খান মো. শাহনেওয়াজ : কাষ্ঠল ও পোক্ত কাণ্ড হওয়া সত্বেও অপরকে আশ্রয় করে লতিয়ে বেড়ে উঠে তাক লাগিয়ে দেয় সোনাঝুরি। তাই বাগানি ও বৃক্ষপ্রেমিদের মন ভরাতে আর বাড়ির আঙিনা ও ভবনের সৌন্দর্য বাড়াতে এর জুড়ি নেই। এটি মূলত লতা গাছ এবং এর নাম সোনাঝুরি লতা। একে কমলা সুন্দরীও বলা হয়। বহু শাখাযুক্ত, বহুপত্রী ও গাঢ় সবুজ। ফুল ফোটার প্রথমদিকে হয় হালকা কমলা রঙের এবং ধীরে ধীরে গাঢ় ও উজ্জ্বল লালচে-কমলা রঙ ধারণ করে। উজ্জ্বল অথচ কোমল ও মিষ্টি রঙ সহজেই নজর কেড়ে নেয়, চোখ জুড়িয়ে দেয়, অসাধারণ আবেদন তৈরি করে। সোনাঝুরি ফুল তিন ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। থোকা ধরে ফোঁটে। ঝুলন্ত মঞ্জরির ফুল নল আকৃতির। একটি থোকায় সাধারণত ১৫ থেকে ২০টি ফুল থাকে। পরাগধানী ছোট টিউবের মত এবং ফুল থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। ফুলের থোকা বেশির ভাগ আনত হয়ে ঝুলে থাকে। ঝাঁকড়া গাছ থোকা থোকা ফুলে ছেয়ে যায়। আমাদের দেশে শীতের শুরুতে ফুল আসে এবং বর্ষাকাল পর্যন্ত ফুল ফোটে। গাছ অত্যন্ত দর্শনীয় হওয়ায় এবং ফুলের আকৃতি ও রঙ অত্যন্ত মনোরম হওয়ায় সোনাঝুরি লতা বাড়ির আঙিনায় ও ভবনের সীমানা দেয়ালে সহজেই স্থান করে নেয়। রাজধানী ঢাকার অভিজাত আবাসিক এলাকায় চোখের সামনেই মেলে এই গাছ। বিশেষ করে ধানমন্ডি এলাকায় পুরোনো অনেক বাড়িতে আছে সোনাঝুরি লতা। রমনা গ্রিনে, মিরপুরে চিড়িয়াখানায় এবং তার পাশেই বোটানিক্যাল গার্ডেনে সোনাঝুরির দেখা পাওয়া যায়। বিভিন্ন শহরে দৃষ্টিনন্দন ভবনকে আরও দৃষ্টিনন্দন করে রেখেছে এই গাছ। এমনকি গ্রামেও ধনাঢ্যদের বাড়িতে আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে শোভা পায় সোনাঝুরি লতা। এই লতার গোড়ার দিকে কাণ্ডের ব্যাস দেড় ইঞ্চি বা তারও বেশি হয়ে থাকে। কাণ্ড কাঠ কাঠ অর্থাৎ কাষ্ঠল এবং নমনীয়। এই উদ্ভিদ বাঁচে বহুবছর। কাণ্ড গোড়া থেকেই আঙুলের চেয়ে বেশি মোটা ও কাষ্ঠল হয়ে বৃদ্ধি পায় এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে মোটা হতে থাকে। পরাশ্রয়ী হয়ে লতিয়ে ওঠে ও অনেক বড় হয় এবং ৭৫ মিটার পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে। এ ধরণের মোটা কাণ্ডযুক্ত লতানো গাছকে ইংরেজিতে বলা হয় উডি ক্লাইম্বার (Woody Climber)। আরো বলা হয় লিয়ানা (Liana)। এই গাছ তার আশ্রয়কে অবলম্বন করে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। বাড়ির বেড়া, সীমানা প্রাচীর, অন্য কোন গাছ বা ভবনের দেয়ালকে অবলম্বন করে দ্রুত বেড়ে ওঠে। পাতা এক পক্ষল যৌগিক ও অভিমুখি। পাতা হয় দুই থেকে তিনটি পত্রক যুক্ত। অনেক ক্ষেত্রে মাঝের পত্রক শীর্ষ ভাগে তিন অংশে বিভক্ত আকর্ষে পরিণত হয়। পত্রক ডিম্বাকার, মসৃণ ও চার থেকে সাত সেন্টিমিটার লম্বা। এরা দ্রুত বর্ধণশীল। গাঢ় সবুজ পাতা ও থোকা থোকা ফুলে ছেয়ে ফেলে প্রাচীর, পুরো ফটক বা আঙিনা। ছেঁটে না দিলে জঙ্গল তৈরি করে। সুন্দর করে ছেঁটে গাছকে দৃষ্টিনন্দন আকৃতি দেয়া যায়।
সোনাঝুরি ফুল (ছবি: ফ্লাওয়ার্স অব বেঙ্গল)
সোনাঝুরি লতার ইংরেজি নাম ফ্লেম ভাইন (flame vine), অরেঞ্জ ট্রাম্পেট ক্রিপার (orange trumpet creeper), গোল্ডেন শাওয়ার (golden shower)। পাইরোস্টেজিয়া (Pyrostegia) গণের এই উদ্ভিদ বাইগনোনিয়াসিয়েই (Bignoniaceae) পরিবারভুক্ত। এর বৈজ্ঞানিক নাম পাইরোস্টেজিয়া ভেনুসতা ( Pyrostegia Venusta)। আদি নিবাস দক্ষিণ আমেরিকায়, বিশেষত ব্রাজিলে আমাজন অববাহিকায়। পরবর্তী সময়ে এটি ল্যাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সোনাঝুরি লতা সূর্যালোকে এমনকি ছায়াযুক্ত স্থানেও বেড়ে ওঠে। অধিক উষ্ণ ও অতিরিক্ত শীতল উভয় পরিবেশে, আর্দ্র বা শুষ্ক উভয় আবহাওয়ায় এরা বেঁচে থাকতে সক্ষম। বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হলে গোড়ায় নতুন কুশি গজিয়ে ওঠে। পরিচর্যার প্রয়োজন তেমন পড়ে না। এ কারণে বাগানের শোভা বর্ধনকারী গাছ হিসেবে এটি ব্যাপক জনপ্রিয়। সারা বিশ্বেই এ গাছের কদর রয়েছে এবং অনেক দেশে এর বাণিজ্যিক চাষ হয়। বাংলাদেশেও সোনাঝুরি লতা বেশ সমাদৃত। নার্সারিগুলোতে কমলা সুন্দরী নামে এর চারা বিক্রি হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকায় ফুলার রোডে অবস্থিত ব্রিটিশ কাউন্সিল প্রাঙ্গনে এই গাছ সারাবছরই সবুজ ছড়িয়ে যায়। সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও চট্টগ্রামে চা বাগানে বাংলো ও সীমানা বেড়ায় সোনাঝুরি লতা প্রচুর দেখা যায়। রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ জানুয়ারি ২০১৭/শাহনেওয়াজ