তবে জেনে রাখুন, শূন্য থেকে কিছু হয় না। হয়তো হয়। হয়তো শূন্য থেকে মহাশূন্য হয়। কে জানে আমরা হয়তো শূন্য আর মহাশূন্যের মাঝখানে বাস করি। কিন্তু এসবই ‘হয়তো’র কথা। নিশ্চিত কথা এই যে, আমরা মানুষ সকল, আর আমাদের সঙ্গে বাস করে প্রাণ ও বস্তুনিশ্চয় এই বস্তুজগতে। বস্তু কী? বস্তু মানে একটা বাটি, দালান, বই, পাথর, আলমারি- এরা সবাই আমাদের সঙ্গী। বস্তু আর প্রাণ মিলিয়েই এই জীবনযাপন। জীবন মানে একচেটিয়া কোনো দর্শন নয়। জীবন মানে বহুমাত্রিকতা। বহু মত, পথ, বস্তু ও প্রাণের মিলনেই জীবনযাপন।
আদতে প্রাণের মতো জড় বস্তুও জায়গা দখল করে। জড় বস্তুরও আছে নিজস্ব অস্তিত্ব। একটা চামচের কথা ভাবলে যে ভাবনা আর আকার চোখে ভাসে, মনে আসে; একটা ফুটবল বললে তা আসে না। কারণ, ফুটবল কিংবা চামচ, পাথর কিংবা ফুল- সবারই আছে নিজস্ব সত্তা। এখন এই সকল সত্তার বিরোধিতা করা তো কোনো সার্বজনীন মত নয়। আমি যেমন থাকবো, তেমনি একটি ভাস্কর্য, একটি চিত্রকলা, একটি গান, একটি কবিতা থাকবে। হয়তো আমার চেয়ে বেশি সময় ধরেই থাকবে। মিকেলাঞ্জেলোর (১৪৭৫-১৫৬৪) যুগের সবাই মাটিতে মিলিয়ে গেছে, তাদের কোনো শারীরিক অস্তিত্ব টিকে নেই, কিন্তু মিকেলাঞ্জেলোর বানানো ভাস্কর্য ডেভিড, পিয়েতা আজও টিকে আছে। অগাস্ত রঁদ্যা’র (১৮৪০-১৯১৭) দ্য থিঙ্কার, দ্য কিস ভাস্কর্যসমূহও টিকে থাকবে। হয়তো মহাবিশ্ব ধ্বংস হওয়ার আগ পর্যন্ত টিকে থাকবে। যদি মানুষ তা ধ্বংস না করে।
সৃষ্টির আনন্দ আছে, আবার ধ্বংস করারও বিকৃত আনন্দ আছে। কখনো-বা একচ্ছত্র মতবাদ, একচেটিয়া দখলের মতো করে নিজের শক্তি খাটিয়ে আমরা ধ্বংস করে দিতে পারি একটা নগর, একটা জাতি বা একটা সংস্কৃতি। সেই বিস্তৃত আলাপে না-গিয়ে কেবল বামিয়ানের বুদ্ধের কথা বলি। আফগানিস্তানের রুক্ষ্ম পাহাড়ি অঞ্চলে বিশাল আকৃতির দুটো বুদ্ধের ভাস্কর্য ছিল। পশ্চিম দিকে যেটি ছিল তার দৈর্ঘ ৫৫ মিটার (১৮০ ফুট) আর পূর্ব দিকেরটির আয়তন ৩৮ মিটার (১২৫ ফুট)। ধারণা করা হয় এ দুটো ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছিলো ৫৪৪-৫৯৫ এবং ৫৯১-৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে। ছোটটি আগে, বড়টি পরে। কাবুল থেকে ১৩০ কিলোমিটার দূরে ২,৫০০ ফুট উচ্চতায় গান্ধারা শিল্পকলার অন্যতম এই নিদর্শন করা হয়েছিল চুনাপাথরের পাহাড়ের খাঁজ কেটে; মাটি, খড়, কাঠ, পলেস্তরা আর রঙ মিশিয়ে এই আদলকে আরো নিঁখুত চেহারা দেওয়া হয়েছে। এই ভাস্কর্যদ্বয়ের চারপাশের গুহাতেও অসংখ্য চিত্রকলা ছিল। এই শিল্পকর্মসমূহকে বৌদ্ধ শিল্পকলা এবং গুপ্তযুগের শিল্পকলার অন্যতম নিদর্শন মনে করা হতো।
প্রিয় পাঠক, লক্ষ্য করুন, বামিয়ান বুদ্ধদ্বয়ের কথা বলতে গিয়ে বারবার ক্রিয়াপদে অতীতকাল ব্যবহার করছি। কারণ তারা এখন অতীত। ২০০১ সালের মার্চ মাসে তালেবান নেতা মোল্লা মুহাম্মদ ওমরের আদেশে এই ভাস্কর্য দুটিকে ‘মূর্তি’ বলে ঘোষণা দেওয়া হয় এবং বিশাল আয়োজন করে ধ্বংস করা হয়। ষষ্ঠ শতকে কে বা কারা বানিয়েছিলেন এই ভাস্কর্য, কীভাবে বানিয়েছিলেন তার বিস্তারিত সব আমরা জানি না, কিন্তু বিংশ শতকে এসে কে বা কারা, কীভাবে এই ভাস্কর্যকে ধ্বংস করেছে তার বিস্তারিত তথ্যাদি আজ বিশ্ব জানে। রকেট লাঞ্চার, ট্যাঙ্ক এমনকি গোলা-বারুদ ব্যবহার করে এই ভাস্কর্য যারা ধ্বংস করেছেন তারা কেউ এর নির্মাণের সাথে যেমন জড়িত নন, তেমনি ভাস্কর্যের নন্দনতাত্ত্বিক ধারণা রাখেন না। আমরা শুধু প্রশ্ন করতে পারি, যা আপনি বানাননি, তা ধ্বংসের অধিকার আপনাকে কে দিলো? আপনার ভাবনার বিপক্ষে যা হবে তাই কি ধ্বংসের যোগ্য? মনে করে দেখুন, হিটলারের নাৎসীবাহিনী কেমন করে বই পুড়িয়েছিল।
আফগানিস্তানে গুপ্তযুগের শিল্পকলার অন্যতম নিদর্শন বামিয়ান বুদ্ধ
ভাস্কর্য ভাঙা, বই পোড়ানো, চিত্রকর্ম পোড়ানো- এসব ধ্বংসকর্মের সঙ্গে অনেক সময়ই ধর্মকে সংযুক্ত করা হয়। এখন ধর্মকেন্দ্রিক কোনো সিদ্ধান্তের সমস্যা হলো, পৃথিবীতে এই মুহূর্তে মাত্র ৪,৩০০টি ধর্ম আছে। তবে এই সংখ্যা ধ্রুব নয়। কারণ আমাজনের জঙ্গলে কিংবা ওসেনিয়ার মহাঞ্চলে এমন অনেক ধর্ম, গোষ্ঠী আছে যাদের কথা এখনও আমরা জানি না। আবার অনেক ধর্মই আছে যা বিলুপ্ত হতে থাকে। আমি নিজে ১৯৯৭-৯৮ সালে গারো অঞ্চলে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি তাদের আদি ধর্ম সাংসারেক বিলুপ্তপ্রায়। পরিস্থিতির চাপে তারা বাধ্য হয়েছে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করতে। যাহোক সেটা মূল আলোচনা নয়। মূলত বিশ্বের ৮০ ভাগ জনগোষ্ঠী হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলিম, ইহুদি, জৈন, শিখ, শিন্তো ধর্মের চর্চাকারী। বলা যায়, ধর্মীয় গোষ্ঠী হিসেবে এরাই সবচেয়ে প্রভাবশালী বা শক্তিশালী। এখন এই প্রভাবশালী ধর্মগোষ্ঠীরাও যদি একে অপরের ধর্ম চর্চার দোহাই দিয়ে শিল্পকর্ম, বই ইত্যাদি ধ্বংসে নেমে যায় তবে পৃথিবী নরকে রূপান্তরিত হতে বেশি সময় নেবে না।
যত মত তত পথ, যত ধর্ম তত বিভাজন। আমার সাধারণ বুদ্ধি বলে, অন্তত ধর্মকে কেন্দ্র করে যে কোনো কিছু ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়া সঠিক হবে না। বরং পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি থাকাই উত্তম। অন্য কেউ যদি ভাস্কর্য বানায়, মূর্তি পূজা করে তার বিচার করা সম্ভবত আমার দায়িত্ব নয়। দেখুন তো, ধ্বংসের পর বামিয়ান বুদ্ধকে কেমন লাগছে? ধ্বংসস্থানের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে কেমন লাগে আপনার আমার? ধর্ম, রাজনীতির নামে ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে কেমন লাগে আপনার?
একটা সহজ জিনিসি এই করোনাকালের অনিশ্চিত জীবনযাপনের সময়ও আমরা বুঝতে পারছি না। তা হলো, এই পৃথিবীটা কারো একার না। আপনি যে ধর্মেরই হোন, যে জাতের, দেশেরই হোন, সবার আগে আপনি-আমি মানুষ। আর মানুষের সবচেয়ে বড় গুণ সহানুভূতি, সহনশীলতা, ভালোবাসা এবং সৌন্দর্য চর্চা। নিজেকে শুধু টিকিয়ে রাখা নয়, মানুষের দায়িত্ব এই বিশ্ব সংসারের সবকিছুকে টিকিয়ে রাখা। টিকে থাকা ও টিকতে দেওয়া সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আর প্রাণের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বস্তুকেও লাগে। প্রয়োজন তাই সহাবস্থানের। সহাবস্থান সহনীয় করে জীবনকে, জীবনের সবকিছুকে।
এই মহাবিশ্বে এমনি এমনি কিছু তৈরি হয় না। সেইসঙ্গে অপ্রয়োজনীয় বলে কিছু নেই। প্রাণ আর বস্তুর মিলিত অবস্থানেই জীবনচক্র চলমান। মানুষ, গরু, পাখি যেমন প্রাণ। মাটি, পাথর, বালুও তেমন বস্তু বা পদার্থ। একটি ধূলিকণা, একটি পাথরও হতে পারে মানুষের দরকারী। সেই অনেক অনেক কাল আগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা পাথর দিয়ে হাতিয়ার বানিয়েছে, শিকার করেছে, প্রস্তর যুগে পাথরই ছিলো মানুষের সঙ্গী। ব্রোঞ্জ কিংবা লৌহ যুগেও নিরেট বস্তুই মানব সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছে কতো রঙে রূপে। মানুষের ক্ষেত্রে নিজের প্রয়োজন কেবল বস্তুগত প্রয়োজন নয়। সেই রুঢ়কালে আদিম মানুষ বহু কষ্ট করে জীবন ধারণ করেছে। কিন্তু তাদের জীবনেও ছিল ফুল, পাখির আনন্দ। প্রাণীকুলের আর কেউ মানুষের মতো করে নদী, ঝরনাধারা কিংবা পূর্ণিমা দ্বারা পুলকিত হয় না। একটা পাথর কিংবা গাছের মরা ডালকেও মানুষ যেমন তার প্রয়োজনে কাজে লাগিয়েছে, তেমনি প্রয়োজনের উর্ধ্বেও দেখতে শিখেছে।
২০০১ সালে তালেবানরা আয়োজন করে ভাস্কর্য ধ্বংস করে। ধ্বংসস্তূপের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন দুই নারী
টিকতে না-পারা বিশাল ডায়নোসর কিংবা টিকে-যাওয়ার জগতের অযুত-নিযুত তেলাপোকার কল্পনা শক্তি, মেধা কিংবা রুচি তেমন প্রখর নয় যে তারা বস্তুকে, পদার্থকে তার উর্ধ্বে দেখবে। একটা পাথর কিংবা মার্বেল পাথরের ভেতরেও কল্পনার অসীম সম্ভাবনা দেখতে পাওয়া যায়, যদি আমরা দেখতে শিখি। মিকেলাঞ্জেলো বলতেন, ‘প্রত্যেকটি পাথরের খণ্ডের ভেতরে একটা মূর্তি রয়েছে আর এটা আবিষ্কার করাই একজন ভাস্করের কাজ।’ এই কথাটাই আরেকটু ভালো করে বোঝা যাবে মিকেলাঞ্জেলোর আরেকটি উদ্ধৃতিতে: ‘আমি মার্বেলের ভেতর দেবদূতকে দেখেছি এবং মার্বেল খোদাই করেছি তাকে মুক্ত করতে।’
এখানেই মানুষের মহত্ব। শিল্পকর্মই আদতে সভ্যতা। যন্ত্র নয়, খাদ্য নয়, এর বাইরেও মানুষ তাকিয়েছে। দূর আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র থেকে অতলান্তিক মহাসাগরের তলদেশ- সবখানেই মানুষের কল্পনা ঘুরে বেড়িয়েছে। মানুষ তার চারপাশের জগত দেখেছে, কখনো মূর্ত কিংবা বিমূর্ত আকারে কখনোবা নিরাকারে। এই দেখতে পারা, এই কল্পনা শক্তি, এই পাথরের ভেতর থেকে দেবদূতকে মুক্তি দেওয়ার কল্পনাই জগতকে অমৃত সুন্দরে পরিণত করেছে। হাঙ্গেরিয়ান ভাস্কর এটেনে হাইদু বলেছেন এক মহামন্ত্রের কথা: ‘যেখানে বস্তুগত শেষ হয়, সেখানে শিল্পের সূচনা হয়।’ বস্তু জগতের প্রয়োজনের মাপ থেকে অসীম কল্পনার দিকে যখন যাত্রা শুরু, তখনই শিল্পকর্মের সাধনা শুরু হয়। আর শিল্প-সাধনা ঈশ্বর-সাধনার চেয়ে তো কম নয়। তাই যে লেখে, যে আঁকে, যে নির্মাণ করে সে তো ঈশ্বরেরই প্রতিনিধি। মহান স্রষ্টার আশীর্বাদপুষ্ট মানুষই শিল্পী হয়। আর শিল্পী সে বস্তু ও প্রাণ, মুর্ত আর বিমুর্ত, আকার আর নিরাকারের জগতের সঙ্গে যেন সেতু তৈরি করে দেয়।
এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ ভাস্কর হেনরি মুরের আরেকটি উদ্ধৃতি স্মরণযোগ্য মনে করছি- ‘চিত্রকর্ম ও ভাস্কর্য অন্যদের সাহায্য করে কী সুন্দর পৃথিবীতে আমরা বসবাস করি সেটা দেখতে।’ একটা গোলাপ এমনিতেই সুন্দর! ভাসমান একখণ্ড মেঘও সুন্দর! যদিও সেই সৌন্দর্য সব সময় আমরা ঠিকমতো দেখি না বা উপলব্ধি করি না। সেই দেখার, উপলব্ধির জগতকে আরো ঋদ্ধ করে দেয় একজন শিল্পী বা ভাস্কর একটি পাথরকে খোদাই করে গোলাপ বানিয়ে কিংবা একটি ক্যানভাসে মেঘ এঁকে। ভাস্কর্য বা চিত্রকর্ম শুধু আমাদের বস্তু জগতের রূপকেই তুলে ধরে না, শুধু আমাদের উপলব্ধি-অনুভবকেই বৃহৎ করে না, কখনো বস্তু বা দৃশ্যকে অমরও করে।
শেষটা করি জর্জ বানার্ড শ’র একটা কথা দিয়ে: ‘শিল্পকলা ছাড়া বাস্তবতার অসভ্যতাগুলো এই জগতকে অসহনীয় করে তুলতো।’