মুক্তিযুদ্ধে শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের ভূমিকা ছিল অনন্য। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান থেকে একাত্তরের মার্চের অসহযোগ আন্দোলনে তাদের সোচ্চার ভূমিকা জনগণকে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থনজ্ঞাপনে উজ্জীবিত করে। পঁচিশে মার্চের পর অনেক শিল্পী অবরুদ্ধ দেশেও সাংস্কৃতিক লড়াই অব্যাহত রেখেছিলেন। অনেকে ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যে অবস্থান করে স্থির করেছিলেন তাদের কর্তব্যকর্ম। তাঁরা শত প্রতিকূলতা ও বৈরিতার মধ্যেও সাংস্কৃতিক দল গঠন করে পালন করেন জাগরণী ভূমিকা। শরণার্থী শিল্পীরা দেশমাতৃকার ঘোর দুর্দিনে গ্রহণ করেন যথাসাধ্য উদ্যোগ। মুক্তিযোদ্ধা শিবির, শরণার্থী শিবির, যুব শিবির এবং স্থানীয় জনগণের মাঝে মুক্তির গান ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা শক্তি ও সাহস সঞ্চার করেছেন। ভারতসহ নানা দেশের শিল্পীসমাজও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন ও তহবিল গঠনে নানামুখী প্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন। এখানে মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে বাংলাদেশের শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের উদ্যোগে গঠিত ৩টি সাংস্কৃতিক প্রয়াসের কথা উপস্থাপিত হলো।
বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংস্থা
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও একাত্তরের মার্চের অসহযোগ আন্দোলনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। ‘জাগরণী’ সংগঠনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক পটভূমি রচনায় শিল্পীসমাজ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এবং এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। ঢাকায় বিক্ষুব্ধ শিল্পীসমাজের আলোকে শহরের শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা এ বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কর্মকাণ্ড পরিচালনায় উদ্ধুদ্ধ হয়। সে-সময় এ কে এম হারুনুর রশীদ ও জীবন বর্মণের গান রেকর্ড করা হয়। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী অল্প দিনের ব্যবধানে বেতার কেন্দ্রটি ধ্বংস করে দেয়। সংস্কৃতিকর্মীরা প্রাণভয়ে আশ্রয় নেন সন্নিবর্তী ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায়।
এরই মধ্যে দেশের, বিশেষত পূর্বাঞ্চলের অনেক শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মী জড়ো হন আগরতলার কলেজটিলায় এমবিবি কলেজে। প্রত্যেকে জড়ো হয়েছিলেন আত্মতাগিদে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিল্পীসমাজ এক্ষেত্রে সূত্রধরের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এদেরই সম্মিলিত প্রয়াসে ৩ জুন ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংস্থা’। এমবিবি কলেজের নির্মীয়মাণ ভবনে স্থাপিত হয় সংস্থার কার্যালয়। মুজিবনগর সরকার কর্তৃক স্বীকৃত পূর্বাঞ্চলের একমাত্র এই সাংস্কৃতিক দলে দেশের নানা প্রান্তের শরণার্থী শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। শিল্পীদের উদ্যোগে ‘জয়বাংলা’ অফিসে গিয়ে বলা হয়, তারা ক্যাম্পে ক্যাম্পে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জাগরণী গান করবেন। তখন সরকার এদের পৃষ্ঠপোষকতা করার উদ্যোগ নেয়। এক্ষেত্রে জহুর আহমদ চৌধুরী ও এম আর সিদ্দিকীর ভূমিকা ছিল মুখ্য। ৩ জুন এম আর সিদ্দিকী স্বাক্ষরিত চিঠিতে এ সংস্থা গঠনের কথা বলা হয়। চিঠিতে তালিকাভুক্ত শিল্পীবৃন্দের মধ্যে ছিলেন হরিপ্রসন্ন পাল, অমল দত্ত, চিত্তরঞ্জন ভূঁইয়া, আজিজুল্লাহ চকলেট, আশিষ চৌধুরী, কামালউদ্দীন আহমদ, সালাম কবির, গীতশ্রী চৌধুরী, জয়শ্রী চৌধুরী, ছায়া রায়, সুমিত্রা ভট্টাচার্য, জয়ন্তী ভূঁইয়া, নিয়তি ভূঁইয়া, বেণু চক্রবর্তী এবং সৈয়দ মামুনুর রশীদ। ক্রমান্বয়ে সম্পৃক্ত হয়েছেন অন্যান্য শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মী। সংস্থার আহ্বায়ক ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, নৃত্য ও মঞ্চশিল্পী এ কে এম আজিজুল্লাহ, ওরফে চকলেট। নেতৃভূমিকায় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের ছাত্র ও মঞ্চাভিনেতা এস এম মহসীন। মুজিবনগর সরকারের পূর্বাঞ্চলীয় জোনের প্রধান জাতীয় পরিষদ সদস্য এম আর সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি আবদুল কুদ্দুস মাখন এবং শেখ ফজলুল করিম সেলিমের পৃষ্ঠপোষকতা এ সংস্থার কার্যক্রমকে গতিদান করে।
শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা বিপুল উদ্দীপনায় পরিচালনা করেছিলেন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। তখনও সাংগঠনিকভাবে এ সংস্থা আত্মপ্রকাশ করেনি। ২৮ মে ১৯৭১ দৈনিক ‘রুদ্রবীণা’র পক্ষে চম্পা নাগ ‘আটাশের সন্ধ্যা: বাংলাদেশ-আগতদের প্রাণোচ্ছ্বল নজরুল স্মরণিকা: সঙ্গীত-আবৃত্তি-আলোচনা সমৃদ্ধ একটি মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান’ প্রতিবেদনে লেখেন: ‘স্থানীয় এমবিবি কলেজের ছাত্রাবাস প্রাঙ্গণে বাঙলাদেশের নাগরিকবৃন্দের উদ্যোগে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তী উৎসব অত্যন্ত প্রাণবন্ত পরিবেশে উদযাপিত হয়। ...আবৃত্তি এবং গানে বাংলাদেশের প্রতিটি শিল্পী অন্তরের দরদ ঢেলে দিয়েছেন; নিতান্ত দুঃসময়েও যে প্রাণ প্রাচুর্যের পরিচয় তাঁদের গানে, আবৃত্তিতে ফুটে উঠেছে তাকে এক কথায় বলা চলে অনবদ্য। নজরুল ইসলামের অনেকগুলি সংগ্রামী গান অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হয়। প্রতিটি গান শেষ হওয়ার সংগে সংগেই শ্রোতারা উচ্ছ্বাসে কলধ্বনি করে ওঠেন।’
অনুষ্ঠানের সমাপ্তি পর্বে আজিজুল্লাহ চকলেট এবং আশিস চৌধুরী যৌথভাবে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটির ছন্দময় নৃত্যরূপ দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের গ্রামোফোন রেকর্ড অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই ‘বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংস্থা’ আনুষ্ঠানিকভাবে জন্মলাভ করে। সঙ্গীত, নৃত্য, আবৃত্তি, দেশাত্মবোধক গান, রবীন্দ্র-নজরুলের স্বদেশপর্বের গান, জাগরণী সঙ্গীত প্রভৃতির মাধ্যমে গণজাগরণ সৃষ্টি, শরণার্থীজনের মনোবল অটুট রাখা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মনে মুক্তির আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া ছিল এ সংস্থার মূল উদ্দেশ্য। ত্রিপুরায় শরণার্থী শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীর স্বতঃস্ফূর্তভাবে জড়িত হয়েছেন এ সংস্থার সঙ্গে। তাদের কেউ কেউ হয়তো অল্প সময়ের ব্যবধানে অন্যত্র চলে গেছেন কিন্তু কর্মকাণ্ড পুরোদমে চলেছে বিজয়ের দ্বারপ্রান্ত পর্যন্ত। এখান থেকে গিয়ে যারা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন আবদুল গনি বুখারী, সরদার আলাউদ্দিন, অরূপ রতন চৌধুরী, বিপুল ভট্টাচার্য, অজিত রায় আরও অনেকে।
৯ জুলাই দৈনিক ‘রুদ্রবীণা’য় প্রকাশিত ‘মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা যোগাতে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংস্থার অনুষ্ঠান’ শীর্ষক খবরে বলা হয়, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের প্রেরণা যোগাবার জন্য ‘বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংস্থা’ ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন মুক্তিফৌজে শিবিরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনা করে চলেছেন। অনুষ্ঠানগুলোর উদ্যোক্তা ছিলেন সংশ্লিষ্ট মুক্তিফৌজ শিবিরের পরিচালকমণ্ডলী এবং সাংস্কৃতিক সংস্থার শিল্পীদের তত্ত্বাবধায়ক গোলাম রফিক ও হামিদুর রহমান।
আলোচনা সভায় এস এম মহসীন বলেন, ‘প্রয়োজন হলে আমরাও হাতে অস্ত্র নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করব এবং একই সঙ্গে মুক্তির জয়গানে বাংলার আকাশ-বাতাস ভরে তুলব। বাংলাদেশ থেকে শেষ হানাদারটি নিশ্চিহ্ন না হওয়া পর্যন্ত আমরাও মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি থাকব।’ ২৭ জুন বাংলাদেশের মুক্ত এলাকায় মুক্তিফৌজের কোনো এক অস্থায়ী শিবিরে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের নেতা জাতীয় পরিষদ সদস্য মিজানুর রহমান চৌধুরী সংস্থার আদর্শ ও উদ্দেশ্যের ভূয়সী প্রশংসা করেন। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’র মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।
এভাবে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংস্থা কাজ করে যাচ্ছিল। দৈনিক ‘রুদ্রবীণা’র ২৪ আগস্ট সংখ্যায় ‘দেশাত্মবোধক সঙ্গীত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দুর্নিবার প্রেরণা জোগায়’ শীর্ষক খবরে বলা হয়, ১১ আগস্ট দুর্গা চৌধুরীপাড়া বিজনা যুবশিবিরে ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংস্থার শিল্পীবৃন্দ দেশাত্মবোধক সঙ্গীত পরিবেশন করেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে মুখ্যমন্ত্রী মন্তব্য করেন, দেশাত্মবোধক সঙ্গীত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের এমনই দুর্নিবার প্রেরণা যোগায় যে, সংগ্রামে তাঁরা অপ্রতিহত হয়ে ওঠেন। মুখ্যমন্ত্রী উক্ত সাংস্কৃতিক সংস্থার শিল্পীদের প্রশংসা করেন।
এদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচার প্রহসনের তারিখ নির্ধারিত ছিল। অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিলেন উক্ত শিবির প্রধান সৈয়দ এমদাদুল বারী এবং আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম রফিক। ‘আমার দেশ বাংলা’ গানটির মাধ্যমে অনুষ্ঠান সূচিত হয়। গণসঙ্গীতশিল্পী অজিত রায় নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ সঙ্গীত পরিবেশন করেন। সঙ্গীতানুষ্ঠানের আগে বক্তাবৃন্দ সারগর্ভ ভাষণ দেন। এর মধ্যে কে পি দত্ত, গোলাম রফিক ও আজিজুল্লঅহ চকলেট উল্লেখযোগ্য। প্রধান অতিথির ভাষণে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম আমাদেরও সংগ্রাম। এই সংগ্রামকে জয়যুক্ত করবার জন্য আমাদের সকলেরই অনেক ত্যাগ স্বীকার ও দুঃখ বরণের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংস্থার শিল্পীদের পরিবেশিত দেশাত্মবোধক সঙ্গীত মুক্তিযোদ্ধাদের মনে গভীর প্রেরণা ও প্রচুর আত্মশক্তি যোগাবে। অনুষ্ঠান শেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য প্রার্থনা করা হয়। এস এম মহসীন এ অনুষ্ঠানের স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, অজিত রায়ের গান শুনে শচীন্দ্রলাল সিংহ তাঁকে আবেগে জড়িয়ে ধরেছিলেন। সে এক অভূতপূর্ব মুহূর্ত।
সংস্থাটি বিশালগড়, হাতিমারা, বিশ্রামগঞ্জ, উদয়পুর, লেম্বুচড়া, দুর্গা চৌধুরীপাড়া, বাগমারা, অম্পিনগর প্রভৃতি ক্যাম্পে অনুষ্ঠান করেছে। মুক্তিযুদ্ধে ২, ৩ নং সেক্টরের অর্থাৎ পূর্বাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি শরণার্থী শিবির, যুবশিবির ও মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে এবং জনসমাগমস্থলে সাংস্কৃতিক সংস্থা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। ভারতীয় সেনাবাহিনী গাড়ি করে সদস্যদের নিয়ে যেত। জয়শ্রী চৌধুরী অগ্নিঝরা দিনগুলির স্মৃতিচারণ বলছিলেন, আমাদের গানে সবাই একাত্ম হয়ে যেত। আবেগে আপ্লুত হয়ে কেউ কেউ কেঁদে ওঠতো। মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধারা রাইফেল উঁচিয়ে উদ্দীপনায় স্লোগান ধরতো, ‘জয় বাংলা’। গভীর রাত পর্যন্ত গান হতো। অনেক সময় সারা রাত অনুষ্ঠান করে সকালে কাছাকাছি কোনো শিবিরে অনুষ্ঠান করে ফিরে আসতো দল। তিনি আরও বলছিলেন, শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা অনেক কষ্ট স্বীকার করে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিল। গান গাওয়ার সময় সেই কষ্ট ও যন্ত্রণা বাঙ্গময়রূপ লাভ করতো। এস এম মহসীন বলছিলেন, যুদ্ধে যাওয়ার আগের দিন মুক্তিযোদ্ধাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উজ্জীবিত করা হতো। দেশকে শত্রুমুক্ত করার দুর্দমনীয় ভাব জেগে ওঠতো তাদের চোখে-মুখে।
উপরে বর্ণিত প্রত্যেকটি অনুষ্ঠানে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সেখানে সংস্থার শিল্পীবৃন্দ অংশগ্রহণ করেছেন। পরিবেশনার মধ্যে আরও থাকতো নাট্যাংশ, গীতিনাট্য, ব্যাঙ্গচিত্র। নাট্যাংশ ও গীতিনাট্য রচনায় এ কে এম হারুনুর রশীদ ও সুধাময় করের ভূমিকা ছিল মুখ্য। এভাবে জুন মাস থেকে বিজয়ের প্রান্ত পর্যন্ত বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংস্থা একের পর এক অনুষ্ঠান করেছে। শিবিরে শিবিরে ঘুরে ঘুরে অনুষ্ঠান করতো বলে একে ভ্রাম্যমাণ সাংস্কৃতিক সংস্থাও বলা হতো। শুধু মুক্তিযুদ্ধের প্রচলিত গান নয়, সে-সময়ের প্রেক্ষাপটে রচিত হয় নতুন অনেক গান। সেই গান ধ্বনিত হতো সংস্থার শিল্পীদের মুখে। নতুন গানের গীতিকারদের মধ্যে ছিলেন অসিত চৌধুরী, গজেন্দ্রলাল রায়, সুধাময় কর, সরদার আলাউদ্দিন, অমূল্য ভট্টাচার্য, এ কে এম হারুনুর রশীদ, জীবন বর্মণ ও মৃনালকান্তি দত্ত।
অসিত চৌধুরীর গানগুলির মধ্যে ছিল ‘শক্ত হাতে ধর পতাকা’, ‘আমার পুরব বাংলাদেশ/ তোমায় সালাম নম নম’, ‘বাংলা মোদের মায়ের বুলি/ মায়ের ভাষার মান বাঁচাতে/ ভাইয়েরা বুকে নিল গুলি’। এ কে এম হারুনুর রশীদের গানগুলির মধ্যে ছিল ‘সংগ্রাম চলবেই/ জনতার সংগ্রাম চলবেই’, ‘চেয়ে দেখ পুবাকাশ লালে লাল হয়ে আছে/ সব শহীদের রক্তজমে সূর্য হয়ে গেছ’, ‘লাল সবুজে জন্ম আমার বাংলাদেশে বাড়ি/ উথাল-পাতাল পদ্মা-মেঘনা পাড়ি দিতে পারি’, ‘বাংলাদেশের মেয়ে আমি বাংলাতে গান গাই/ বাংলা ছাড়া ভাইরে আমার কোন গান নাই’।
জীবন বর্মণের গানগুলির মধ্যে ছিল ‘লাল লাল রক্তে ভেসে গেছে জনপদ/ কত যে মায়ের কোল/ যে শূন্য করেছে আজ নির্মম পিশাচের দল’, ‘ওরে ও মানুষ দ্বার খুলে দে/ রক্তরাঙা ঐ সূর্য দিল ডাক’, ‘শহীদের লাল রঙে ভিতে ভূগোল রচিত যে দেশের/ আমি যে মানুষ ঐতিহাসিক সেই সে দেশের’। মৃনালকান্তি দত্তের লেখা ও সুরারোপিত গানগুলি ছিল ‘আমরা শপথ নিলাম একই সাথে চলবো’, ‘এ লড়াই বাঁচার লড়াই/ এ লড়াইয়ে জিততে হবে’, ‘ইতিহাস লিখেছি তো আমরা/ আমরা তো কভু হার মানিনি’, ‘বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে/ আমরা সবাই বাঙালি তাই’, ‘মানবো না মানবো না/ ইয়াহিয়ার কোনো শাসন মানবো না’।
গানের সঙ্গে থাকতো ধারাবিবরণী। ধারাভাষ্য লিখতেন এ কে এম আজিজুল্লাহ ও এস এম মহসীন। অনুষ্ঠানসমূহে বিভিন্ন সময়ে তবলা সঙ্গত করতেন বেনু চক্রবর্তী, অরূপরতন চৌধুরী, সৈয়দ মামুনুর রশীদ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনুষ্ঠান সঞ্চালন করতেন এ কে এম আজিজুল্লাহ। সার্বিক তত্ত্বাবধানে থাকতেন এস এম মহসীন। ১৯৭৪ সালে এম আর সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন ও এ কে এম আজিজুল্লাহ চকলেট স্বাক্ষরিত সংস্থার শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীর তালিকায় এর সদস্য সংখ্যা ছিল ৫১। প্রথমোক্ত তালিকা ছাড়াও যাঁদের নাম উপরে বর্ণিত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সংবাদে প্রকাশিত হয়েছে, তাঁরা হলেন- মহিউদ্দিন খোকা, অরূপরতন চৌধুরী, এস এম মহসীন, শঙ্করনাথ সাহা, এস এম শাহাজাদা, হাফিজুল কবির লেনিন, এ কে এম হারুনুর রশীদ, ফিরোজ আহমদ, সুজিত আড়েং, সৈয়দ জহির হোসেন, দেলোয়ার জাহান ঝন্টু, শাহাবুদ্দীন আহমদ, দিলারা হারুন, সিঁথি কর।
উপর্যুক্ত কর্মকাণ্ডে যাঁদের নাম সংগৃহীত পত্র-পত্রিকার সংবাদে আসেনি তাদের মধ্যে আছেন এস এম সেলিম, অমলকৃষ্ণ মজুমদার, সুধেন্দু চক্রবর্তী, রবীন্দ্রলাল পোদ্দার, আজিজুল হক চৌধুরী, শ্যামলকৃষ্ণ মজুমদার, ফরিদউদ্দীন আহমদ, আমিনুল হক, সিদ্দিক মিয়া, মিরাজউদ্দীন আহমদ, ওবায়দুল হক, আবদুস শহীদ, জসীমউদ্দীন আহমদ, মুক্তা চক্রবর্তী, উমেশচন্দ্র রায়, আবদুল মঈন, নারায়ণচন্দ্র ঘোষ, মোতাহার হোসেন খান, হুমায়ুন কবির, মফিজুল ইসলাম, মৃনালকান্তি দত্ত।
যাঁরা তালিকাভূক্ত নন, কিন্তু সংস্থার কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছিলেন এবং পত্রিকায় যাঁদের নাম প্রকাশিত হয়েছিল তাদের মধ্যে রয়েছেন অনুভা হোর, ছন্দা হোর, নজরুল ইসলাম, অরুণ চৌধুরী, ছায়া চক্রবর্তী, আবদুল গনি বুখারী, প্রদীপ, সুধা কর।
সংস্থার সকল কাজে স্থানীয় জনগণের ব্যাপক সাড়া ও সমর্থন ছিল হৃদয়স্পর্শী। এমবিবি কলেজের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সত্যরঞ্জন ভট্টাচার্য ও বিজন চৌধুরী এ কাজে বিশেষ সহযোগিতা করেছিলেন। শিল্পীরাও নিবেদিত ছিলেন দেশমাতৃকার সঙ্কটমোচনে। এসএম মহসীন বলছিলেন, এমবিবি কলেজের নির্মীয়মাণ হোস্টেলে খড়ের উপর চাদর বিছিয়ে বিছানা পাতা হয়েছিল। সেখানেই চলতো মহড়া। নারী শিল্পীদের অধিকাংশ কাছাকাছি কোনো শিবির কিংবা আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে থাকতো। অন্যেরা সেখানেই পর্দা টানিয়ে পৃথকভাবে বাস করতো। আমরা নিজেরাই রান্না করতাম। এ নিয়ে কোনো মনোবেদনা ছিল না।
অনেকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেও এ সংস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেছেন, যেমন গীতশ্রী চৌধুরী। তিনি জিবি ও ভিএম হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবী ভূমিকা পালন করে সংস্থার কার্যক্রমে নিয়মিত অংশ নিয়েছেন। এরই মধ্যে নিয়েছিলেন সশস্ত্র প্রশিক্ষণ। সংঘের সদস্য সঙ্গীতশিল্পী ফিরোজ আহমদ বলছিলেন, সাংস্কৃতিক সংস্থার অনেক সদস্য কণ্ঠযুদ্ধের পাশাপাশি অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন। এদের কয়েকজন শহীদ হন। যাঁরা এ প্রয়াসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন তাদের প্রায় সবাই ছিলেন তরুণ। তারুণ্যের বর্ণচ্ছটায় গান, নৃত্য, নাটক, আবৃত্তিতে সেদিন মুক্তির জোয়ার এসেছিল। শিল্প ও সংস্কৃতির নানা মাত্রিক উপস্থাপনায়, রূপ ও রসের ব্যঞ্জনায়, চেতনা ও ভাবনার মিথষ্ক্রিয়ায় শ্রোতৃমণ্ডলীর মাঝে তৈরি হতো জাগরণ। এ জাগরণে উঠে আসতো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও লক্ষ্য। মুক্তির বাণী ছড়িয়ে পড়তো সর্বত্র, সবখানে। মুক্তিযুদ্ধের সাংস্কৃতিক সংগ্রামে সংস্থার অসামান্য ভূমিকা তাই স্বর্ণাক্ষরে খচিত আছে। (চলবে)