আজারবাইজানের বাকুতে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন চলছে। ১১ নভেম্বর শুরু হওয়া এই সম্মেলন ২২ নভেম্বর শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এর সময়সীমা বাড়তে পারে। কিন্তু সম্মেলন ঘিরে ঐক্য দেখা যায়নি। এদিকে ২০৩৫ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য জলবায়ু অর্থায়নের বার্ষিক লক্ষ্য ২৫০ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
জলবায়ু তহবিল নিয়ে বৈশ্বিক চুক্তির একটি প্রস্তাব ঘিরে বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) বিভাজন ও অসন্তোষের বিষয়টি প্রকাশ্যে চলে আসে। নতুন প্রস্তাবে যে বিকল্পের কথা বলা হয়েছে, তা কাউকে খুশি করতে পারেনি।জলবায়ু সুবিচারের জন্য তৃণমূল নেতৃত্ব-ভিত্তিক যুব সংগঠন ইয়ুথনেট গ্লোবাল কপ২৯ সম্মেলনে জলবায়ু অর্থায়নে কোনো বাস্তব অগ্রগতি না হওয়ার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
ইয়ুথনেট গ্লোবাল ও কপ২৯-এ অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশের জলবায়ুকর্মী সোহানুর রহমানের ফেসবুক পোস্টে বলা হয়, ‘‘ইয়ুথনেট নতুন প্রস্তাবিত ২৫০ বিলিয়ন ডলারের বার্ষিক জলবায়ু অর্থায়ন লক্ষ্যকে ‘অত্যন্ত অপর্যাপ্ত’ ও ‘ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রসমূহের জন্য অপমানজনক’ বলে অভিহিত করেছে।’’
ইয়ুথনেট গ্লোবালের নির্বাহী সমন্বয়ক সোহানুর রহমান বলেন, ‘‘কপ২৯ প্রেসিডেন্সির সদ্য প্রকাশিত টেক্সট অনুযায়ী, ২০৩৫ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য জলবায়ু অর্থায়নের বার্ষিক লক্ষ্য ২৫০ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে, ইয়ুথনেট গ্লোবাল মনে করে, এই লক্ষ্য ২০৩৫ সালের মধ্যে প্রয়োজনীয় ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলারের বার্ষিক অর্থায়নের তুলনায় অনেক কম।’’
সোহানুর রহমান বলেন, ‘‘বছরে ২৫০ বিলিয়ন ডলারের এই প্রস্তাব ক্ষতিগ্রস্ত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের মানুষের জন্য এক ধরনের চড় মারার মতো! বাংলাদেশসহ যেসব দেশ ইতিমধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অনুভব করছে, তাদের জন্য এটি অত্যন্ত অসম্মানজনক।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘বহুপক্ষীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এমডিবি) মাধ্যমে সংগৃহীত তহবিল জলবায়ু বিপর্যয়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর সরাসরি সাহায্য প্রাপ্তিতে সহায়ক নয়।’’
আজারবাইজানের বাকুতে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন
কপ২৯-এর আলোচনা আজারবাইজানের বাকুতে চলমান থাকলেও ইয়ুথনেট গ্লোবাল তাদের দাবিতে অবিচল থাকার ঘোষণা দিয়েছে। তারা গ্লোবাল সাউথের জন্য ন্যায্য এবং কার্যকরি জলবায়ু অর্থায়ন কাঠামো প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়ে বলেছে, ‘‘বিশ্বের জলবায়ু সংকটের বাস্তবতা উপলব্ধি করে, সবচেয়ে প্রয়োজনীয় দেশগুলোর সহায়তার জন্য একটি কার্যকরি এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ কাঠামো প্রয়োজন।’’
অর্থায়ন নিয়ে সুবিচার দাবি উন্নয়নশীল দেশগুলোর সম্মেলনের মূল আলোচ্য বিষয়-জলবায়ু অর্থায়ন-নিয়ে বিভক্তি ও মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো উন্নত দেশগুলোর কাছে জলবায়ু তহবিলের প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য চাপ বাড়ালেও সমঝোতা প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতা দেখা যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার জলবায়ু তহবিল নিয়ে প্রস্তাবিত একটি নতুন খসড়া ঘোষণা করা হলে, এটি পুরো সম্মেলনজুড়ে ক্ষোভের সৃষ্টি করে।
বিশ্বব্যাপী ৮০টি জলবায়ু-প্রভাবিত দেশের একটি জোট, যার মধ্যে ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রসমূহ, স্বল্পোন্নত দেশসমূহ (এলডিসি), আফ্রিকান গ্রুপ (এজিএন) এবং ল্যাটিন আমেরিকার স্বাধীন অ্যাসোসিয়েশন (এআইএলএসি) অন্তর্ভুক্ত, বিপুল পরিমাণ অনুদানভিত্তিক একটি তহবিল গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। তাদের ‘রোডম্যাপ টু বেলেম’ পরিকল্পনায় প্রতি বছর ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, যা শিপিং ও অ্যাভিয়েশন খাতে নতুন শুল্ক এবং তেল-গ্যাস ভর্তুকি পুনঃনির্দেশনার মাধ্যমে অর্জন করা হবে।
আজারবাইজানের বাকুতে জলবায়ুকর্মী
প্রতিশ্রুত তহবিল নিয়ে উত্তেজনা বাড়লেও এখনো কোথা থেকে কত অর্থ আসবে এবং কতটা অর্থ প্রাপ্তি হবে- এ ব্যাপারে কোনো সমঝোতা হয়নি।
কপ২৯ এর সভাপতি মুখতার বাবায়েভ শুক্রবার বাকু সময়ে সংশোধিত একটি তহবিল টেক্সট প্রকাশের কথা বলেছেন, যা এই অচলাবস্থা কাটাতে সহায়ক হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে কপ২৯-এর অন্তিম সময়ে সম্মেলন শেষ হওয়ার কথা থাকলেও, চুক্তির কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে আলোচনা অব্যাহত থাকার কারণে তার সময়সীমা বাড়ানো হতে পারে।
আন্তর্জাতিক জলবায়ু নীতি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জলবায়ু তহবিলের জন্য উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে গ্রহণযোগ্য সমঝোতা না হলে, কপ২৯ সম্মেলনটি একটি হারিয়ে যাওয়া সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে ইতিহাসে স্থান পাবে।
বিশ্বের শীর্ষ ২০ অর্থনৈতিক শক্তি, উন্নত দেশগুলো তাদের জলবায়ু তহবিল প্রতিশ্রুতি পূরণে মনোযোগ দিচ্ছে না-এমন অভিযোগ তুলেছেন উন্নয়নশীল দেশগুলোর নেতারা।
কলম্বিয়ার পরিবেশমন্ত্রী সুসানা মুহাম্মাদ বলেন, ‘‘ধনী দেশগুলোকে এখন মানুষের জীবন নিয়ে ভূ-রাজনৈতিক খেলা বন্ধ করতে হবে।’’ তার এই মন্তব্য পুরো সম্মেলনে প্রশংসিত হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান কপ২৯-এর খসড়া টেক্সট ও বৈজ্ঞানিক সমাধানগুলোর মধ্যে অসঙ্গতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘‘যখন বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সমাধানগুলো সহজলভ্য, তখন মার্কেট-বেসড কার্বন ট্রেডিংয়ের দিকে কেন মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে?’’
ইয়ুথনেট গ্লোবালের নির্বাহী সমন্বয়কারী বাংলাদেশি জলবায়ু কর্মী সোহানুর রহমান বলেন, ‘‘জলবায়ু অর্থায়ন দান-খয়রাতের বিষয় নয়। এটা আমাদের ন্যায্য হিস্যা, জলবায়ু সুবিচারের প্রশ্ন। উন্নত দেশগুলোকে ঋণ নয়, অনুদান দিতে হবে। কম অভিযোজন মানে বেশি ক্ষতি। উন্নত দেশগুলোকে তাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে হবে আর বাড়াতে হবে অভিযোজন অর্থায়ন।’’
চুক্তি ঘিরে এখনো বিভাজন, অসন্তোষ জলবায়ু সম্মেলন ঘিরে এখনো কোনো সমঝোতা ও ঐক্য দেখা যায়নি। জলবায়ু তহবিল নিয়ে বৈশ্বিক চুক্তির একটি প্রস্তাব ঘিরে বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) বিভাজন ও অসন্তোষের বিষয়টি প্রকাশ্যে চলে আসে। নতুন প্রস্তাবে যে বিকল্পের কথা বলা হয়েছে, তা কাউকে খুশি করতে পারেনি।
জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ২৯–এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ধনী ও উন্নত দেশগুলো কত অর্থ দিতে সম্মত হবে, তার একটি চুক্তিতে উপনীত হওয়া। এতে উন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবে এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ঠেকানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু বাকুতে ১০ দিন ধরে এ চুক্তির গতি খুব ধীরে এগিয়েছে। এ চুক্তির দর–কষাকষির সর্বশেষ খসড়া যে সময়ে প্রস্তুত হওয়ার কথা, তার চেয়ে দেরিতে তৈরি হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের জলবায়ু কমিশনার ওপকে হোয়েকস্ট্রা বলেন, ‘‘আমাদের কাছে যে নথি আছে, তা ভারসাম্যহীন, কাজের যোগ্য নয় এবং অগ্রহযোগ্য।’’
কপ২৯ এর প্রেসিডেন্টের তরফে এক বিবৃতি দিয়ে খসড়ার পক্ষে অবস্থানের কথা তুলে ধরা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘‘খসড়া প্রস্তাব সংশোধন করে রাতে আবার প্রকাশ করা হবে। এটি আরও সংক্ষেপ করা হবে এবং ঐকমত্য সৃষ্টিতে সেখানে নির্দিষ্ট সংখ্যা বসানো হবে।’’
বাকুতে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নেয় বাংলাদেশ
২০০ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দের প্রস্তাবে সমর্থন জানাতে বাংলাদেশের আহ্বান জলবায়ু সংকটের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) এবং সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য ২০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দের প্রস্তাবে সমর্থন জানাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)-এর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ।
ঢাকায় প্রাপ্ত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানা যায়, শুক্রবার (২২ নভেম্বর) আজারবাইজানের বাকুতে কপ২৯-এর চূড়ান্ত ফলাফলের বিষয়ে এলডিসি মন্ত্রী এবং ইইউ মন্ত্রীদের মধ্যে অনুষ্ঠিত দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে এই আহ্বান জানিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) ও বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য মো. জিয়াউল হক।
বৈঠকে অবশিষ্ট সমস্যাগুলোর সমাধানে উভয়পক্ষের সহযোগিতার মাধ্যমে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও সমতাভিত্তিক চুক্তি অর্জনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
বৈঠকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি বলেন, ‘‘অনেক সমস্যা এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে।’’ তিনি উভয়পক্ষকে একযোগে কাজ করার মাধ্যমে কপ২৯-এ একটি অর্থবহ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক চুক্তি নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।