।”
“শুধু তাই নয়, যেহেতু প্রতিবছর মেলাটিতে বাংলাদেশের প্রকাশনা অংশ নেয়, সেই বিবেচনায় গিল্ডের সভাপতি ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমি সরাসরি কথা বলেছি। সর্বশেষ অবস্থা জানতে চেয়ে কয়েকবার ই-মেইল করেছি। তবে, উত্তর আসেনি।”
পরে তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে। তিনি একটি বিষয় বলেছেন, সেটি হলো—ঢাকায় একুশে গ্রন্থমেলায় ভারতের প্রকাশনা রাখা হয় না; অথচ কলকাতায় বাংলাদেশের প্রকাশক-লেখকরা আলাদা জায়গা করে নিয়েছে, বড় বড় স্টল দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণ করে থাকে। ঢাকায় তারা সেই সুযোগ পান না। তাই, তারা মনে করছেন, কলকাতার মেলাতে বাংলাদেশকে রাখা ঠিক হবে না,” যোগ করেন আফসানা।
“আমি ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়কে বলেছি, একুশে গ্রন্থমেলা বাংলাদেশের জাতীয় মেলা, অভ্যন্তরীণ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এতে অংশ নেয়। আমরা আন্তর্জাতিক মেলা করলে অবশ্যই তাদের ডাকব, ভালোভাবেই রাখব।”
রাইজিংবিডি ডটকমকে আফসানা বেগম বলেন, “আমি তাদের এ-ও বলেছি, ঢাকা বইমেলা নামে একটি আন্তর্জাতিক মেলার আয়োজন হতো। সেটি আবার চালু করব আমরা। তখন ভারতের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথেষ্ট সুযোগ দেওয়া হবে।”
“আমি ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়কে আরও বলেছিলাম, বইমেলা, পাঠ বা পড়ার বিষয়কে কূটনীতির সঙ্গে না মেশাই আমরা। দুই বাংলার মানুষের মধ্যে আত্মার সম্পর্ক, আত্মীয়তার সম্পর্ক। এটিকে আমরা ভাগ না করি। তিনিও আমার সঙ্গে একমত হয়েছিলেন। তবে, পরে তাদের কাছ থেকে আর কোনো চিঠি আসেনি, আমরা অপেক্ষায় ছিলাম।”
বিষয়টি পরে সাংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে অবহিত করলে উপদেষ্টা তাকে বলেন, “তারা আমন্ত্রণ না পাঠালে আমাদের চুপ থাকাই শ্রেয়।”
কলকাতা বাংলা বইমেলার সূচি প্রকাশ করা হয় শুক্রবার (১৫ নভেম্বর)। সেখানে কোন দেশ অংশ নিচ্ছে, মেলা কবে থেকে শুরু ও শেষ হচ্ছে; আর কী কী আয়োজন থাকছে—সেসব বিষয়ে বিস্তারিত ঘোষণা দেয় গিল্ডস। সেখানে বাংলাদেশের নাম আসেনি।
আফসানা বেগম বলছেন, “আমরা বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি। আমাদের দেশের অন্তত ১৫টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আগেই কথা বলে রেখেছি। তারা যেতে আগ্রহী বলে জানিয়েছিল। এখন আনন্দবাজারসহ ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশকে অংশগ্রহণকারীর তালিকায় না রাখার খবর দেখছি। এটি আমাদের তরফ থেকে কোনো সমস্যা নয়, পুরোটাই তাদের বিষয়,” বলেন তিনি।
এ বিষয়ে প্রকাশনা ও গ্রন্থবিপণি প্রতিষ্ঠান ‘বাতিঘর’-এর স্বত্বাধিকারী দিপঙ্কর দাসের সঙ্গে রাইজিংবিডি ডটকমের কথা হয়। তিনি বলেন, “জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র থেকে মৌখিকভাবে কলকাতা বইমেলায় যাওয়ার প্রস্তুতির কথা বলা হয়েছিল। আমরা আগ্রহের কথা বলেছিলাম। তবে, আনুষ্ঠানিক কোনো আমন্ত্রণ আসেনি।”
আফসানা বেগম বলেছেন, ‘‘প্রকাশকরা বলেছিলেন, আমন্ত্রণ পেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্রুত ভিসা পাওয়ার বিষয়ে কথা বলতে। এ বিষয়ে আমি মাননীয় উপদেষ্টাদের সঙ্গে কথা বলে রেখেছিলাম।”
ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলেছেন, “সরকারের পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশনা না পাওয়া পর্যন্ত আমরা বাংলাদেশের অংশগ্রহণ সম্পর্কে কিছু বলতে পারছি না।”
এদিকে, এবার ভারতের আরেক রাজ্য ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা বইমেলাতেও রাখা হয়নি বাংলাদেশকে।
এ বিষয়ে আফসানা বেগম বলেন, আগরতলা বইমেলা আয়োজন কমিটির সহসভাপতি সেখানে কর্মরত বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশনার। তার সঙ্গেও কথা হয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, মেলার প্রস্তুতি কমিটির সভাতেও তাকে ডাকা হয়নি।”
এবার ৪৮তম কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা হবে, যেটি শহরের সল্টলেকে বসছে। মমতা ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে বরাবরের মতো এবারও তিনি বইমেলার উদ্বোধন করবেন।
অন্যদিকে, এই প্রথম জার্মানিকে ‘থিম কান্ট্রি’ করার ঘোষণা আসার পর জার্মানির ভাইস কনসাল সাইমন ক্লাইনপাস এবং গ্যেটে ইনস্টিটিউটের পরিচালক অ্যাস্ট্রিড ওয়েগে বলেছেন, জার্মান প্যাভিলিয়নে গুরুত্ব পাবে পরিবেশ সচেতনতা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য। সেটির সাজসজ্জার দায়িত্ব পড়েছে স্থপতি অনুপমা কুণ্ডুর ওপর।
গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক সুধাংশু শেখর দে টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলেছেন, গত বছরের মতো এবারও বইমেলায় ১ হাজার ৫০টি স্টল থাকবে। শৃঙ্খলার স্বার্থে বাড়ানো হচ্ছে না স্টল সংখ্যা।