রাত-দিনের বেশিরভাগ সময়ই রেল স্টেশনে কাটে রাজার। মাঝে মধ্যে পাশের বস্তিতে যায়। সেখানে এক বৃদ্ধাকে নানি ডাকে সে। রক্তের কোনো সম্পর্ক না এটা। বৃদ্ধার নাকি রাজার মতো একটা নাতনি ছিলো। তবে তার ছেলে তাকে একা রেখে বউ-বাচ্চা নিয়ে বিদেশে থাকে। খোঁজ-খবরও নেয়না তার। রাজাকে দেখলে নাকি তার নাতনির কথা মনে পড়ে। তাই অনেক স্নেহ করে রাজাকে। এ জন্যে মন চাইলেই বৃদ্ধার সঙ্গে দেখা করতে যায় রাজা। ওই বৃদ্ধা রাজার নাম রেখেছেন মানিক। অবশ্য নামটা ভালোই লাগে ওর। এই পৃথিবীতে আপন বলতে যে রাজার কেউ নেই। এই নানি আর স্টেশনে থাকা কুকুরগুলোই তার কাছে সব।
রাজা নিজেকে কুকুরগুলোর সরদার ভাবে। ও যখন স্টেশনে যায় তখন তার চারিদিকে কুকুরগুলো গোল হয়ে বসে। রাজা ওদের পাউরুটি খাওয়ায়। তাই বোধ হয় ওর প্রতি কুকুরগুলোর এতো ভক্তি। কাছে পেলেই ওর গাল চেটে দেয়। নানান অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে একটা ভক্তির ভাব প্রকাশ করে কুকুরগুলো। রাজা তার মা-বাবাকে কখনো দেখেনি। ছোটবেলা থেকেই সে স্টেশনে থাকে। যখন ওর একটু বুদ্ধি হয়, তখন থেকে এভাবেই দিন কাটছে তার।
রাজার বয়স চৌদ্দ-পনেরো বছর হবে। অবশ্য ওকে ছোটবেলায় যে বুড়িটা মানুষ করেছেন তিনি বছরখানেক হলো গত হয়েছেন। রাজা পেটের জন্য যখন যে কাজ পায় সে কাজই করে। তবে ও অনেকটা ভবঘুরে টাইপের। যেখানে ভালো লাগে সেখানে চলে যায়। কিছুদিন ঘুরে আবার সেই চিরচেনা স্টেশনে ফিরে আসে। অবশ্য এতে তাকে অসুবিধায় পড়তে হয়। ওর শিস্য কুকুরগুলো অনেক নালিশ করে। এতো দিন সে কোথায় ছিলো, কেন তাদের আদর করেনি, কেন ওদের জন্য খাবার নিয়ে আসেনি- এসব আরকি!
রাজা একটু মুচকি হেসে ওদের আদর করে দেয়। তাতেই ওরা আবার আগের মতো হয়ে যায়। রাজা হয়তো কুকুরগুলোর ভাষা বুঝতে পারে। বেশ কয়েকদিন এখানে সেখানে ঘুরে গতরাতে ফিরেছে সে। মন চাইলো নানির সঙ্গে দেখা করবে। গিয়ে দেখলো মাস খানেক আগে সে যেই গোলাপ ফুলের গাছটা লাগিয়েছিলো সেটাতে ফুল ফুটেছে। বেশ সুন্দর লাগছে অবশ্য। রাতে স্টেশনে ফিরলো। রাত বারোটার দিকে দেখলো একটি বাচ্চা মেয়ে বয়স হয়তো পাঁচ-ছয় বছর হবে। বসে কান্না করছে। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে মেয়েটি বললো সে বাবা-মার কাছে যাবে। সে নাকি হারিয়ে গেছে। রাজা বললো আমি তোর মা-বাবাকে খুঁজে দেবো, কাঁদিস না।
মেয়েটিকে রাজকুমারী বলে ডাকে ও। এতোদিন তার কেউ ছিলো না। এখন একটা বোন হয়েছে। তাকে ভালো রাখতে হবে। এই নিয়ে যেন তার হাজারো ব্যস্ততা।কিভাবে রাজকুমারীকে ভালো রাখা যায়। কিছু খাবার ছিলো। সেগুলো খাওয়ালো মেয়েটিকে। তারপর কুকুরগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো। গান শুনিয়ে বোনকে ঘুমিয়ে দিলো রাজা। পরেরদিন খোঁজ করে কোনো সন্ধান পেল না রাজকুমারীর মা-বাবার।
এভাবে মাস খানেক পার হলো। রাজকুমারীকে সবসময় সঙ্গেই রাখে রাজা। যেখানেই যায়, ওকে নিয়ে যায়। মাত্র কয়েকদিনে অনেক আপন হয়ে গেছে দুজন।রাজকুমারীর মুখে ভাই ডাকটা শুনতে ভালোই লাগে রাজার। ভবঘুরে স্বভাবটা এখন আর নেই রাজার। কারণ এখন যে তার একটা বোন আছে। তিনবেলা ওকে খাবার খাওয়াতে হবে। তার জন্য কাজ-কর্মও করা লাগবে।
একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে অন্য এক অভিজ্ঞতা অর্জন করলো রাজা। একজন মহিলা ও পুরুষ দাড়িয়ে আছে। সঙ্গে পুলিশও আছে। তারা নাকি রাজকুমারীর মা-বাবা। ওকে নিতে এসেছে। রাজার বুকটা অজানা কোনো কারণে কেঁপে উঠলো। অসহ্য এক যন্ত্রনা অনুভব করতে লাগলো। রাজকুমারীকে যেতে দিতে ইচ্ছে করছে না ওর। কিন্তু রাজকুমারীতো ওর আপন কেউ না। আবার সে কি পর কেউ?
জানতে পারলো ওর নাম মিম। দূর্ঘটনা বশত স্টেশনে সে হারিয়ে গেছিলো সে। অনেক খোঁজ করেও ওকে পাওয়া যায়নি। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিলো ওর বাবা। গতকাল তাকে একজন লোক ফোন দিয়েছিলো। বলেছিলো স্টেশনে আছে উনার মেয়ে। খোঁজ পেয়ে এখানে এসেছেন। যাওয়ার সময় গলাধরে অনেক কেঁদেছে রাজকুমারী। যত দূরে যাচ্ছে ততই দুচোখ বেয়ে পানি ঝরছে রাজার।
রক্তের সম্পর্কের বাইরেও যে মানুষের সম্পর্ক হয়, নিঃস্বার্থভাবে কাউকে ভালোবাসা যায় কিংবা অচেনা একটা মেয়েকে নিজের ছোট বোন ভাবা যায়, তা আজ বুঝতে পারছে রাজা। আর হয়তো কখনো বোনের সঙ্গে ওর দেখা হবে না। ওর কান্না দেখে কুকুরগুলোও কাঁদছে। এ যে মায়ার বাঁধন।
লেখক: শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়