জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশে আসার ৫২ বছর এবং স্বাধীনতার ৫৩ বছর চলছে। স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সংগঠন থেকে জাতীয় কবিকে যথাযথ মূল্যায়নের দাবি করা হলেও কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়নি। অবশেষে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে গেজেট আকারে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আজ সোমবার (২৫ নভেম্বর) কিংবা চলতি সপ্তাহের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ২৪ মে তৎকালীন সরকারের উদ্যোগে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ভারত থেকে বাংলাদেশে আনা হয়। কবির সঙ্গে তার দুই ছেলে সব্যসাচী ও অনিরুদ্ধ এবং তাদের স্ত্রী-সন্তানদেরও আনা হয়। তারা তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করলে দেশের মানুষ কবি ও তার পরিবারকে সংবর্ধনা দেন। রাজধানীর ধানমন্ডিতে কবির বসবাসের জন্য তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে একটি বাড়ি দেওয়া হয়। বাড়িটির নাম দেওয়া হয় কবি ভবন। সেখানে কবিকে রাখা হয় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়। কবি ভবনে প্রতিদিন জাতীয় পতাকা উড়তো। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে ডি-লিট উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এরপর ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিয়ে সরকারি আদেশ জারি করা হয়। ১৯৭৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কাজী নজরুল ইসলামকে একুশে পদক দেওয়া হয়। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছর এবং কবির মৃত্যুর ৪৮ বছর পেরিয়ে গেলেও জাতীয় কবির রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির বিষয়ে কোনো যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে গেজেট আকারে প্রকাশ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। রোববার সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী অনুমোদন দিয়ে দেওয়ায় আজ (সোমবার) কিংবা চলতি সপ্তাহের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে।
জানা গেছে, জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন আয়োজনে কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে লেখা ও বলা হয়। কবি নজরুলের নামের সঙ্গে জাতীয় কবি ব্যবহার করে সংসদে একটি আইনও পাশ কর হয়। আইনটি হলো- জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০০৬।
অপরদিকে কবি নজরুল ইনস্টিটিউট আইন, ২০১৮। ২০২৮এর ২ ধারায় তাকে জাতীয় কবি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। ধারা ২-এর ৩ উপধারায় বলা হয়েছে- কবি অর্থ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। একইভাবে বিদ্যালয়ের পাঠ্যবইয়ে, অন্যান্য বইপুস্তকে, গবেষণাকর্মে, পত্রপত্রিকায়, সভাসমাবেশে কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি বলেই উল্লেখ করা হয়। এসবই পরোক্ষ স্বীকৃতি ছিল। আর প্রত্যক্ষ স্বীকৃতি দিতে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (বাংলাদেশ ন্যাপ) মহাসচিব এম. গোলাম মোস্তফা ভুঁইয়া বলেন, “বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামের নাম উচ্চারিত হলেও প্রকৃত অর্থে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সরকারের কোনও আনুষ্ঠানিক দলিলপত্রে জাতীয় কবি হিসেবে তার নাম নাই। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ‘জাতীয় কবি’ হিসাবে ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ না করা শাসকগোষ্ঠীর চরম ব্যর্থতা।”
তিনি বলেন, “জাতীয় পর্যায়ে ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন আয়োজনে কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে লেখা হলেও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, জাতীয় আর্কাইভ, নজরুল ইনস্টিটিউট ও বাংলা একাডেমির কোথাও কাজী নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষণা করা সংক্রান্ত সরকারি কোনও প্রজ্ঞাপন বা অন্য কোনও দলিল পাওয়া যায়নি- যা জাতি হিসাবে অত্যন্ত লজ্জাজনক। লোকমুখে প্রচারিত তথ্যের ভিত্তিতে তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি, কাগজে-কলমে প্রাতিষ্ঠানিক ঘোষণার মাধ্যমে নন।”
তিনি বলেন, “বিভিন্ন সরকারি আয়োজনে তাকে জাতীয় কবি হিসেবে উল্লেখও করা হয়। কিন্তু সবই পরোক্ষ স্বীকৃতি। এমন স্বীকৃতি কালের পরিবর্তনে মুছে যেতে পারে। আগামীর প্রজন্ম একদিন হয়তো না-ও জানতে পারে যে, আমাদের জাতীয় কবির নাম কাজী নজরুল ইসলাম।”
কাজী নজরুল ইসলামকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জাতীয় কবি ঘোষণা করে অবিলম্বে গেজেট প্রকাশের দাবি জানান তিনি।
কবি নজরুলের নাতনি খিলখিল কাজী বলেন, “আমরা কবি পরিবার দীর্ঘদিন ধরেই দাবি জানিয়ে আসছে। এটা ঠিক, দেশের মানুষ জাতীয় কবি হিসেবে তাকে সম্মান জানিয়ে আসছে। কিন্তু এটা সরকারি আদেশ হিসেবে আসাটা জরুরি। কারণ আমরা থাকবো না, কিন্তু বাংলাদেশ বেঁচে থাকবে। আগামী প্রজন্ম একদিন হয়তো না-ও জানতে পারে যে, আমাদের জাতীয় কবির নাম কাজী নজরুল ইসলাম। মৌখিকভাবে তিনি জাতীয় কবি হিসেবে পরিচিত হলেও লিখিতভাবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নেই। পরবর্তী প্রজন্মের প্রতিনিধিদের জন্যই কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে গেজেট প্রকাশ করা উচিত।”
তিনি বলেন, “কাজী নজরুল ইসলামের একটি গান জাতীয়ভাবে ব্যবহার করা উচিত। সেটা ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে’ হতে পারে। নজরুল রচনাবলি আমাদের জাতীয় সম্পদ। সেই রচনাবলী অবিলম্বে অনুবাদের মাধ্যমে পৃথিবীর সব ভাষাভাষী মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হোক।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান বলেন, “আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের কবি নজরুলের কবিতা, গান প্রেরণা দিয়েছে। কবি নজরুল আমাদের হৃদয় জুড়ে আছেন। কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে গেজেট আকারে প্রকাশে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া উচিত।”
তিনি বলেন, “বহু মানুষের রক্তের ত্যাগের বিনিময়ে আজকে আমরা এখানে দাঁড়াতে পেরেছি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারছি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে আজীবন এটাই আমাদের চেতনা হওয়া উচিত। আমরা ভয়হীন সংস্কৃতি চর্চা চাই, যেখানে মানুষ নির্ভয়ে কথা বলতে পারবে। নজরুলের রচনাবলি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।”
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব (রুটিন দায়িত্ব) মো. আতাউর রহমানের সাথে যোগাযোগ করলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, “কবি নজরুল ইনস্টিটিউট আইনে কবি নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে গেজেট আকারে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আশাকরি খুব অল্প সময়ের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবি হিসেবে গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে।
উল্লেখ্য, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। গত ২৭ আগস্ট জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৮তম মৃত্যুবার্ষিকী ছিল। ১৯৭৬ সালের ২৭ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (সাবেক পিজি হাসপাতাল) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।