জাতীয়

অন্তর্বর্তী সরকারের চোখে ১০০ দিনের সাফল্য

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গত ১৫ আগস্ট গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকারের ১০০ দিন পূর্ণ হয়েছে গত ১৫ নভেম্বর। এই সময়ে সরকারের প্রধান প্রধান সাফল্য এবং কাজের অগ্রগতি তুলে ধরেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

তিনি তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে গত শুক্রবার এ বিষয়ে একটি স্ট্যাটাস দেন। সেখানে তিনি সরকারের ১০০ দিনের সাফল্য তুলে ধরার পাশাপাশি কী কী কাজ করা হচ্ছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। এরপর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়।

প্রেস সচিব শফিকুল আলম অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূর্ণ হওয়ার পর প্রধান সাফল্যগুলো তুলে ধরেছেন-

ক্ষমতা গ্রহণের পরপর শৃঙ্খলা ফেরানো

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরানো হলে লাখ লাখ মানুষ মারা যাবে। কিন্তু বাস্তবে একটি প্রবল গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়া পরও তেমন কোনও ঘটনা ঘটেনি। অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সমাজকে সঙ্গে নিয়ে আগস্টের প্রথম কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়। এ সময় পুলিশ কার্যত অনুপস্থিত ছিল। এ সময় সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে সফল হয়েছে।

জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের জন্য জবাবদিহিতা ও ন্যায়বিচার

অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই-আগস্টের গণহত্যার তদন্তে জাতিসংঘ-নেতৃত্বাধীন একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং (তথ্য অনুসন্ধান) মিশনকে আমন্ত্রণ জানায়। এটি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করবে। মিশন আগামী মাসের শুরুতে প্রথম প্রতিবেদন জমা দেবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এ ছাড়া দেশে পুনর্গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করছে। হাসিনা ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। চ্যালেঞ্জ হলো বিচারকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করা, যাতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো এর রায় নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারে—যেমনটা ২০১৩-২০১৬ সালের আইসিটি রায়গুলোর ক্ষেত্রে হয়েছিল।

অন্তর্বর্তী সরকার শহিদ পরিবারের জন্য ৩০ লাখ টাকা অনুদান ঘোষণা করেছে, আহতদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা নিশ্চিত করেছে এবং শহিদ পরিবারের সহায়তায় একটি তহবিল গঠন করেছে।

অর্থনীতি পুনরুদ্ধার

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার সময় অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে ছিল। সরকার ১০০ দিনের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পুনরুদ্ধার হয়েছে। রিজার্ভে হাত না দিয়েই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের আন্তর্জাতিক পেমেন্ট বাধ্যবাধকতা পূরণ করা হয়েছে। রপ্তানি ঘুরে দাঁড়িয়েছে—সেপ্টেম্বরে চালান ৭ শতাংশ এবং অক্টোবরে ২০ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যাংকিং খাত স্থিতিশীল হয়েছে। দেশের সেরা অর্থনীতিবিদদের অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে নিযুক্ত করা হয়েছে এবং তারা প্রশংসনীয় কাজ করেছেন।

সংস্কার রোডম্যাপ

এ পর্যন্ত দশটি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ কমিশনগুলো তাদের প্রতিবেদন ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে জমা দেবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে এই প্রতিবেদনগুলোর ভিত্তিতে ঐক্যমত তৈরি করা হবে। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবে।

সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। নতুন ও গ্রহণযোগ্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এবং নির্বাচন কমিশনারদের খুঁজে বের করতে একটি অনুসন্ধান (সার্চ) কমিটি গঠন করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন গঠনের পর এটি ভোটার তালিকা প্রস্তুতির কাজ শুরু করবে।

ব্যাপকভিত্তিক আন্তর্জাতিক সমর্থন

অধ্যাপক ইউনুস অন্তর্বর্তী সরকার এবং তার সংস্কার উদ্যোগের জন্য প্রায় সব দেশ থেকে নজিরবিহীন সমর্থন পেয়েছেন। নিউ ইয়র্ক ও বাকুতে অনুষ্ঠিত বছরের বৃহত্তম বৈশ্বিক সম্মেলনগুলোতে তাকে একজন ‘রকস্টারের’ মতো সম্মানিত করা হয়েছে। বহুপক্ষীয় ও দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন সংস্থা আট বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিছু জায়গা থেকে ব্যাপক বিভ্রান্তি ছড়ানো হলেও বিশ্ববাসী সবাই সত্যটা জানে এবং সত্য জয়ী হয়েছে।

শূন্য দুর্নীতি

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং এর উপদেষ্টা বা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত দুর্নীতির কোনও উঠেনি।

অস্থিরতা-সংকটে দক্ষ ও শান্তিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা

অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল প্রত্যাশা পূরণ। বিভিন্ন গোষ্ঠী দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছে এবং হঠাৎ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। সরকার এ পর্যন্ত আলোচনার মাধ্যমে বিক্ষোভ মোকাবিলা করেছে। বিক্ষোভ দমন করতে খুব কমই বলপ্রয়োগ করা হয়েছে।

গার্মেন্টস খাতে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিকভাবে সংশ্লিষ্ট কিছু কারখানা মালিক গা-ঢাকা দিয়েছেন, ফলে সরকারকে প্রতিদিনই সংকট মোকাবিলা করতে হয়েছে। তবে সরকার সর্বোচ্চ সংযম দেখিয়ে অস্থিরতার অবসান ঘটিয়েছে। কিছু জায়গায় এখনো সমস্যা রয়ে গেছে, তবে তা রপ্তানি কার্যক্রমে প্রভাব ফেলতে পারেনি।

ভয়াবহ বন্যা ও নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সামাল দেওয়া

অন্তর্বর্তী সরকার কয়েকটি বিধ্বংসী বন্যা এবং মূলত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিয়েছে। আনসার সদস্যদের প্রতিবাদ শান্তিপূর্ণভাবে মোকাবিলা করা হয়েছে, কোনও সমস্যার সৃষ্টি হয়নি। এ ছাড়া, একটি নতুন রোহিঙ্গা সংকট এত নিঃশব্দে সামাল দেওয়া হয়েছে, যে কেউই তা বুঝতে পারেনি।

পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন দিশা

অধ্যাপক ইউনুস বারবার সার্কের পুনরুজ্জীবনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশকে আসিয়ানের সদস্যপদ পাওয়ার জন্য সক্রিয়ভাবে পদক্ষেপ নিতে বলেছেন। তার মতে, বাংলাদেশ ভারতকে বন্ধু হিসেবে চায়, তবে সম্পর্কটি ন্যায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে হতে হবে। রোহিঙ্গাদের তৃতীয় দেশে পুনর্বাসনের কাজ দ্রুততর করা হয়েছে, যা শরণার্থী শিবিরগুলোর ওপর চাপ কমাতে সহায়ক হবে। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে একটি নতুন দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য জাতিসংঘ নেতৃত্বাধীন একটি নতুন সম্মেলনের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ

গত ১০০ দিনে আমাদের সমাজে নজিরবিহীন বিতর্কের সূচনা হয়েছে। মাদ্রাসার ছাত্র থেকে শহুরে অভিজাত, নারীবাদী থেকে দক্ষিণপন্থী—সবাই এই বিতর্কে অংশ নিয়েছে। প্রতিদিন নতুন সেমিনার ও আলোচনার আয়োজন করা হচ্ছে। ইতিহাস নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। চিন্তাভাবনা গভীরভাবে ভাগ করা হচ্ছে এবং আলোচনা করা হচ্ছে। তরুণ তারকারা জাতীয় মঞ্চে তাদের আগমন ঘোষণা করেছে। পুরনো তারকারা নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা টিকিয়ে রাখতে সংগ্রাম করছে।

আগামী ফেব্রুয়ারিতে এমন কিছু সেরা বই দেখা যাবে যেগুলো আমাদের সমাজের কাঠামো নিয়ে গভীর আলোচনার ভিত্তি গড়তে পারে।