শিল্প ও সাহিত্য

নার্গিসকে লেখা নজরুলের পত্র

ড. তানভীর আহমেদ সিডনী : নজরুলের পত্রাবলি দেখতে দেখতে একটি চিঠিতে চোখ আটকে যায়। নার্গিসকে লেখা এই চিঠিটি তাঁদের বিয়ের সেই রাতের পনেরো বছর পর লেখা হয়। কবি চিঠিটি লিখেছেন, ১৯৩৭ সালের ১ জুলাই কলকাতার গ্রামোফোন কোম্পানির মহড়াকক্ষে বসে। চিঠি পাঠ করতে করতে চেনা নজরুলকে যেমন মিলিয়ে নেওয়া যায়, একইসঙ্গে নজরুলের পত্রসাহিত্যের নন্দনতত্ত্বও পাঠকের চোখে উদ্ভাসিত হয়।১৩২৮ সনের ৩রা আষাঢ় কবির বিয়ের দিন ধার্য হয়। যতদূর জানা যায় বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয় কিন্তু কাবিনের শর্ত উল্লেখ করার সময়ই ঝামেলা বাঁধে। আলী আকবর খান শর্ত জুড়ে দিতে চান, নজরুলকে ঘর জামাই থাকতে হবে। বাঁধন হারা নজরুল এই শর্ত প্রত্যাখ্যান করেন। আকদ্‌ হয়ে যাবার পর আনুষ্ঠানিক অন্যান্য কাজে যখন সবাই ব্যস্ত তখন নজরুল অন্তর্দ্বন্দ্বে বিক্ষুব্ধ। অপমানে, লজ্জায় তিনি সেই রাতেই দৌলতপুর থেকে কুমিল্লা চলে আসেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন বিরজা সুন্দরী দেবীর ছেলে বীরেন্দ্রকুমার। নজরুলের জীবনে নার্গিস পর্ব সেখানেই শেষ। ভাগ্যিস কবি ঘটনাটা ঘটিয়েছিলেন, তা না হলে বাংলা সাহিত্যের একটি পর্ব নিশ্চিতভাবেই অন্ধকার থাকতো। পুস্তক ব্যবসায়ীর পরিবারে বিয়ে করে ফরমায়েসি লেখা লিখে জীবনের বাকি সময়টুকু কাটাতেন কবি। এতে হয়তো বিত্ত মিলতো কিন্তু চিন্তন মিলতো না।কবির চিঠিতে গভীর প্রেমের চিহ্ন পাওয়া যায়। প্রথমেই কালিদাস রচিত মেঘদূতের প্রসঙ্গ তুলে লেখা শুরু করেন বিদ্রোহী কবি : ‘আষাঢ়ের নব মেঘপুঞ্জকে আমার নমস্কার। এই মেঘদূত বিরহী যক্ষের বাণী বহন করে নিয়ে গিয়েছিল কালিদাসের যুগে রেবা নদীর তীরে, মালবিকার দেশে তাঁর প্রিয়ার কাছে। এই মেঘপুঞ্জের আশীর্বাণী আমার জীবনে এনে দেয় চরম বেদনার সঞ্চয়।’এখানে এক প্রেমিক পুরুষের সঙ্গে পরিচয় ঘটে আমাদের, যে তার দয়িতার কথা মনে রেখেছে। তাকে পনেরো বছর আগে রেখে এসেছিল দৌলতপুরে। মনের গহনে বেঁচে আছে সে মেয়েটি।কবির এভাবে চলে আসা নিয়ে নার্গিসের ক্ষোভ ছিল, তবে তা প্রেমজাত- এ কথা ভুললে চলবে না। নার্গিসের প্রতি কবির কোনো ক্ষোভ কিংবা জিঘাংসা ছিল না। সেটাও তিনি জানিয়ে দিয়েছেন পত্রে। তবে যে বিষয়টি পত্র পাঠকের জন্যে ভিন্ন এক পর্ব হিসেবে দেখা দেয় তা হলো, কবি লিখেন : ‘আমার অন্তর্যামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা! কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি- তা দিয়ে তোমায় কোনোদিন দগ্ধ করতে চাইনি।’কবি বিরহ বেদনায় নিজেই ক্ষতাক্ত হয়েছেন। এ যেন তার একার বেদনা আর কারো আশ্রয় নেই। কেউ পাবে না ঠাঁই এখানে। একা একা বহন করে চলেছেন বেদনার ঝাঁপি। নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের দেখা-সাক্ষাৎ কেমন হতো তাঁর একটি রূপও পাওয়া যায় চিঠিতে। এই চিঠি থেকেই জানা যায় যে, নার্গিসের সঙ্গে তাঁর খুব বেশি অন্তরঙ্গতা হয়নি। তিনি নার্গিসকে লেখেন যে অনেক সাধনার পর তিনি ললাট ধরতে পেরেছিলেন। একই সঙ্গে পনেরো বছর পরও তার স্মরণে আছে যে একটি মেয়ের কপালে হাত দিয়ে তপ্ত অনুভূতি পেয়েছিলেন। কবির চোখে সে সময় যে জল নেমেছিল সে সংবাদও আমাদের গোচরে আসে। কাল পরিক্রমায় পনেরো বছর কম সময় নয়। এখানে চিঠি লেখার সময় ও স্থান বিবেচনা করতে হবে। মহড়া কক্ষে বসে তিনি চিঠির জবাব তৈরি করছেন। স্মৃতি প্রবল না হলে এই স্থানে পুরোনো দিনের কথা মনে আসবে না।পনেরো বছর বুকের গহীনে স্মৃতি বহন করে চলেছেন কবি। তাঁর এই ভালোবাসার চিহ্ন পাওয়া যায় ‘চক্রবাক’ কাব্যগ্রন্থে। যেখানে কবি লিখেছেন :‘সুন্দর কঠিন তুমি পরশ-পাথরতোমার পরশ লভি হইনু সুন্দর।’কবির মনে বেঁচে থাকে দৌলতপুরের প্রেম। কবি ভুলতে পারেন না নার্গিসকে। এখানে একটি কথা না লিখলেই নয়, ব্যক্তিত্বের কারণে নজরুল সেদিন বিয়ে বাড়ি থেকে চলে এসেছিলেন। কিন্তু তাঁর বুকের গহীনে বেঁচে আছে যে প্রেম তাকে অস্বীকার করবেন কোন শক্তিতে? তাইতো তিনি চিঠিতে জানিয়ে দেন- ‘তোমার যে কল্যাণ-রূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথমে দেখেছিলাম, সে রূপ আজো স্বর্গের পারিজাত-মন্দারের মতো চির-অম্লান হয়েই আছে আমার বক্ষে।’এখানে এসে এক প্রেমিকের সাক্ষাৎ ঘটে যে তার প্রেম সযতনে লালন করেছেন। যেখানে কাম নেই, প্রাপ্তির সম্ভাবনা নেই। সে চাওয়াও নেই। তিনি তো প্রেমাস্পদকে লিখেই দিয়েছেন- তাকে বারণ করার অধিকারহীন কবি তিনি।কবি রক্তমাংসের মানুষের বাইরে খুঁজতে চেয়েছেন তাকে। তাই পার্থিব জগতের বাইরে যেতে বলেছেন নার্গিসকে। তাদের ভালোবাসা যদি সত্য হয় তাহলে তা টিকে থাকবে। প্রেমকে তিনি স্থাপন করেছেন মিথের শরীরে। সে সূত্রে লিখেছেন : ‘তুমি যদি সত্যই আমায় ভালোবাসো, আমাকে চাও, ওখান থেকেই আমাকে পাবে। লায়লী মজনুকে পায়নি, তবু তাদের মতো করে কেউ কারো প্রিয়তমকে পায়নি।’অসামান্য ভালোবাসার ছবি আকা হয় এই চিঠিতে। একই সঙ্গে কবির প্রার্থনা, যেখানেই প্রেমিকা থাক সেখানেই যেন সুখী হয় সে। কোনো হিংসা নেই, রাগ নেই, আছে শুধু ভালোবাসা। এটা জানিয়ে দিতেও শংকা নেই তার- ‘তোমার বিরুদ্ধে আজ আমার কোনো অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই, দাবিও নেই।’কবি জীবনের ভুলগুলো শুধরে নিতে বলেন নার্গিসকে। হয়তো কবির মনের ভেতরে যে শোক বহমান তাও তিনি দমন করেন এই উক্তির মাধ্যমে। বলে রাখা ভালো যে, এই চিঠি একজন কবির চিঠি- সে কথাও ভুলতে দেন না তিনি। তাই তাঁর সরল উক্তি। কবি বলেই তিনি আঘাত করেন ফুল দিয়ে, বর্বর কাপুরুষের আঘাত তার আঘাত নয়। নজরুল ভেতরে ভেতরে তার কবিত্বকে কেমন করে ধারণ করতেন তারও পরিচয় পাওয়া চিঠির এই উক্তির মধ্য দিয়ে।নার্গিসের জন্য তিনি যে বেদনার্ত হয়েছেন তার সরল স্বীকারোক্তি আছে। এই বেদনা তিনি রূপান্তরিত করেছেন ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যে। তিনি বেদনার শক্তিকে রূপান্তরিত করেছেন কাব্যের অবয়বে।‘প্রিয় মোর প্রিয় মোরই অপরাধকেন জেগেছিল এত আশা সাধ।’এই আশা আর সাধের পথেই নজরুল বাংলা সাহিত্যকে ঋদ্ধ করেছেন। দ্রোহের উচ্চারণে তিনি জাগাতে চেয়েছেন বাঙালিকে আর প্রেমের স্রোতধারায় বাংলার প্রকৃতিকে অন্বিষ্ট করেছেন। নার্গিস অধ্যায় একইসঙ্গে রহস্যময়তা আর প্রেমের যুগল মন্থনে বাঙালির শিল্প অভিজ্ঞতায় প্রবহমান থাকবে। রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ মে ২০১৫/তাপস রায়