১৩ মার্চ ১৯৭১ থেকে টাঙ্গাইল শহরের সার্কিট হাউজে ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সৈন্য অবস্থান করছিল। তারা টাঙ্গাইল শহরের আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। কিন্তু বিষয়টি টাঙ্গাইল গণমুক্তি ফৌজের নেতৃবৃন্দসহ সাধারণ মুক্তিকামী মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। কাদের সিদ্দিকী তার কয়েকজন সহচর এবং রিজার্ভ পুলিশের ৩০-৪০ জনসহ প্রায় ৮০ জন মুক্তিকামী মানুষ নিয়ে ২৭ মার্চ রাতে সার্কিট হাউজ ঘেরাও করেন, রাতে দুই পক্ষের মাঝে মৃদু গোলাগুলিও হয়। সেই সময় সোহরাওয়ার্দী, মনীন্দ্র মোহন ঘোষ, আব্দুস সবুর খান, এন.এ খান আজাদ, ইকবাল, হোসেন আলী, এনায়েত করিম প্রমুখ যুবক কাদের সিদ্দিকীর সাথে অসীম সাহসী ভূমিকা রাখেন। সারারাত উত্তেজনাকর পরিস্থিতির অবসান হয় যখন সৈন্যরা অবরোধকারীদের সাথে আলোচনায় বসেন।
ইতোমধ্যে হাজার খানেক মানুষ সার্কিট হাউজের ভেতরে প্রবেশ করে, সকালে গণমুক্তি পরিষদের চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান খান, গণবাহিনীর সর্বাধিনায়ক আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী উপস্থিত হন, লতিফ সিদ্দিকী বক্তব্য দেন এবং তাদের উপস্থিতিতে সার্কিট হাউজ থেকে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। সৈন্যদল তাদের হেড কোয়ার্টার জয়দেবপুরে যোগাযোগ করে এবং বিকালে মেজর সফিউল্লাহর নেতৃত্বে বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুই কোম্পানি সৈন্য জয়দেবপুর থেকে টাঙ্গাইল শহরে প্রবেশ করে। শ্রমিকনেতা হাবিবুবর রহমান খানের মাধ্যমে আরফান খান পেট্রোল পাম্পে মেজর শফিউল্লার সাথে লতিফ সিদ্দিকী ও কাদের সিদ্দিকীর সাথে পরিচয় ঘটে। পরে মেজর শফিউল্লাকে সংগ্রাম পরিষদ অফিসে নিয়ে আসা হয়, সেখানে বদিউজ্জামান খান, লতিফ সিদ্দিকী, খন্দকার আসাদুজ্জামানের সাথে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়, বিকেলে মেজর শফিউল্লাহ সার্কিট হাউজের সৈন্য ও তার সঙ্গে আগত সৈন্যদের নিয়ে টাঙ্গাইল ত্যাগ করে ময়মনসিংহ চলে যান।
২৮ মার্চ মেজর শফিউল্লাহ ময়মনসিংহ চলে গেলে টাঙ্গাইলের মুক্তিযোদ্ধারা শুরু করেন নতুন প্রস্তুতি, ঢাকার দিক থেকে পাক হানাদার বাহিনীর আক্রমণ ঠেকানোর জন্য ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের বহুস্থানে অর্থাৎ গোড়াই থেকে পাকুল্লা পর্যন্ত গাছ কেটে, মাটি কেটে ব্যারিকেড গড়ে তোলা হয়। ৩১ শে মার্চ খন্দকার আসাদুজ্জামানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ময়মনসিংহ থেকে আগত বাঙালি ই.পি.আর সদস্য ও টাঙ্গাইলের পুলিশ লাইনের পুলিশ সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে একাত্বতা ঘোষণা করে। ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল মুক্তিযোদ্বারা ও ই.পি.আর সদস্যরা ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কের নাটিয়া পাড়ায় (বর্তমানে নাসির গ্লাস ফ্যাক্টরির সন্নিকটে) প্রথম প্রতিরোধ ঘাটি স্থাপনের কাজ সমাপ্ত করে শক্ত অবস্থান প্রহণ করে। ২ এপ্রিল পাকুল্লার কাছে গোড়ান-সাটিয়াচুড়ায় মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নেয়। টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর উপজেলার এই গোড়ান-সাটিয়াচুড়াতেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে ই.পি.আর, মুক্তিযোদ্ধারা প্রথম মুখোমুখি যুদ্ধে অবতীর্ন হয়।
মির্জাপুর উপজেলার গোড়ান-সাটিয়াচুড়া গ্রামে বীর সন্তানেরা মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকেই সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সেনাবাহিনীর সদস্য মোশাররফ হোসেন তাদের ট্রেনিং দেন। তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা পাকুল্লা থেকে ধল্যা পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে অনেক ব্যাংকার কেটে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। ই.পি.আর সদস্যরা ও মুক্তিযোদ্ধারা সম্মিলিতভাবে নাটিয়াপাড়া থেকে অগ্রসর হয়ে ২ এপ্রিল সাটিয়াচুড়ায় অবস্থান নেন। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক সহযোগিতার জন্য ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন জনাব খন্দকার আসাদুজ্জামান, বদিউজ্জামান খান, আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, কাদের সিদ্দিকী, ন্যাপ নেতা সৈয়দ আব্দুল মতিন, শ্রমিক নেতা হাবিবুর রহমান খান প্রমুখ ব্যাক্তিগণ।
গোড়ান-সাটিয়াচুড়ায় থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ধল্যাতে এগিয়ে গিয়ে ঘাটি স্থাপন করে, কাদের সিদ্দিকীর নেতেৃত্বে ই.পি.আর ও মুক্তিযোদ্ধাদের দল নাটিয়াপাড়ায় অবস্থান করে। গোড়ান-সাটিয়াচুড়ায় অবস্থান নেয় সবচেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান ও শক্তিশালী দল। এখানে নেতৃত্বে থাকেন ই.পি.আর এ সুবেদার আব্দুল আজিজ ও সুবেদার আব্দুল খালেক। লতিফ সিদ্দিকী ও খন্দকার আসাদুজ্জামানের নেতৃত্বে জেলা গণপরিষদের পক্ষ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের জন্য আনা রাতের খাবার পেয়ে ঘুমাতে যান।
৩রা এপ্রিল শনিবার ভোর ৫ টায় অসংখ্য গাড়ির শব্দে ধল্যায় অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধাদের ঘুম ভেঙে যায়, মু্ক্তিযোদ্ধারা অতিদ্রুত প্রস্তুতি নিতেই হানাদার বাহিনীর ১৫০/২০০ গাড়ির বহরের অতি নিকটে চলে আসে। বহরের সামনে ছিল ফায়ার বিগ্রেডের খালি গাড়ি আর আকাশে চক্কর দিচ্ছিল বিমান। ধল্যায় অবস্থানরত বাহিনী সময়ের অভাবে পাকহানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে না পেরে পিছিয়ে এসে গোড়ান-সাটিয়াচড়ায় মূল মুক্তিবাহিনীর সাথে অবস্থান নেয়। হানাদার বাহিনীর গাড়ির বহর গোড়ান-সাটিয়াচুড়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান ঘাটির ৬০/৭০ গজের মধ্যে চলে এলে সড়কের বাম পাশে পূর্বে থেকেই অবস্থান নেওয়া ই.পি.আর বাহিনীর বাঙালি নায়েক সুবেদার আব্দুল আজিজ লাইট মেশিনগান দিয়ে সর্বপ্রথম গুলিবর্ষণ করে, সাথে সাথে সড়কের উভয়পাশ থেকে ৫০/৬০ টি রাইফেল এল এম জি, রকেট লাঞ্চার, মর্টার দিয়ে আক্রমণ করা হয়।
হানাদার বাহিনী পাল্টা আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণে পাক হানাদার বাহিনী দিশেহারা হয়ে যায়। এর মধ্যেই পাক বাহিনীরা ৩০/৩৫টি গাড়ি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং ৩০০-এর অধিক সৈন্য নিহত হয়, প্রায় ২০০ জনের মতো সৈন্য আহত হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হানাদারদের এতো ব্যাপক ক্ষতি খুব কমই হয়েছে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে সুবেদার আব্দুল খালেকের এল. এম. জি নষ্ট হয়ে গেলে তিনি তার নিরস্ত্র সহযোগী ফজলুর রহমান ফারুককে দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে বলেন। ফজলুর রহমান ফারুক স্থান ত্যাগ করে ১০০ গজ যাওয়া মাত্রই হানাদারদের মেশিন গানের গুলিতে ঝাঝড়া হয়ে যায় বীর আব্দুল খালেকের দেহ। হানাদার বাহিনী প্রথমে প্রচণ্ড মার খেলেও পরবর্তীতে ব্যাপক শক্তি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর আক্রমণ শুরু করে। এই আক্রমণের সামনে অল্প অস্ত্রে সজ্জিত মুক্তিযোদ্ধারা আর বেশী সময় টিকতে পারে নি। পর্যাপ্ত অস্ত্র না থাকায় অর্থাৎ গোলাবারুদ ফুরিয়ে যাওয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেন। এ দিকে হানাদার বাহিনী কামান, ও হেলিকপ্টার দিয়ে মুক্তিবাহিনীর ব্যাংকারে আক্রমণ করে ধ্বংস করে দেয়। গোড়ান সাটিয়াচুড়ার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ব্যপক ক্ষতি হয়। সকাল ৯টায় সকল প্রতিরোধ ভেঙে যায়। কাদের সিদ্দিকী পিছিয়ে নাটিয়াপাড়ায় এসে দেখেন ই.পি.আর সদস্যরা কিছু ভারী অস্ত্রসহ তাদের আস্তানা গুটিয়ে টাঙ্গাইলের দিকে যাত্রা শুরু করেছেন। তিনি ই.পি. আর সদস্যদের প্রতিরোধ না উঠানোর জন্য অনুরোধ করলেও তারা তা শোনেন নি। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের ৩০৩ রাইফেল দিয়ে প্রতিরোধ টিকে রাখা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে কাদের সিদ্দিকীসহ সকল মুক্তিযোদ্ধা টাঙ্গাইল শহরে চলে আসেন।
এই যুদ্ধে প্রায় ২৫ জন ই.পি.আর বাহিনীর বাঙালি সদস্য, প্রায় ৪৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ০৩ এপ্রিল ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গোড়ান-সাটিয়াচুড়া গ্রামে প্রবেশ করে নারকীয় ধ্বংস চালায়, তারা নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ যাকে পেয়েছে তাকেই হত্যা করে। সেদিন এই দুই গ্রামের ১০০ এর অধিক ব্যক্তি শহীদ হন।
পাক হানাদার বাহিনী শুধু গুলিবর্ষণ, বেয়নেট চার্জ করে মানুষ হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, পুড়িয়ে দিয়েছে অসংখ্য ঘর-বাড়ি। বর্বর পাক হানাদার বাহিনী ১৮ জন ই.পি.আর এর বাঙালি সদস্যসহ ৩০ জনকে একই ঘরে সমবেত করে জীবিত অবস্থায় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করে। একটি ব্যাংকারে আত্মগোপন করা ১৫ জন মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে। গ্রাম দুটি জনমানব শূন্য বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয়। ই.পি.আর বাহিনীর সদস্য, মুক্তিযোদ্ধা, গ্রামবাসীসহ বীর শহীদগণ এই গ্রামের মাটিতেই চির শায়িত আছেন। গণকবরগুলো যথাযোগ্য সম্মান পায়নি, শহীদ পরিবারদের হয়নি যথাযথ মূল্যায়ন।
লেখক: সভাপতি, ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়