গোলাপ সৌন্দর্যের প্রতীক। বছরের প্রথম দিন এমন সুন্দর দেখে শুরু করা- সৌভাগ্য বটে!
উৎসবের সঙ্গী গোলাপ। এই ফুল পছন্দ করেন না এমন মানুষ হয়তো খুঁজেই পাওয়া যাবে না। জন্মদিন, বিয়ে, গাঁয়ে হলুদ সব কিছুতেই ফুল অপরিহার্য। ফুলের দোকানে লাল, হলুদ, সাদা, গোলাপীসহ নানা রঙের ফুল খুঁজি আমরা। কোথা থেকে আসে এই ফুল? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগেই যদি ফুলের বাগানটিই দেখতে পান চোখের সামনে- কেমন লাগবে?
ওপরে নীল আকাশ। নিচে শত শত হেক্টর জমিতে গ্রামের পর গ্রাম লাল-সাদা ফুল। যতদূর চোখ যায়, শুধু গোলাপ আর গোলাপ। আহ্! কী দারুণ ব্যাপার। ভাবতেই কেমন স্বপ্নময়তায় ভরে যায় মন।
এরকম দৃশ্য দেখতে যেতে পারেন ঢাকার অদূরে সাভারের সাদুল্লাহপুর, শ্যামপুর, কমলাপুর, বাগ্মীবাড়ি ও মোস্তাপাড়া গ্রামে। গ্রামগুলো এখন ‘গোলাপ গ্রাম’ নামে পরিচিত।
এই গোলাপ গ্রাম থেকেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ফুল সরবরাহ হয়। জানা যায়, গ্রামগুলো একসময় ভাওয়াল রাজার অধীন ছিল। এখান গ্রামজুড়ে গোলাপের সমারোহ। যেদিকে চোখ যায় সারি সারি গোলাপ বাগান। প্রায় ৫০ থেকে ৬০ বছর আগে এখানে প্রথম গোলাপ ফুলের চাষ শুরু হয়। বাণিজ্যিকভাবে চাষ শুরু হয় ১৯৯০ সালের শুরুর দিকে।
ফুল সংগ্রহে ব্যস্ত ফুল চাষি
শ্যামপুরের ফুল চাষি এখলাস পালোয়ান। প্রায় ২০ বছর ধরে চাষ করছেন। তিনি জানান, এসব গ্রামে বেশির ভাগ মানুষই ফুল চাষের সঙ্গে যুক্ত। ফুল চাষ দিয়েই চলে সংসার। সবচেয়ে বেশি চাষ হয় বিরুলিয়ার মোস্তাপাড়া, সামাইর ও শ্যামপুরে। ফলন আর চাহিদা ভালো হওয়ায় দিনে দিনে বাড়ছে চাষিদের সংখ্যা।
এখলাস পালোয়ান আরো জানান প্রায় ৩০ বছর ধরে তার বাবা ফুল চাষ করছেন। চাষ করে বছরে লাভ হয় ৩-৪ লাখ টাকা। খরচ হয় ৫-৬ লাখ টাকা। এখলাসের পরিবারে সদস্য মোট ৮ জন। দুই ভাই এবং বাবা ফুল চাষের সঙ্গে জড়িত। প্রায় ৫ একর জমিতে ফুল চাষ করে তারা এখন স্বাবলম্বী।
১২০ শতাংশ জমিতে ফুল চাষ করেন ৬০ বছর বয়সি চাষি আব্দুল খালেক। তিনি জানান, গাছগুলোতে বছরজুড়ে ফুল হয়। তাই শাক-শবজি চাষ না করে ফুল চাষ করা লাভজনক। খরচ বাদে যা লাভ হয় তা দিয়ে স্বাচ্ছন্দে চলে যায় সংসার।
শ্যামপুর গ্রামে প্রতি সন্ধ্যায় বসে গোলাপের হাট। স্থানীয় আবুল কাশেম মার্কেটের সামনে সন্ধ্যায় শুরু হয় ফুল ব্যবসায়ীদের আনাগোনা। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য ব্যবসায়ী এসে ভিড় জমান এই হাটে। জমতে থাকে বেচাকেনা। চলে গভীর রাত পর্যন্ত। এছাড়া মোস্তাপাড়ায় রয়েছে ‘সাপু মার্কেট’। এই মার্কেটেও গোলাপ বেচাকেনা হয় দেদার। গোলাপের চাহিদা থাকে বছরজুড়ে। এছাড়াও বিশেষ উৎসবের দিনগুলোতে চাহিদা বেড়ে যায় বহুগুণ। তাই চাষিরাও সারাবছর ব্যস্ত থাকেন। চাষিদের একমাত্র ভরসা এখন এই গোলাপ ফুল।
নাটোরের মধ্যবয়সি ভদ্রলোক সাজেদুর রহমান। পেশায় জেলা জজ। গোলাপ গ্রাম দেখতে এসেছিলেন সেদিন বিকেলে। সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী এবং দুই সন্তান। সাজেদুর রহমান বলেন, ‘অনেক দিন ধরে ভাবছিলাম গোলাপ গ্রাম দেখতে আসব। কিন্তু ব্যস্ততায় হয়ে ওঠেনি। এখানে এসে ভালো লেগেছে। বেশি ভালো লাগছে ফুল চাষিদের পরিশ্রম দেখে। আমরা যে বাসায় বসে ফুল পাই এই কৃতিত্ব তাদের। তারা বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় ফুল চাষ করছেন। চারদিকে ফুল আর ফুল। অসাধারণ লাগছে দেখতে! এটা খুবই দারুণ ব্যাপার যে এই ফুল চাষ করেই চাষিরা এলাকায় স্বাবলম্বী হয়েছেন।’
পরিবার নিয়ে বেড়াতে এসেছেন দুই বোন
মেটলাইফ সাভার শাখার কর্মকর্তা রিনি রেজা। সময় কাটাতে এসেছিলেন পরিবার নিয়ে। রিনি রেজা বলেন, ‘এই প্রথম এলাম এখানে। ফুলের চাষ আরো বেশি হওয়া উচিৎ। তাহলে আমরা আরো কম দামে ফুল পাব। কৃষক উপকৃত হবেন। এক্ষেত্রে যদি সরকারি সহায়তার দরকার হয় সেটিও চিন্তা করতে পারেন কর্তৃপক্ষ।’
বিরুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মোহাম্মদ আলিম বলেন, ‘এই অঞ্চলে গোলাপ ফুলের চাষ যারা প্রথম শুরু করেছিলেন তাদের মধ্যে আমাদের পরিবারও আছে। সাদুল্লাহপুর, শ্যামপুর, কমলাপুর, বাগ্মীবাড়ি ও মোস্তাপাড়া গ্রামের বিস্তির্ণ ২৫০ হেক্টর জমিরও বেশি জমিতে গোলাপ চাষ হয়। এখানকার মানুষের আয়ের প্রধান উৎস গোলাপ ফুল চাষ। সরকারি সহায়তা পেলে ফুলের চাষ বৃদ্ধি পাবে। লাভবান হবেন কৃষক। ফুলের গায়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। এতে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হন। উপজেলা কৃষি অফিসে আমরা একবার যোগাযোগ করেছিলাম। তারা এসেছিলেন। কিন্তু এরপর আর কোনো তৎপড়তা চোখে পড়েনি।’
ফুল চাষের সঙ্গে জড়িত অন্যান্য স্থানীয়রা বলছেন, গ্রামগুলোতে প্রতিদিন বিরুলিয়ার বাজারসহ পার্শ্ববর্তী বাজারগুলোতে প্রায় আড়াই থেকে তিন লাখ টাকার ফুল বিক্রি হয়। সরকারি সহায়তা পেলে আরো বেশি ফুল বিক্রি হতো বাজারগুলোতে। ফুল রপ্তানি হতো আরো বেগবান।
প্রতিদিন শত শত মানুষ ভিড় করেন গোলাপ গ্রামে। মানুষের ভিড় সামলাতে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে মাঠে কর্মরত কৃষকদের। ভিড় সামলাতে না পেরে কোথাও তারা ব্যানারে লিখে রেখেছেন: ‘বিনা অনুমতিতে বাগানে প্রবেশ করা সম্পূর্ণ নিষেধ। অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করিলে ৫০০ টাকা জরিমানা দিতে হবে। নির্দেশক্রমে: বাগানের মালিক পক্ষ।’
কীভাবে যাবেন এই সমধুর-স্নিগ্ধ গোলাপ গ্রামে? ঢাকার যেকোনো জায়গা থেকে চলে যাবেন গাবতলী। গাবতলী থেকে যেকোনো বাসে সাভার বাসস্ট্যান্ডের ওভার ব্রিজের নিচে নামবেন। এরপর ব্রিজ পাড় হয়ে পূর্ব দিকের বিরুলিয়া ইউনিয়নের রাস্তায় চলতে দেখা যাবে ব্যাটারিচালিত ‘হ্যালো বাইক’। এই গাড়িতে করে ৩-৪ কিলোমিটার পথ গেলেই পৌঁছে যাবেন স্বপ্নময় গোলাপ গ্রামে।
ঢাকা/তারা