বিদায় ধ্বনি বেজে উঠছে ১৪৩১ বঙ্গাব্দের। দুয়ারে কড়া নাড়ছে নতুন বাংলা বছর। সোমবার (১৪ এপ্রিল) দেশবাসী বরণ করে নেবে বঙ্গাব্দ ১৪৩২। বাঙালির সবচেয়ে অসাম্প্রদায়িক ও সর্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখ ঘিরে রাজধানীসহ সারা দেশে চলছে বিভিন্ন প্রস্তুতি।
নববর্ষ উদযাপন বাঙালি সংস্কৃতির বিশেষ অনুষঙ্গ হয়েছে। দিনটি উদযাপনের জন্য সরকারি-বেসরকারি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন-সংস্থা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। সারা দেশে তাই উৎসবের আমেজে চলছে বাঙালির প্রাণের উৎসবের প্রস্তুতি। এ বছর মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পাল্টে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’ করা হয়েছে।
বাঙালির সর্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখ। পুরোনোকে বিদায় জানিয়ে, নতুন বছর বরণে রাজধানীতে হবে শোভাযাত্রা। এতে ফ্যাসিবাদবিরোধী ও ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে বিভিন্ন মোটিফ থাকবে।
বৈশাখ উদযাপনকে রঙিন করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা অনুষদে জমে উঠেছে বাংলা বর্ষবরণের প্রস্তুতি। পহেলা বৈশাখ উৎসবের রূপ ফুটিয়ে তুলতে শোভাযাত্রার জন্য তৈরি হচ্ছে বর্ণিল মুখোশ, রঙিন মোটিফ আর বিশাল আকৃতির কাঠামো।
বানানো হয়েছে রাজা-রানীর বিশাল মুখোশ, পেঁচা, জাতীয় পশু বাঘ, ইলিশ মাছ, পাখি ও ফুলের রঙিন অবয়ব। এসব কাজে ব্যবহার হচ্ছে বাঁশ-কাঠ এবং কাগজ। এর মাধ্যমে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পাশাপাশি তুলে ধরা হবে গ্রাম বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতি। উঠে আসবে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলা বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবিও। কলা অনুষদের আয়োজনে প্রতিবছরের মতো এবারও বের হবে শোভাযাত্রা। তবে শোভাযাত্রায় পরা যাবে না কোনো ধরনের মুখোশ এবং নিরাপত্তার স্বার্থে সঙ্গে নিতে হবে পরিচয়পত্র।
১৩ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, উৎসবমুখর পরিবেশে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বাংলা নববর্ষ উদযাপনে সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান প্রতিপাদ্য নিয়ে আগামীকাল সকাল ৯টায় চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা বের করা হবে। সকাল ৮টা থেকে শোভাযাত্রার প্রস্তুতি চলবে। শোভাযাত্রাটি চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে শুরু হয়ে শাহবাগ মোড় ঘুরে টিএসসি মোড়, শহীদ মিনার, শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র, দোয়েল চত্বর হয়ে বাংলা একাডেমির সামনের রাস্তা দিয়ে পুনরায় চারুকলা অনুষদে গিয়ে শেষ হবে। শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা শুধু নীলক্ষেত ও পলাশী মোড় দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে পারবেন। শোভাযাত্রা চলাকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য প্রবেশ পথ ও সংলগ্ন সড়ক বন্ধ থাকবে। শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্য রক্ষার্থে আশপাশ দিয়ে শোভাযাত্রায় প্রবেশ করা যাবে না। শেষ প্রান্ত দিয়ে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণের জন্য সকলের প্রতি অনুরোধ জানানো যাচ্ছে। নিরাপত্তার স্বার্থে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের নিজ নিজ পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখার জন্য অনুরোধ করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুদিনের ঐতিহ্য ও স্বকীয়তা অব্যাহত রেখে অধিকতর অন্তর্ভুক্তিমূলক করার জন্য লোক-ঐতিহ্য ও ২৪-এর চেতনাকে ধারণ করে আরো বড় পরিসরে এবং বৈচিত্র্যপূর্ণভাবে এ বছর শোভাযাত্রায় সর্বজনীন অংশগ্রহণের আয়োজন করা হয়েছে। শোভাযাত্রায় এ বছর ২৮টি জাতিগোষ্ঠী, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বিভিন্ন দেশের অতিথিবৃন্দ অংশ নেবেন। এই বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রায় এ বছর থাকবে ৭টি বড় মোটিফ, ৭টি মাঝারি মোটিফ এবং ৭টি ছোট মোটিফ।
পয়লা বৈশাখে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোনো ধরনের মুখোশ পরা এবং ব্যাগ বহন করা যাবে না। তবে চারুকলা অনুষদ থেকে প্রস্তুতকৃত মুখোশ হাতে নিয়ে প্রদর্শন করা যাবে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ভুভুজিলা বাঁশি বাজানো ও বিক্রি করা থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।
বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা চলাকালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশের জন্য ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের সম্মুখস্থ রাজু ভাস্কর্যের পেছনের গেইট, চারুকলা অনুষদ সম্মুখস্থ ছবির হাটের গেইট এবং বাংলা একাডেমির সম্মুখস্থ রমনা কালী মন্দির সংলগ্ন গেইট বন্ধ থাকবে। ক্যাম্পাসে নববর্ষে সব ধরনের অনুষ্ঠান আগামীকাল বিকেল ৫টার মধ্যে শেষ করতে হবে। নববর্ষের দিন ক্যাম্পাসে বিকাল ৫টা পর্যন্ত প্রবেশ করা যাবে। ৫টার পর কোনোভাবেই প্রবেশ করা যাবে না, শুধু বের হওয়া যাবে।
নববর্ষ উপলক্ষে আজ (১৩ এপ্রিল) সন্ধ্যা ৭টার পর ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিকারযুক্ত গাড়ি ছাড়া অন্য কোনো গাড়ি প্রবেশ করতে পারবে না। নববর্ষের দিন ক্যাম্পাসে কোন ধরনের যানবাহন চালানো যাবে না এবং মোটরসাইকেল চালানো সম্পূর্ণ নিষেধ। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বসবাসরত কোনো ব্যক্তি নিজস্ব গাড়ি নিয়ে যাতায়াতের জন্য শুধু নীলক্ষেত মোড় সংলগ্ন গেইট ও পলাশী মোড় সংলগ্ন গেইট ব্যবহার করতে পারবেন। নববর্ষ উপলক্ষে নিরাপত্তার স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পর্যাপ্ত সিসি ক্যামেরা ও আর্চওয়ে স্থাপনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
এদিকে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) ও জাতীয় প্রেসক্লাবে বর্ষবরণ উদযাপনের আয়োজন চলছে। নববর্ষের এই আয়োজন সকাল সাড়ে ৯টায় শুরু হয়ে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলবে।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) সদস্যদের জন্য মুড়ি-মোয়া, নকুলদানা, মুড়কি, মুড়ালি, কদমা ও বাতাসার আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়াও বাউল সঙ্গীত এবং ডিআরইউ সদস্য ও সন্তানদের সঙ্গীত পরিবেশনা করা হবে। সদস্যদের জন্য সাদা ভাত, ডিম, মুরগী/মাছ, বেগুন ভাজি, শুটকি ভর্তা, সবজি ও আম ডালের আয়োজন করা হয়েছে।
বাংলা নববর্ষ-১৪৩২ উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আজহারুল ইসলাম বলেন, আমরা মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন করিনি, বরং আসল আনন্দ শোভাযাত্রা নামটি পুনরুদ্ধার করেছি। ১৯৮৯ সালের প্রথম শোভাযাত্রায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে আনন্দ শোভাযাত্রা নামটি গৃহীত হয়েছিল। পরে যখন এর নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হয়, সেই পরিবর্তন একইরকম স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে ঘটেনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের (ঢাবির) উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, আমরা শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন করছি না। তবে পুরোনো নাম ও ঐতিহ্যে ফেরত যাচ্ছি, যেটা দিয়ে চারুকলার এই কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্যে দুটো বার্তা রয়েছে। একটি হচ্ছে, নিবর্তনমূলক স্বৈরাচারী ব্যবস্থার অবসান। রাজনৈতিক ও সামাজিক নিবর্তনমূলক স্বৈরাচারী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মানুষের যে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ, সেই বিষয়টি তুলে ধরা। কিছু মোটিভ সেই কাজটি করছে। আর দ্বিতীয় যে অংশটি আছে, সেটি হচ্ছে মূলত ঐক্যের ডাক, সম্প্রীতির ডাক। জুলাই অভ্যুত্থানে ঘটে যাওয়া ফ্যাসিবাদদের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ এবারের উদ্যাপনে তুলে ধরা হবে।
এদিকে পহেলা বৈশাখ শান্তিপূর্ণভাবে উদযাপনে সারা দেশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। দেশবাসী কাল উৎসবমুখর ও শান্তিপূর্ণভাবে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ উদযাপন করবে। পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান ঘিরে ঢাকাসহ সারাদেশে কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করছে র্যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যে কোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ প্রস্তুত রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
রমনা বটমূল, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, টিএসসি, শাহবাগ, রবীন্দ্র সরোবর, মানিক মিয়া এভিনিউ, হাতিরঝিলসহ যেসব জায়গায় জনসমাগম হবে সেখানে র্যাব ও পুলিশের পর্যাপ্ত সদস্য মোতায়েন থাকবে।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের মহাপরিচালক (ডিজি) এ কে এম শহিদুর রহমান বলেন, পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান ঘিরে ঢাকাসহ সারা দেশে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। যে কোনো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সতর্ক অবস্থানে থাকবে র্যাব। নিরাপত্তার বিষয়ে কোনো ঝুঁকি নেই বলেও জানান তিনি।
এদিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) শেখ মো. সাজ্জাদ আলী বলেছেন, পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানকে ঘিরে ঢাকায় ১৮ হাজার পুলিশ মোতায়েন থাকবে। ঢাকাকে ২১টি বিভাগে ভাগ করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মিডিয়া এনামুল হক সাগর বলেছেন, পহেলা বৈশাখ শান্তিপূর্ণ ও আনন্দময়ভাবে উদযাপনে আমরা ইতোমধ্যেই দেশব্যাপী নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিটি স্থানকে সমান গুরুত্ব দিয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। পহেলা বৈশাখ উদযাপনে কোনো নিরাপত্তা হুমকি নেই। তবে, আমরা সতর্ক আছি।
গত ১২ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে ট্রাফিক নির্দেশনা দিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। এতে বলা হয়, ডাইভারশন/ব্যারিকেড পয়েন্টসমূহ: সোমবার (১৪ এপ্রিল) ভোর ৫টা হতে রমনা পার্ক (রমনা বটমূল), সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও আশপাশের নিম্নলিখিত এলাকাসমূহে সড়কে যানচলাচল নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে রাস্তা বন্ধ/রোড ডাইভারশন দেওয়া হবে:
১। বাংলামোটর ক্রসিং/নেভি গ্যাপ ২। পুলিশ ভবন ক্রসিং ৩। সুগন্ধা ক্রসিং ৪। কাকরাইল চার্চ ক্রসিং ৫। কদম ফোয়ারা ক্রসিং ৬। হাইকোর্ট ক্রসিং (পূর্ব ও দক্ষিণ) ৭। দোয়েল চত্বর ক্রসিং ৮। রোমানা ক্রসিং ৯। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টার ১০। জগন্নাথ হল ক্রসিং ১১। ভাস্কর্য ক্রসিং ১২। নীলক্ষেত ক্রসিং ও ১৩। কাঁটাবন ক্রসিং।
গাড়ি চলাচলের দিকনির্দেশনা
রমনা পার্ক (রমনা বটমূল), সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ডাইভারশন পয়েন্টসমূহ ব্যতীত নিম্নলিখিত রাস্তাসমূহে যানবাহন চলাচল করবে। যানবাহন চলাচলের রাস্তাসমূহ নিম্নরূপ :
১। মিরপুর-ফার্মগেট হতে শাহবাগ অভিমুখী যাত্রীবাহী যানবাহন বাংলামোটর ক্রসিং বামে মোড় নিয়ে মগবাজার ক্রসিং হয়ে গন্তব্যে পৌঁছাবে। ২। গোলাপশাহ মাজার ক্রসিং-হাইকোর্ট ক্রসিং হতে শাহবাগ অভিমুখী যাত্রীবাহী যানবাহন কদম ফোয়ারা ক্রসিং-ইউবিএল ক্রসিং- নাইটিংগেল ক্রসিং হয়ে গন্তব্যে পৌঁছাবে। ৩। সায়েন্সল্যাব ক্রসিং হতে শাহবাগ অভিমুখী যাত্রীবাহী যানবাহন মিরপুর রোড দিয়ে আজিমপুর ক্রসিং-চাঁনখারপুল ক্রসিং-বকশীবাজার ক্রসিং হয়ে গন্তব্যে পৌঁছাবে।