জাতীয়

সচিবালয় হয়ে ওঠে ‘দ্রোহকেন্দ্র’

আরো একটি ক্যালেন্ডারের শেষ মাসের বিদীয় সপ্তাহে এসে বাংলাদেশের দিকে তাকালে দেখা যায় মানচিত্রজুড়ে দ্রোহের চিহ্ন। এই দ্রোহময় দিনলিপিতে বিশেষ স্থানে রয়েছে সচিবালয়। বিভিন্ন দাবি নিয়ে বিক্ষুব্ধ শ্রেণি-পেশার মানুষের নজিরবিহীনভাবে সচিবালয়ে ঢুকে পড়া দেশকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। 

প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ে (দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বা কেপিআই-কী পয়েন্ট ইনস্টলেশন) ভেতরে-বাইরে বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে, যা নিয়ে ভয়-শঙ্কার পাশাপাশি নড়ে যায় রাজনীতির শীর্ষ পর্যায়ও।   ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কয়েক সপ্তাহজুড়ে কর্মদিবস এলেই কোনো না কোনো দাবি নিয়ে সচিবালয়ের ভেতরে-বাইরে জমায়েত করে বিক্ষোভ হতে দেখা গেছে। গত ৮ অগাস্ট অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেওয়ার পর পর তাদের প্রথম কর্মদিবস ১১ অগাস্ট থেকেই প্রথম শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পদোন্নতি, বদলি ঠেকানো, চাকরি স্থায়ীকরণসহ নানা দাবি নিয়ে বিক্ষোভ-মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচি দেখা গেছে। এতে করে সচিবালয়ে কর্মরত কর্মচারী-কর্মকর্তারা ভেতরে প্রবেশ ও বের হতেই হিমশিম খেয়েছেন।

আন্দোলনের শুরু

গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৯ আগস্ট থেকেই ধীরে ধীরে ঘনীভূত হয় সচিবালয়কেন্দ্রিক মিছিল, বিক্ষোভ ও অবরোধ। সচিবালয় একটি কেপিআই অবকাঠামো। তার ভেতরে ৯ আগস্ট থেকে বৈষম্যবিরোধী সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী ব্যানারে নিয়মিত বিক্ষোভ শুরু হয়। তাদের দাবি ছিল, বিগত ১৫ বছর শেখ হাসিনা সরকারের সময় তারা পদোন্নতি বঞ্চতি হয়েছেন, ভোগ করতে পারেননি সুযোগ-সুবিধা।

দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থা পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্বল প্রতিরোধের সুযোগে একজোট হয়ে তারা ভেতরে প্রবেশ করে মিছিল করে। উপদেষ্টা, সচিবসহ অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সচিবালয়ে প্রবেশ ও বের হতে বিপদের মুখে পড়েন। 

নার্স ও মিডওয়াইফ গত ১১ আগস্ট সকাল থেকে সচিবালয়ের পশ্চিম পাশের ফটকে নার্স ও মিডওয়াইফরা অবস্থান নেন। বদলির হয়রানি দূর করা এবং বদলির ক্ষমতা মন্ত্রণালয় থেকে নার্সিং অধিদপ্তরে ফেরত নেওয়ার দাবি ছিল তাদের। সমাবেশের মাঝে সচিবালয়ের ফটকের সামনে বসে চলে খাওয়া-দাওয়া।

তাদের দাবি ছিল, নিয়োগের সময় বলা হয়েছে চাকরিতে যোগ দেওয়ার দুই বছর পর বদলির আবেদনপত্র নার্সিং অধিদপ্তরে জমা দেওয়া যায়। কিন্তু চাকরিতে যোগ দেওয়ার কিছুদিন পর এই ক্ষমতা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ফলে এখন তারা আর ৫/৬ বছরেও বদলির সুযোগ পাননি। এজন্য আন্দোলনে এসেছেন।

প্রতিবন্ধী স্কুলের এমপিওভুক্তির আন্দোলন

প্রতিবন্ধীদের জন্য বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অনুমোদন দেওয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কয়েক হাজার শিক্ষক এমপিওভুক্তির দাবিতে সচিবালয়ের গেটে অবস্থান নেন।

তাদের ভাষ্য ছিল- প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য সারা দেশে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১ হাজার ৭৭২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০১৯ সালে তাদের জন্য একটা বিশেষ নীতিমালা করা হয়। সে অনুযায়ী তারা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিটি স্কুলের পরিদর্শন কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু এগুলোর এমপিও হয়নি, ফলে শিক্ষকরা কোনো বেতন পান না। এই প্রহসন বন্ধ করে ন্যায্য পাওনা বুঝে পেতে আন্দোলনের নামেন তারা। 

গ্রাম পুলিশ বেতন বৈষম্য নিরসন, চাকরি জাতীয়করণসহ চার দফা দাবিতে ১৪ আগস্ট থেকে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেন বেতন বৈষম্যবিরোধী গ্রাম পুলিশ সমন্বয় কমিটি। পুলিশ সদস্যদের মতো রেশন ও পেনশন সুবিধার দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশে গ্রাম পুলিশের সদস্যরা বৈষম্য দূর করে নায্য বেতনের দাবি জানান।

তারা ভাষ্য ছিল- অক্লান্ত পরিশ্রম করে মাসে সাড়ে ছয় হাজার টাকা পান তারা। যেখানে চালের কেজি ৬০ থেকে ৭০ টাকা, সেখানে এই সামান্য বেতন দিয়ে তারা কীভাবে চলবেন। তারা বলেছিলেন, বছরেও এক কেজি গরুর মাংস কিনতে পারেন না তারা। সন্তানদের পড়াশোনা করাতেও কষ্ট হয়। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একপ্রকার মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। 

প্রধান সমন্বয়ক লাল মিয়া বলেন, “আমরা সরকারের দেওয়া পোশাক পরে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা অন্য বাহিনীর মতো দায়িত্ব পালন করি। সাত দিনের মধ্যে আমাদের সব দাবি মানতে হবে।” ২০ আগস্ট স্থানীয় সরকার বিভাগের কাছ থেকে দাবি পূরণের আশ্বাস পেয়ে তারা আন্দোলন থেকে সরে যান।   এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল ও অটো পাস শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে চলমান এইচএসসি ও সমমানের বাকি বিষয়গুলোর পরীক্ষা বাতিল করে অটো পাসের দাবি মেনে নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ২০ আগস্ট বিকেলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. আব্দুর রশিদ দাবি মেনে নেন।

২০ আগস্ট  সকাল থেকে সচিবালয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সামনে জড়ো হন পরীক্ষার্থীরা। দাবি আদায়ে দুপুরের দিকে তারা সচিবালয়ে প্রবেশ করেছিল।

সচিবালয়ে আনসার–শিক্ষার্থী সংঘর্ষ চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে কয়েক দিন ধরে আনসার সদস্যরা রাজপথ অবরোধ করে রাখছিলেন। ২৫ আগস্ট সকাল থেকে তারা সচিবালয় এবং আশপাশের সব ফটকের সামনে অবস্থান নেন। কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ গণমাধ্যমকর্মীরাও ভেতরে ঢুকতে পারেননি। পরে আনসারদের চার সদস্যের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সামনে তাঁদের দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেন। তখন আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেন সমন্বয়ক নাসির মিয়া।

এরপরও সচিবালয় ফটকের অবস্থান নেন আনসার সদস্যরা। একপর্যায়ে তারা কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমকে অবরুদ্ধ করেন তারা।

খবর ছড়িয়ে পড়লে রাত ৯টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। সেখান থেকে লাঠিসোঁটা নিয়ে তাঁরা সচিবালয় অভিমুখে যাত্রা করেন। সচিবালয়ের সামনে আনসার সদস্যদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ বেঁধে যায়। একপর্যায়ে উভয় পক্ষে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। সচিবালয় এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জনতাও যোগ দেয়।

সংঘর্ষ চলাকালে কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দও পাওয়া যায়। এর মধ্যে এক শিক্ষার্থীকে রাস্তায় ফেলে আনসার সদস্যদের মারধর করতে দেখা যায়।  সংঘর্ষে অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন। তাঁদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। আহতদের মধ্যে বেশির ভাগই শিক্ষার্থী। এ ছাড়া আনসার সদস্য এবং সাংবাদিকও রয়েছে।

একপর্যায়ে ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে আনসার সদস্যরা পিছু হটতে বাধ্য হন। ধাওয়া খেয়ে অনেকেই সচিবালয় এলাকা থেকে পালিয়ে যান। এর মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক আনসার সদস্যকে ঘিরে ফেলেন শিক্ষার্থীরা। তারা ইউনিফরম খুলে হাতজোড় করে মাফ চান। পরে সেনাবাহিনী এসে তাঁদের উদ্ধার করে নিয়ে যায়। বিক্ষুব্ধ ছাত্র–জনতাকে সামলানোর  চেষ্টা করেন সেনা সদস্যরা।আধা ঘণ্টার মধ্যে সচিবালয় এলাকা ছাত্র–জনতার নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এ সময় সচিবালয়ের ভেতর আটকে পড়া কর্মকর্তা–কর্মচারী ও দর্শনার্থীদের নিরাপদে বের করে আনা হয়।

সংঘর্ষে আহত এক নারী আনসার সদস্যকে ধরাধরি করে নিয়ে যান সহকর্মীরা।সচিবালয় এলাকায় লাঠিসোঁটা নিয়ে অবস্থান নিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। সচিবালয়ের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়েছে সেনাবাহিনী।

বাংলাদেশ সচিবালয়ের সামনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় দায়ের করা তিন মামলায় গ্রেপ্তারকৃত ১০৯ জন আনসার সদস্যকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়।

এ বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ,সড়ক পরিবহন ও সেতু এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ধান কাটার মৌসুমের মতো এখন দাবি আদায়ের মৌসুম শুরু হয়েছে।

নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় এলে আলাপ করতে রাজি। আমরা ন্যায্য দাবি ও বৈষম্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তবে বৈষম্য বিলোপের জন্য আমাদের সময় দিতে হবে। প্রতিটি দাবির আর্থিক সংশ্লেষ আছে। এতে সরকারের ব্যয় বাড়বে। সরকারের রাজস্ব হঠাৎ করে রাতারাতি বাড়বে না। সরকার কীভাবে এসব দাবি স্বল্পসময়ে পূরণ করবে।