কলেজের ভেতর তারা খানিকক্ষণ হৈ-হুল্লোড় করল, রিকির টাকায় অনলাইনে অর্ডার দিয়ে পিৎজ্জা আনিয়ে খেল, তারপর যার যার মতো বাসায় চলে গেল সন্ধ্যায় রিকির জন্মদিনের পার্টিতে দারুণ মেতে উঠবে বলে। রিকি বাইরে এসে দেখল গাঢ় কমলা রঙের রোদে ভেসে যাচ্ছে শহর। যানজটে থেমে আছে সব গাড়ি। খানিকটা দূরে পার্ক করা ওদের গাড়িটা। ডাকলেও এখন ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে আসতে পারবে না।
কলেজের গেটের ডানপাশে বড় ডাস্টবিনটা তছনছ করছে একটা ছেলে। পরনে কালকুষ্টি জামা-প্যান্ট। রিকির দিকে চোখ পড়তেই হলুদ দাঁতে হাসল। ‘নাম কী রে?’ ‘বল্টু।’ ‘স্ক্রু-নাট-বল্টু?’ সময় বয়ে গেল। ছেলেটা আবার হাসল। ‘ওখানে কী করছিস?’ ‘খাওন তালাশ করি।’ ‘পাওয়া যায়?’ ‘হ।’ ‘কী পাস?’ ‘বাসি পাউরুটি, আধা সিংগারা, শসা, পঁচা তরমুজ, কাঁঠালের ভুচড়া।’ ‘থাকিস কোথায়?’
নিস্তব্ধতা। হু হু করে বাতাস বয়ে যায়। মাটির ওপরে কাগজের টুকরো ভেসে বেড়াচ্ছে। ‘কমলাপুর বস্তিতে।’ ‘বাবা-মা আছে?’ ‘মইরা গেছে।’ ‘ভাই-বোন?’ ‘নাই। আমি একলা।’ ‘কী করিস?’ ‘কাগজ টুকাই, এস্টেশনে কুলির কাম করি, ভিক্ষা করি।’ ‘আজ যাসনি?’ ‘না।’ ‘কেন?’ ‘ভাল্লাগতাছে না।’ ‘আজ খাবি কী?’ ‘কুড়াইয়া যা পাই।’ ‘পেলি কিছু?’ ‘না, আইজ মনে লয় পাওন যাইব না।’ ‘তাহলে খাবি কী?’
নীরবতা। আকাশে মেঘ জমেছে বলে এখন এখানে ছায়া। যানজট ছেড়েছে। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। ‘না খায়া থাকুম। পানি খামু।’ ‘না খেয়ে থাকা যায়?’ ‘কতো দিন থাহি।’
রিকি মোবাইল ফোনে ড্রাইভারকে ডাকল। হুস করে কালো একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। ‘বল্টু গাড়িতে ওঠ।’ সময় বয়ে যায়। বল্টু দূরে তাকাল। ওদিকটাতে কমলাপুর বস্তি। ‘আগে ওঠ না।’ ড্রাইভার হাঁ হয়ে গেল। গাড়ি চলতে লাগল। ঠান্ডায় কাঁপতে লাগলো বল্টু। ‘ড্রাইভার সাহেব এসি কমিয়ে দিন।’ ‘বল্টু তোর জামাকাপড়গুলো খুব নোংরা। ধুয়ে নিতে পারিস না?’ ‘সাবান নাই।’ ‘আর কোনো জামাকাপড় নেই?’ ‘না।’ ‘আচ্ছা ঠিক আছে, চল কিনে দেব।’
গাড়ি গুলশান এসে পড়েছে। রোদের তেজ বেড়েছে। আকাশে মেঘের দেখা নেই। এখানে হালকা যানজট। গ্যানিস অ্যান্ড গ্যানিস আউটফিটের সামনে গাড়ি দাঁড় করাতে বলল রিকি। বল্টুকে নিয়ে চিলড্রেন সেকশনে ঢুকল। 'জামা-প্যান্ট, গেঞ্জি-জুতো-মোজা যা খুশি নে।’ বল্টু দাঁড়িয়ে রইল। কিছু বলল না। কোনো কিছু পছন্দও করতে পারল না। রিকি পছন্দ করে সব কিছু কিনে দিলো। ওরা বেরিয়ে এলো। গাড়ি পিৎজ্জা হাটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ওরা ঢুকল। রিকি বার্গার আর কোল্ড-ড্রিঙ্কসের অর্ডার দিলো। বল্টুর চোখে পানি। খেতে পারছিল না। ‘কাঁদছিস কেন?’
নিস্তব্ধতা। রিকি পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। সাদা পানি, লেবু মেশান। একটু মিষ্টি মিষ্টি। বল্টু পানি খেয়ে বার্গারে কামড় দিলো। এবার খেতে পারল।
‘আপনে খাইবেন না?’ ‘নারে, পেট ভরা। কলেজে এক গাদা পিৎজ্জা খেয়েছি। পিৎজ্জা খেয়েছিস কখনো?’ ‘না।’ ‘খাবি? এখানে পাওয়া যায়।’ ‘না। প্যাট ভইরা গেছে।’ ‘পেট ভরলে কী করে হবে, বাসায় গিয়ে ভাত খেতে হবে না?’ ‘আবার ভাত?’ ‘হ্যাঁ।’
চুকচুক করে বল্টুকে কোক খেতে দেখে রিকি হাসল। নীরবতা। রিকি গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। হঠাৎ একটা গানের লাইন মনে পড়ল- এই মানুষেই সেই মানুষ আছে। এই কথাটার মানে কী? তার মোবাইল ফোন বেজে উঠল। ‘এত দেরি করছিস কেন, জ্যাম আছে নাকি রাস্তায়?’- রিকির মা। ‘এসে গেছি প্রায়, এক নম্বরে আছি।’ ‘আয়। টেবিল রেডি করতে বলি।’ ‘ঠিক আছে মম, আমার সঙ্গে একজন খুদে গেস্ট আছে।’ ‘কে আবার, আগে বলিসনি তো? স্পেশাল কিছু করতে বলব বাবুরচি কে?’ ‘না, দরকার নেই মম।’
সময় বয়ে গেল। এ এলাকায় আগে কখনো আসেনি বল্টু। ভালো লাগল। দেখতে লাগল। ওই ফাঁকে গাড়ি পৌঁছে গেল রিকিদের বাসায়। বিরাট বাড়ি। দুই পাশে বাগান। মাঝখান দিয়ে রাস্তা। নানান রকমের ফুল ফুটে আছে। উরদি পরা দারোয়ান দৌড়ে এসে দরজা খুলে দিলো। ছোটো সাহেবের সঙ্গে বস্তির ছেলে দেখে সেও অবাক হলো। ‘বল্টু আয়।’
বল্টু গাড়ি থেকে নেমে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। ওর জামাকাপড়ের প্যাকেট নামিয়ে নিলো একজন। বাগানের শেষ মাথায় এ- বাড়ির কর্মচারীদের থাকবার বন্দোবস্ত। সবুজ ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে ওরা ছোট একটা ঘরের সামনে এলো। খুট করে তালা খুলল দারোয়ান। ‘এ ঘরে সব আছে। বিছানা, চেয়ার, টেবিল, আলনা, আয়না। অ্যাটাস বাথ। গোসল করে নে। পুরনো জামা কাপড় ছেড়ে নতুনগুলো পর। তোর শেষ হলে ডাকিস ওদের। এক সঙ্গে খাব। এই ফাঁকে আমিও গোসল করে নেই।’
নিস্তবদ্ধতা। বল্টু ভাবল- আল্লায় আমারে কুথায় লইয়া আইল। জানালা খুলে দিলো। মাথার ওপরে আম গাছে পাখিরা হুল্লোড় করছে। কোথাও কোনো শব্দ নেই। উদোম হয়ে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে গেল। অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামলে গান গেয়ে উঠল। ফেনা করে সাবান মাখল সারা গায়ে। আহা কী সোন্দর বাসনা!
দারোয়ান এসে খেতে ডাকল। ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলো। বিশাল ডাইনিং-এ ঝালরবাতির ঝলক দেখে অবাক হলো। দিনের বেলাতেও জ্বলছে। একদম খিদে নেই বল্টুর। ‘আয় বোস। ইনি আমার মা, ও আমার ছোটবোন।’ রিকি পরিচয় করিয়ে দিলো। নীরবতা। কী বলবে বুঝতে না পেরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। রিকির মা খুব সুন্দরী। একটু মোটাও। ‘হোয়াট প্রমটেড ইউ টু ব্রিং হিম হিয়ার রিকি?’ ‘এমনি মম। হি উইল অ্যাটেন্ড মাই বার্থডে পার্টি টু নাইট।’ ওদের সঙ্গে বসতে লজ্জা পাচ্ছিল বল্টু। রিকির বোন বলল, ‘দাঁড়িয়ে রইলে কেন, বোসো।’ নীরবতা। বল্টু তবুও দাঁড়িয়ে রইল। রিকি ওর হাত ধরে পাশে এনে বসাল। প্লেটে ভাত-তরকারি তুলে দিলো। বল্টু বসে বসে প্লেটের ভাত নাড়াচাড়া করছিল। ‘খাচ্ছিস না কেন?’ ‘খিদা নাই।’ ‘যা পারিস খা না। আচ্ছা তোর জন্মদিন কবে জানিস?’ ‘এদের আবার জন্মদিন! অবান্তর প্রশ্ন কোরো নাতো রিকি।’ রিকির মায়ের গলাটা গমগমে। বল্টু বলল, ‘১২ এপ্রিল, ২০০৮।’ রিকির মা নড়েচড়ে বসলেন। বড় একটা হাসেন না। এই বেলা হাসলেন। ‘কেমন করে জানলে?’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি। ‘মায় কইছিল।আমারে ডাস্টবিন থিকা কুড়াইয়া আনছিল হে। আমার হাতের মইদ্দে একখান কাগজে লেহা আছিল। এক সাহেবে পইড়া কইছিল মায়রে। মায় কইছিল মনে রাহিস, বড় অইলে লাগবার পারে। অহনতুরি কেউ জিগায় নাই।’ রিকির মা চমকে উঠলেন। রিকির বোন বিড় বিড় করে বলল, ‘আ বাসটার্ড চাইল্ড...’ ‘আজ কত তারিখ জানিস বল্টু? ১২ এপ্রিল। তোর বয়স ১০ হলো। আজ তোর জন্মদিন। অভিনন্দন।’
রিকির মা ছেলেটির দিকে তাকালেন। তার চোখ সরু হয়ে এল। গোলাপি গাল ফ্যাকাশে। নাকের ঠিক ওপরে বড় একটা ভাজ পড়ল। আই উইল অ্যারেঞ্জ আ জয়েন্ট সেলিব্রেশন টু নাইট। রিকি মনে মনে ভাবল। ‘এদিকে এসো।’ রিকির মা বল্টুকে ডাকলেন। বল্টু ভয় পেল একটু। মনে দ্বিধা। ‘যা না ভয় কী!’ রিকি বলল। রিকির মা ওর হাত দুটি ধরলেন, তারপর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। পলক পড়ে না। সময় বয়ে গেল।
‘ভাইয়া মম কী করছে রে?’ ‘দেখতেই তো পাচ্ছিস।’ ‘অবাক কান্ড না?’ ‘কেন? অ্যা স্ট্রিট আরচিন। তার ওপর আবার বাসটার্ড চাইল্ড। মম ইজ ইমোশনাল। মায়া হচ্ছে। জানিস জয়েন্টলি জন্মদিন পালন করব ওর, আমার সঙ্গে।’‘ রিকির মা বললেন, ‘আমি ওর জন্মদিনের ড্রেস কিনে দেব।’ ‘ড্রেস তো আমি কিনে দিয়েছি মম।’ ‘সে তো তুই দিয়েছিস। আমি দেব, আমার পছন্দ মতো।’
রিকির মা বল্টুকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ছেলেটা পুতুলের মতো হেঁটে হেঁটে তার পেছন পেছন গেল। এত কিছুর ভেতরও আমোদ পাচ্ছে না। রিকির মা তাকে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। জামা-জুতো পরিয়ে শরীরে মেখে দিলেন নানান সুগন্ধি। দুই গাল আর কপালে চুমু দিয়ে নিয়ে গেলেন স্টেজে যেখানে ব্যাকগ্রাউন্ডে লেখা- হ্যাপি বার্থডে টু রিকি অ্যান্ড বল্টু (আ বয় ফ্রম কমলাপুর স্লাম।) স্টেজে রিকির পাশে বসে বসে অস্বস্তিতে ভুগতে লাগল বল্টু। স্লামবয়ের সঙ্গে যৌথভাবে জন্মদিন পালন করছে বলে সবাই রিকির খুব প্রশংসা করছে। বল্টুর সঙ্গে স্লামবয় কথাটা উচ্চারণের সময় ঘোষক বলছে- বল্টু দ্য স্লাম বয়য়য়য়য়...। শুনতে শুনতে এক সময় বল্টু রিকিকে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাইয়া ছিলাম বয় কী?’ রিকি বিব্রত হেসে বলল, ‘ওই যে তুই বস্তিতে থাকিস না, তাই বলছে আরকি।’ বল্টু ভাবল, এ জন্যেই তার এত আদর!
তারপর খুব গানটান হলো। নাচ হলো। হুল্লোড় হলো। বড়রা হুইস্কি, ব্র্যান্ডি, জিন, ভোদকা, টাকিলা আর খুব বিয়ার খেল। ছোটরা পান করল কোক, স্প্রাইট, ফানটা। বু্ফে ডিনারে ৫০ আইটেমের খাবার এল। সবাই নিয়ে নিয়ে খাচ্ছিল। রিকির মা বল্টুকে এনে দিলেন। নিজে খেলেন, চামচে তুলে বল্টুকে খাওয়ালেন। উৎসব শেষে সবাই চলে গেল। ক্লান্ত হয়ে বল্টু ঘুমিয়ে পড়ল। সারা রাত মাকে স্বপ্ন দেখল। মা বলল, আহারে বল্টু আল্লায় তরে কহানে লইয়া গেছে। ওই সোন্দর মাইয়া লোকটা তরে ক্যান এত আদর কোরতাসে জানস তুই? বল্টু বলল, জানি না। মা বলল, আমি জানি। বল্টু শোনার জন্য আকুল হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। তখনই ঘুম ভেঙে গেল তার।
সকালে নাস্তা খাওয়ার সময় রিকি বলল, ‘এবার বুঝলি তো জন্মদিন কাকে বলে?’ বল্টু হাসল।সবাই হাসল। রিকির বাবা বললেন, ‘যা-ই বলিস না কেন, ওকে কিন্তু একদম স্লামবয় বলে মনে হয় না।’ সবাই একমত হলো। রিকির মা বললেন, ‘তোমাকে একটা কথা বলব বল্টু? আমাদের এখানে থেকে যাও।’ সে মাথা নিচু করে বসে রইল। অনেকক্ষণ পরে বলল, ‘না।’ সবাই অবাক হলো। রিকির বাবা বললেন, ‘নদীর মাছ কেন অ্যাকোয়ারিমে তুলতে চাইছ?’ বল্টু বলল, ‘ভাইজান আমারে বস্তিতে দিয়া আসেন।’ ‘চিন্তা করিস নে, আমি তোকে রেখে আসব।’ বিদায়ের সময় রিকির মা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বল্টুও কাঁদল। রিকি ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘মমের কথাটা শুনলেই পারতিস বল্টু, তাহলে এত কষ্ট করে রোজ রোজ ডাস্টবিন থেকে খাবার টাবার...।’