খবরটি কয়েকদিন আগের। তবে আশার আলো ছড়ানো এ খবর আমাদের কিছুটা সাহসী, উদ্যোগী এবং স্বপ্নের পথে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণীত করে। খবরটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের। আইএমএফ ২০২০ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক’ নামক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ভারতকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। চলতি বছর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ, ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমবে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ। আর এতেই ভারতজুড়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলেও, বাংলাদেশ পুরোপুরি নীরব। ভারতের অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের সঙ্গে আলোচনায় যুক্ত হয়েছেন জনপ্রিয় ইউটিউবার, রাজনীতিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট, গবেষক ও মুক্ত মনের মানুষগুলো।
সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি রাহুল গান্ধী টুইট করে বিজেপির কড়া সমালোচনা করে বলেছেন, ‘গত ৬ বছরে বিজেপির ঘৃণা ছড়ানোর জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতির দুর্দান্ত সাফল্য হলো, বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়ে যেতে চলেছে।’ তবে ভারতের জনপ্রিয় ইউটিউবারদের বিশ্লেষণ অনেকের নজর কেড়েছে। অসাধারণ উপস্থাপন, তথ্য-উপাত্ত নিয়ে বিতর্ক-বিশ্লেষণ ব্যক্তিগতভাবে আমাকে মুগ্ধ করেছে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীনতা অর্জনে সহযোগিতা করেছে- পঞ্চাশ বছর পর এমন সুখের ঢেকুর আর আত্ম-অহমিকা দেখানো বন্ধ করে বরং মোদি সরকার শেখ হাসিনার কাছ থেকে শিক্ষা নিক- এমন পরামর্শ দিয়েছেন ভারতের বিশ্লেষণধর্মী ইউটিউবারগণ। তারা বলার চেষ্টা করেছেন- বাংলাদেশে দুর্নীতি হচ্ছে, ধর্ষণ হচ্ছে, গণতন্ত্র নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে নানা কথা শোনা যায়, তারপরও শেখ হাসিনা কী করে মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাবেও দেশের অর্থনীতি সঠিক পর্যায়ে রেখেছেন এবং কী ধরনের নেতৃত্বের কৌশলে আজ ভারতকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে? বিষয়গুলো শেখার পরমার্শ দিয়ে মোদিকে তারা বাংলাদেশের দিকে ঘুরে তাকাতে বলেছেন।
আবার শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অদম্য বিশ্বাসে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ- এমন খবর মূলত ভারতই আমাদের বেশি করে জানিয়েছে। ১৫ অক্টোবর ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’র সম্পাদকীয় নিবন্ধের শিরোনাম: ‘ভারত, পূর্ব দিকে তাকাও : বাংলাদেশ ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে পেছনে ফেলে দিচ্ছে। আমাদের (ভারতের) জন্যও শিক্ষণীয়।’ (১৪ অক্টোবর) ‘আনন্দবাজার’-এর শিরোনাম ছিল: ‘পড়ছে ভারত! মাথাপিছু উৎপাদনে ‘আচ্ছে দিন’ যাচ্ছে বাংলাদেশের।’
আমরা যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, বাংলাদেশ নিয়ে কোথাও কোনো ভালো খবর শুনলে আমাদের আবেগ-ভালোবাসা ধরে রাখা ও নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এখনো সেই দূর থেকে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সংগীত কানে ভেসে এলে আমরা একদিকে যেমন আবেগে আপ্লুত হয়ে যাই, অন্যদিকে আরো উদ্যোমী হয়ে পড়ি, আত্মবিশ্বাস নিয়ে কর্মপন্থা ঠিক করি। কারণ, আমাদের অর্জনগুলো ঐতিহাসিক, ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাসও গণশ্রম বা পারিশ্রমিক মনোবলের বৃত্তিতে সৃষ্ট। অন্যদিকে ‘দ্য প্রিন্ট’-এর প্রধান সম্পাদক খ্যাতিমান সাংবাদিক শেখর গুপ্ত ১৫ অক্টোবর এক অনুষ্ঠানে বলেছেন: ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক’-এর চলতি অর্থ বছরের প্রতিবেদন ভারতের অর্থনীতির অ্যাকিলিস হিল বা সবচেয়ে দুর্বল স্থান চিহ্নিত করে দিয়েছে। এ সংস্থার আয়না ভারতের জন্য বড়ই নিষ্ঠুর!’ অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান ইকোনমিস্ট অধ্যাপক কৌশিক বসু এই অবস্থায় ভারতকে ‘শক্তিশালী অর্থনৈতিক নীতি’ চালু করার আহ্বানও করেছেন।
এখানে ভারত অর্থনীতির দিক থেকে বাংলাদেশের পেছনে পরে যাবে- এই বিষয়টি যেমন ভারতকে নীরব কষ্ট দিচ্ছে, অন্যদিকে শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ নিয়ে প্রশংসা করতেও তারা কার্পণ্য করেনি। ভারত তার সরকারের কোথায় কী ভুল হয়েছে, কোথায় কী দুর্বলতা বা ঘাটতি রয়েছে কিংবা মোদি সরকার কী কী করেছে- এসব বিষয় নিয়ে চুলচেড়া বিশ্লেষণ করছে। অথচ বিষয়টি নিয়ে আমাদের টক-শোগুলোতে খুব বেশি মাতামাতি করতে দেখা যায়নি। সরকারের পক্ষ থেকেও এ নিয়ে খুব বেশি আলোচনা কানে আসেনি। তবে একটা জিনিস খুব (আমার ব্যক্তিগত) ভালো লেগেছে, জিডিপি নিয়ে ভারতের মিডিয়ায় যারাই রিপোর্ট করেছেন, তাদের কেউ বাংলাদেশ নিয়ে মন্দ কথা বলেননি, বরং বাংলাদেশের অগ্রগতির পরিসংখ্যান দেখে তাদের কেউ কেউ প্রাণ খুলে প্রশংসা করেছেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব নিয়েও বিশ্লেষণ করতে দেখা গেছে।
আইএমএফ-এর সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী এই প্রথম মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে ১১ ডলার এগিয়ে যেতে পারে। আইএমএফ-এর এই পূর্বাভাস অনুযায়ী ভারত মাথাপিছু জিডিপির ক্ষেত্রে পাকিস্তান ও নেপালের থেকে সামান্য এগিয়ে থাকবে। সে হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, আফগানিস্তানের আগে চলে আসবে বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশ যে এবারই ভারতকে পেছনে ফেলেছে তা কিন্তু নয়। এ প্রসঙ্গে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’-এ প্রকাশিত স্বাতী নারায়ণের এক প্রতিবেদন উল্লেখ করে নরেন্দ্র মোদি সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জি কিষান রেড্ডি বেশ ঠাট্টা করে বলেছিলেন: ‘নাগরিকত্ব প্রদান করা হলে বাংলাদেশের অর্ধেক লোক ভারতে চলে আসবে।’ স্বাতী নারায়ণ তখন প্রশ্ন তুলে জিজ্ঞেস করেছিলেন- কেন আসবে? শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাড়িতে টয়লেট, মা ও শিশু মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা, স্কুল-কলেজে ছাত্রী ভর্তি, নারী কর্মী, সাক্ষরতার হার- এসব অনেক সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে। তারা বিনামূল্যে প্রতি বছর চার কোটির বেশি ছাত্রছাত্রীকে পাঠ্যবই দিচ্ছে। বাংলাদেশ কেবল মাথা জিডিপিতেই ভারতের থেকে সামান্য পিছিয়ে। শেখর গুপ্ত বলেছেন, এখন জিডিপিতেও ভারতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেল বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ার খবরে অনেকের ভেতর নীরব উত্তেজনা কাজ করছে- এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। কারণ, এক সময় দারিদ্র্য-দুর্ভিক্ষে জর্জরিত যে বাংলাদেশ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম করতো, সেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বজয়ের নবতর অভিযাত্রায় এগিয়ে চলছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্ব, যোগ্যতা, নিষ্ঠা, মেধা-মনন, দক্ষতা, সৃজনশীলতা, উদার গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী ও দূরদর্শী নেতৃত্বে। বিশ্বসভায় আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ। গৌরবময় হয়েছে বাঙালি যা অর্জনে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন শেখ হাসিনা। সব ধরনের প্রতিকুল অবস্থায় কীভাবে আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করতে হয়, কীভাবে মোকাবিলা করতে হয় এবং বিশ্ব মহামারির দিনগুলোতেও হার না মানার সাহস-শক্তি নিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়- এক্ষেত্রে আমাদের দৃষ্টান্ত বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
‘আমরা হার মানবো না, মৃত্যু তো হবেই, মৃত্যু যেকোনো সময় যেকোনো কারণে হতে পারে। কিন্তু তার জন্য ভীত হয়ে হার মানতে হবে? এ ধরনের একটা (করোনাভাইরাস) অদৃশ্য শক্তির কাছে, এটা হতে পারে না। সেজন্য আমাদেরও সেভাবে প্রচেষ্টা চালাতে হবে’- স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) ৩৪তম (১৫ জুন) প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে কথাগুলো বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি মূলত মানুষের মধ্যে আস্থা, বিশ্বাস আর সাহস জুগিয়েছেন। শুধু বক্তব্য বিবৃতি দিয়েই তিনি বসে থাকেননি, বরং বৈশ্বিক সংকটের এই ক্রান্তিলগ্নেও তিনি মানুষের জীবন ও জীবিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে নিঃস্বার্থভাবে নিরলস পরিশ্রম করেছেন, করে যাচ্ছেন। করোনার প্রাদুর্ভাবে সৃষ্ট সংকটের শুরু থেকেই তিনি ভাইরাস প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জনগণকে সচেতন করার লক্ষ্যে জাতির অভিভাবক হিসেবে ৩১ দফা নির্দেশনা মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন বারবার।
অন্যদিকে ৪ মিলিয়ন শিক্ষার্থীকে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক, শ্রমিক ও দিনমজুরসহ ৫ মিলিয়ন মানুষকে নগদ অর্থ সহায়তা, সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে গ্রাম পর্যায়ের প্রায় ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র হতে বিনামূল্যে ৩০ ধরনের ওষুধ প্রদানের মতো সময় উপযোগী উদ্যোগ শেখ হাসিনার সফল সিদ্ধান্ত। সরকারি সহায়তার পাশাপাশি তিনি নিজে উদ্যোগী হয়ে তহবিল সংগ্রহ করেছেন। এতিম ও গরিব শিক্ষার্থী, মাদ্রাসা, মসজিদ, মন্দির, স্কুল শিক্ষক, শিল্পী, সাংবাদিকসহ যারা সাধারণভাবে সরকারি সহায়তার আওতাভুক্ত নন, তাদের মধ্যে ২.৫ বিলিয়নের বেশি টাকা সুষ্ঠুভাবে বিতরণও করেছেন। সকল আলোচনা আর সমালোচনার মাঝেও একদিকে নাগরিকের জীবন ও জীবিকা নিশ্চিত করেন, অন্যদিকে অর্থনৈতিক চাকাও সচল রাখার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।
এদিকে শুধু মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) নয়, ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (১৬ অক্টোবর) হাঙ্গার ইনডেক্স প্রকাশ করেছে। এখানেও ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ অপুষ্টির হার কমিয়ে ক্ষুধা মুক্তির লড়াইয়ে অনেক এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। ১০৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৫, আর ভারতের অবস্থান ৯৪। পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা, নারীর ক্ষমতায়ন, টিকাদান, শিশুমৃত্যু রোধ ইত্যাদির মতো সমস্ত সূচকে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে। ভারত মাত্র দুটি সূচকে এগিয়ে ছিল, ১. মাথাপিছু আয় ও ২. মানব উন্নয়ন। এবার মাথাপিছু আয়ে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া অত্যন্ত সম্মানের, গৌরবের। আর তাই শেখ হাসিনার সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত আর বিচক্ষণ নেতৃত্ব নিয়ে গোটা বিশ্বে বাংলাদেশ আজ রোল মডেল। যে কারণে আইএমএফ-এর পূর্বভাস প্রকাশের পর ভারতের অনেকেই নতুন করে বাংলাদেশের পলিসি থেকে, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কৌশল থেকে ভারতকে শেখার কথা বলছেন। বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বিষয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা উভয় দেশের জন্যই লাভজনক।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)