স্বাধীন বাংলা মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতিক সংঘ
কুমিল্লা জেলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সমৃদ্ধির ধারায় সুখেন্দু চক্রবর্তী যোগ করেছিলেন বিশেষ মাত্রা। তাছাড়া জাতীয়ভাবেও তিনি গণসঙ্গীত ও সুরকার হিসেবে অবদান রেখে গেছেন। সুখেন্দু চক্রবর্তীর (১৯২৩-১৯৮০) শিল্পীজীবনের সূচনা পারিবারিক পরিমণ্ডলে। প্রথমে ওস্তাদ সমরেন্দ্র পাল, পরে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী সত্যেন্দ্রকুমার চক্রবর্তীর কাছে সঙ্গীতের তালিম গ্রহণ করেন। পরে তালিম নেন ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরুর কাছে। এস্রাজ, সেতার ও তবলাবাদনে ছিলেন পারদর্শী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শামসুন নাহার হলের সঙ্গীত শিক্ষক ছিলেন। সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন ‘যে নদী মরুপথে’, ‘দৃষ্টি’ ও ‘ফান্দে পড়িয়া বগা’ প্রভৃতি ছায়াছবির। বাংলাদেশ বেতারের বাণিজ্যিক কার্যক্রমের সঙ্গীত প্রযোজক হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন।
ভাষা আন্দোলন, পূর্ব পাকিস্তান আন্তঃকলেজ সাংস্কৃতিক সম্মেলন (১৯৫৫), কাগমারী সম্মেলন (১৯৫৭), ঢাকায় অনুষ্ঠিত যুব সম্মেলনে গান গেয়ে অভূতপূর্ব সাড়া জাগান। ষাট ও সত্তরের দশকে ঢাকার সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে তাঁর ছিল জাগরণী ভূমিকা। কঁচিকাচার মেলার সঙ্গীতশিক্ষা কেন্দ্র ‘সুরবিতান’ তাঁর হাতেই গড়ে ওঠে। উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী ও আফ্রো-এশিয়া গণসংহতি পরিষদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। আলতাফ মাহমুদ, শেখ লুৎফর রহমান ও আবদুল লতিফ তাঁর শিল্পীজীবনের বন্ধু। প্রগতিশীল সংস্কৃতিচর্চার ধারায় সুখেন্দু চক্রবর্তী মুক্তিযুদ্ধোত্তরকালেও অবদান রাখতে সক্ষম হন।
পঁচিশে মার্চের কালরাতের পর সপরিবারে কুমিল্লা শহর ছেড়ে সন্নিবর্তী ত্রিপুরার সোনামুড়ায় আশ্রয় নেন সুখেন্দু চক্রবর্তী। সেখান থেকে মে মাসের শেষ দিকে শরণ নেন উদয়পুরে, রাজারবাগ শরণার্থী শিবিরে। বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের নানা পর্যায়ে ভূমিকা পালনকারী এই শিল্পীর পক্ষে নিষ্কর্ম হয়ে বসে থাকার উপায় ছিল না। ভাবছিলেন কী করে নিজের শিল্পীসত্তার প্রকাশ ঘটাবেন জাতির এই সঙ্কটলগ্নে। উদয়পুরে শরণার্থী শিবিরে পেয়ে যান নিজ শহর এবং নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও ফেনীর কয়েকজন সংস্কৃতিপ্রেমী ও শিক্ষিত তরুণকে। তারাও কিছু করার কথা ভাবছিলেন। সুখেন্দু চক্রবর্তীকে পেয়ে তারা পথের দিশা খুঁজে পেলেন। তাঁদের নিয়েই গঠন করলেন ‘স্বাধীন বাংলা মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতিক সংঘ’। সঙ্গীত ও বক্তৃতার মাধ্যমে দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলা এবং বিপদের দিনে মনোবল অটুট রাখার লক্ষ্য নিয়ে সংগঠনটির জন্ম। এমন একটি সাংস্কৃতিক সংঘের কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য দরকার পড়লো পৃষ্ঠপোষকতার। এ কাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন উদয়পুর জেলার এডিএম শচীতানন্দ ব্যানার্জী। সুখেন্দু চক্রবর্তীর নেতৃত্বে সংঘের সদস্যদের তিনি ডেকে বললেন তাঁর কাছে কিছু তহবিল আছে। সংগীতের এই দলটিকে তিনি সহায়তাদানে ইচ্ছুক।
এজন্য সংঘটির সাংগঠনিক কাঠামো প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে উদয়পুরে বিভিন্ন ক্যাম্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজনীতিক ও জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে জাতীয় পরিষদ সদস্য ক্যাপ্টেন সুজাত আলী, চট্টগ্রামের আবদুল্লাহ আল হারুন, আবদুল্লাহ আল নোমান, নোয়াখালীর আবদুল মালেক উকিল, ফেনীর এবিএম তালেব আলী, শহীদউদ্দিন ইস্কান্দার কচি মিয়াকে উপদেষ্টা করে সংঘের কমিটি গঠিত হয়। সুখেন্দু চক্রবর্তী সভাপতি; সহ-সভাপতি নৃপেন্দ্র কুমার চক্রবর্তী, সাধারণ সম্পাদক মাহবুব চৌধুরী। সদস্যদের মধ্যে ছিলেন অভিজিৎ সাহা পিনাক, জোৎস্না রাণী ভৌমিক, মায়া সাহা, শাকিলা চৌধুরী, শর্মিষ্ঠা চৌধুরী, মলয় কর, অজয় চক্রবর্তী, দেবাশীষ চৌধুরী, প্রদোৎ পাল, সুকুমার সাহা, নীলিমা সাহা, রত্না বিশ্বাস ও আরও অনেকে। দলের সদস্যরা প্রত্যেকে একটি করে কম্বল পান এবং প্রত্যেকের মাসিক ভাতা ১৫০ টাকা। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সম্পৃক্ততার ফলে সংঘের কাজ বিস্তৃতি লাভ করে। বিশেষ করে পালাটানা ক্যাম্পের প্রধান সুজাত আলীর সহযোগিতা ছিল অকুণ্ঠ। সর্বোপরি সুখেন্দু চক্রবর্তী ছিলেন এ কর্মযজ্ঞের প্রাণপুরুষ।
শুরু হলো সাংস্কৃতিক সংঘের কার্যক্রম। সুখেন্দু চক্রবর্তী দেশ ছাড়ার সময় শত প্রতিকূলতার মধ্যেও হারমোনিয়ামটি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেটি দিয়ে রেওয়াজ চললো। মহড়ার জন্য পর্যাপ্ত পরিসর প্রয়োজন। এ কাজেও এগিয়ে আসেন শচীতানন্দ ব্যাণার্জী। সংঘের সহ-সভাপতি নৃপেন্দ্র কুমার চক্রবর্তী বলছিলেন, শচীতানন্দের স্ত্রী সাথী ব্যানার্জী কুমিল্লা শহরের মেয়ে এবং সুখেন্দু চক্রবর্তীর এককালীন ছাত্রী। রেওয়াজ ও মহড়ার জন্য তাঁদের ধনিসাগরপাড়ের সরকারি বাসা অবারিত করে দেন। শুধু তাই নয়, সাথী ব্যাণার্জী সংঘের সদস্যদের নিজ হাতে আপ্যায়ন করতেন। উদয়পুর রমেশ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ধীরেন দত্ত নিজ বাসায় রেওয়াজের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। আরও রেওয়াজ হতো জগন্নাথদিঘির পাড়ে তারু মিয়ার বাসায়। এভাবে ত্রিপুরাবাসীর আন্তরিক সহযোগিতায় সংঘের কার্যক্রম বিশেষ গতি লাভ করে।
জনগণের মনোবল বৃদ্ধি ও দেশকে স্বাধীন করার দীপ্তমন্ত্রে উজ্জীবনের লক্ষ্যে সুখেন্দু চক্রবর্তী গণসঙ্গীতের দল নিয়ে সেদিন পালন করেছিলো সোচ্চার ভূমিকা। সুখেন্দু চক্রবর্তীর নেতৃত্বে গীত গানগুলির মধ্যে ছিল ‘যুদ্ধ যুদ্ধ বাংলায় যুদ্ধ’, ‘ইতিহাস জান তুমি আমরা পরাজিত হইনি’, ‘ওরা নাকি আমাদের ক্ষেতে আর খামারের সবুজের স্বপ্ন কেড়ে নিতে চায়’, ‘চেয়ে দেখ পূবাকাশ লালে লাল হয়ে গেছে’, ‘মা গো তোমার জন্য জীবন দিলাম’, ‘ভয় কী মরণে’, ‘ঐ না নদীর তীরে তীরে সবুজ শ্যামল গাঁওরে’, ‘আমরা করি না ভয়, অত্যাচারের হিমালয়’ প্রভৃতি। মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস কণ্ঠসৈনিক হিসেবে শরণার্থী শিবির, যুব শিবির ও মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে অবিরাম জাগরণী গান গেয়ে ফিরেছে এ সংঘ। ক্যাম্পগুলির মধ্যে ছিল পালাটানা, কোনাবন, ধ্বজনগর, খিলপাড়া, রাজারবাগ, মাতারবাড়ি প্রভৃতি। এছাড়া বিভিন্ন স্কুলের মাঠ ও জনাগমন স্থলেও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। এর মধ্যে রয়েছে মেলাঘর ও কাকড়াবন হাই স্কুল মাঠ। অনুষ্ঠানগুলিতে স্থানীয় জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল প্রেরণাদায়ী। দলের মধ্যে অধিকাংশ ছিলেন শিক্ষিত যুবক। তারা নানা পর্যায়ের শিক্ষকতা করতেন। গণসঙ্গীতের অংশগ্রহণের পাশাপাশি তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও যৌক্তিকতা বক্তৃতার মাধ্যমে তুলে ধরতেন। গানের মাঝে মাঝে চেতনার প্রকাশ পুরো অনুষ্ঠানকে দিয়ে যেত ভিন্ন মাত্রা। গানের আসর বসতো সন্ধ্যায়। সুখেন্দু চক্রবর্তীর উদাত্ত কণ্ঠের সঙ্গে দলের তরুণপ্রাণের মিলনে সৃষ্টি হতো অন্য রকম শিহরণ। দেশমাতৃকার মুক্তির আকুতি ছেয়ে যেত পুরো পরিবেশ। বিপদে ধৈর্য ধারণ ও মাতৃভূমিকে মুক্ত করার প্রবল প্রত্যয় জেগে ওঠতো মুক্তিযোদ্ধাদের মনে, যুবশিবিরবাসীর প্রাণে, শরণার্থী শিবিরের প্রতিটি মানুষের অন্তরে। সংঘের সাধারণ সম্পাদক মাহবুব চৌধুরী বলছিলেন, গান শুনে স্থানীয় লোকজন স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাহায্য করতো। সেই অর্থ প্রদান করা হতো মুক্তিযোদ্ধা শিবিরের তহবিলে।
উদয়পুর রাজারবাগ শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে এসেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহ ও ডেপুটি স্পীকার এরশাদ আলী চৌধুরী। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সমবেত দেশাত্মবোধক গানের পর সুখেন্দু চক্রবর্তী নিবেদন করেন ‘মুজিব বাইয়া যাও রে, নির্যাতিত জাতির মাঝে জনগণের নাওরে মাঝি বাইয়া যাও রে’ গানটি। ইন্দিরা গান্ধী গানটি শুনে খুশি হয়ে বললেন, খুব আচ্ছা গান গায়া তুম। অনেক মানুষের প্রাণের আকুতি প্রকাশ পেয়েছিল সেসব দিনের গানে। এভাবে সুখেন্দু চক্রবর্তীর নেতৃত্বে ‘স্বাধীন বাংলা মুক্তিযোদ্ধা সাংস্কৃতিক সংঘ’ মুক্তিকামী প্রতিটি মানুষ ও উদয়পুরবাসীর মনে সাহস সঞ্চার করেছিলো; শক্তি জুগিয়েছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের। কত মানুষের কত রকম ভূমিকার ফলে মুক্তিযুদ্ধ বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছিল এ সংঘের গঠন ও কার্যক্রমের মধ্যে তা উপলব্ধি করা যায়। যে অনন্য ভূমিকা রেখে গেছে তারা স্বাধীনতার জন্য তা ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছে; অমলিন হয়ে আছে মানুষের অন্তরে। তাই স্মরণ করি মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদান রচনাকারী সুখেন্দু চক্রবর্তীসহ দলের সবাইকে, যাঁরা এ প্রয়াসে যুক্ত হয়েছিলেন আন্তরিকভাবে; স্বপ্ন দেখেছিলেন তিমির বিনাশে। সবার প্রতি গভীর প্রণতি, সালাম।
স্বাধীনতা সঙ্গীত দল
১৯৭১। ত্রিপুরার আগরতলার নোয়াবাদী শরণার্থী শিবির থেকে একটি গণসঙ্গীতের দল বের হলো। পঞ্চাশোর্ধ সৌম্যকান্তির একজন মানুষ কাঁধে হারমোনিয়াম বেঁধে উদাত্ত কণ্ঠে গণসঙ্গীত গাইছেন, তাঁকে অনুসরণ করছেন ১০-১২ জন নবীন-নবীনা। একের পর গান গেয়ে অগ্রসর হচ্ছে এ দল। দেশের গান, দুর্দিনে ধৈর্য্য ও মনোবল অটুট রাখার গান; প্রবল প্রতিরোধ ও সংগ্রামের গান। তারা গান গেয়ে চলেছেন শরণার্থী শিবিরে, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে, পথিমধ্যে কোনো জনসমাবেশে। হারমোনিয়াম কাঁধে সেই মানুষটি আর কেউ নন। তিনি কুমিল্লা শহরের গণমানুষের শিল্পী ওস্তাদ কুলেন্দু দাস। একাত্তরের মে মাস থেকে দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত জাগরণের এই প্রয়াস তিনি অব্যাহত রেখেছিলেন।
কুমিল্লা জেলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে শচীন দেববর্মণ, ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, সুরসাগর হিমাংশু দত্ত, ফজলে নিজামী, সুখেন্দু চক্রবর্তী যে মাত্রা সৃষ্টি করেছিলেন সঙ্গীত ও নৃত্যশিল্পী কুলেন্দু দাসের (১৯২০-১৯৮৫) নাম একই সূত্রে গাঁথা। সঙ্গীতশিক্ষার হাতেখড়ি জ্যেষ্ঠবোন শিল্পী শৈল দেবীর কাছে। তালিম গ্রহণ কবি নজরুলের কাছে। তাঁর নামটিও নজরুলেরই দেয়া। খেয়াল, ঠুংরী, রাগপ্রধান, টপ্পা ও গণসঙ্গীতে তিনি অর্জন করেছিলেন বিশেষ দক্ষতা। শ্যাম ভট্টাচার্যের নিকট নৃত্যশিক্ষা লাভকারী এই কৃতী শিল্পীর কম্পোজকৃত নৃত্যের মধ্যে রয়েছে ‘সাপুড়ে’, ‘শিকারী’, ‘জিপসী’, ‘রানার’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘কোন এক গাঁয়ের বধূর কথা শোন’, ‘কারার ঐ লৌহকপাট’। রচনা, সুরারোপ ও পরিচালিত নৃত্যনাট্য ‘ঝরাফুল’, ‘নবান্ন’, ‘নিদয়া গোমতী’। ‘ফসলের ডাক’, ‘তাসের দেশ’, ‘ভাঙ্গাগড়া নোয়াখালী’, ‘এক দশকের বাংলাদেশ’ প্রভৃতি নৃত্যনাট্যে সঙ্গীত ও নৃত্য পরিচালনা করেন। চল্লিশের দশকে আকাশবাণী, পরে রেডিও পাকিস্তান ঢাকা ও চট্টগ্রাম কেন্দ্রে নিয়মিত সঙ্গীত পরিবেশন করতেন কুলেন্দু দাস। সম্পৃক্ত ছিলেন পল্লী উন্নয়ন একাডেমীর সমবায় আন্দোলনে। ‘বাণীবিতান’, ‘সুরবিতান’, ‘কুমিল্লা সঙ্গীত বিদ্যালয়’ ও ‘নোয়াখালী সঙ্গীত বিদ্যালয়’ স্থাপনের মাধ্যমে প্রসার ঘটান সঙ্গীতশিক্ষার।
ভাষাআন্দোলন, সাংস্কৃতিক সম্মেলন ও ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে দেশাত্মবোধক ও গণসঙ্গীতের মাধ্যমে তিনি সৃষ্টি করেন গণজাগরণ। শহরের সংস্কৃতিচর্চায় তাঁর ছিল বিরাট ভূমিকা। একাত্তরের বৈরী পরিস্থিতিতে সপরিবারে চলে আসেন ত্রিপুরার আগরতলায়। আশ্রয় নেন আগরতলার সন্নিহিত পশ্চিম নোয়াবাদী শরণার্থী শিবিরে। কিন্তু এই সংস্কৃতিগত দেশপ্রাণ মানুষটির পক্ষে মাতৃভূমির ঘোর দুর্দিনে হাত গুটিয়ে বসে থাকা সম্ভব ছিল না। কন্ঠকে অস্ত্র করে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন সাংস্কৃতিক যুদ্ধে। শরণার্থী শিবিরে বসেই তবলাবাদক শেফাল রায়-সহযোগে গঠন করেন ‘স্বাধীনতা সঙ্গীত দল’। সেই দলে আরও ছিলেন কুলেন্দু দাসের সন্তান কল্যাণ দাস, কণিকা দাস, বেবী দাস, কৃষ্ণ দাস; শেফাল রায় এবং তাঁর কন্যা দীপালি রায়; উমা, হেনা, শান্তি- আরো অনেকে। দল তো গঠন হলো, হারমোনিয়াম পাবেন কোথায়? শরণার্থী শিবিরে ওস্তাদ কুলেন্দু দাসের আগমনের কথা শুনে স্থানীয় পঞ্চায়েত-প্রধান তার মেয়েকে গান শেখাতে বলেন। সেখান থেকে সংগৃহীত হলো হারমোনিয়াম। শেফাল রায় কোত্থেকে জোগাড় করলেন তবলা। রেওয়াজও চললো পঞ্চায়েত-প্রধানের বাড়ি কিংবা শিবিরের অপেক্ষাকৃত কোলাহলমুক্ত পরিসরে। দলের জন্য পুরোনো গান নয়, সময়ের প্রয়োজনে নিজে গণসঙ্গীত লেখা শুরু করলেন কুলেন্দু দাস। শরণার্থী শিবিরে বসে গান লিখেছেন, বেঁধেছেন সুর। সেই গান নিবেদন করেছেন জনতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সমীপে। এভাবে পশ্চিম নোয়াবাদী শরণার্থী শিবির, গোমতী যুবশিবির, দুর্গা চৌধুরীপাড়া যুবশিবির, ইছামতি যুবশিবির প্রভৃতি স্থানে গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপ্ত করার কাজে ব্রতী হন। গণসঙ্গীত পরিবেশনের সময়ে যুবশিবিরের শত শত মুক্তিযোদ্ধা স্লোগান ধরতো- ‘জয় বাংলা’! মনে হতো গানের বাণী আপ্লুত করছে প্রতিটি মুক্তিকামী তরুণের মন।
কীর্তিমান এই শিল্পীর জীবন ও কর্ম নিয়ে প্রণীত স্মারকগ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধকালে রচিত গানগুলি সংকলিত হয়েছে। মলিন-পাণ্ডুর গানের সেই খাতাটি আজও আগলে রেখেছেন সেদিনের দলের যাত্রী ও কুলেন্দু দাসের মেজোপুত্র কল্যাণ দাস। গানগুলির প্রতিটি অক্ষর রক্তঝরা দিনগুলিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। স্মরণ করিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধে অসংখ্য মানুষের আত্মদানের কথা, অশ্রু ও বিষাদের গান। মুক্তিযুদ্ধে নানা জায়গায় নানা সাংস্কৃতিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। এর মূল লক্ষ্য ছিল সাংস্কৃতিকভাবে মানুষকে মুক্তিচেতনায় উজ্জীবিত করা। সেক্ষেত্রে ‘স্বাধীনতা সঙ্গীত দল’-এর ভূমিকা বিশেষ গুরুত্ববহ। কত মানুষের কত রকম ত্যাগ ও সাধনার মাধ্যমে সেদিন বিজয় অর্জিত হয়েছিল সেকথা আমরা যেন ভুলে না যাই। তাই শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করি গণজাগরণের শিল্পী কুলেন্দু দাসের প্রতি, স্মরণ করি মহৎ সেই কাজের সঙ্গে জড়িত প্রতিটি মুক্তিকামী প্রাণকে। শিবিরের মুক্তিযোদ্ধাদের মতো আজ দীপ্ত কণ্ঠে বলে উঠি- ‘জয় বাংলা!’
মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধের পাশাপাশি নানা শ্রেণি-পেশার পালন করেছিলেন বিরাট ভূমিকা। সেদিন শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা অন্তরের দরদ ঢেলে শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের যে সাহস জুগিয়েছিলেন তা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তেমন গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু সেদিনের প্রেক্ষাপটে শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের ভূমিকা ও অবদানকে কোনো মতে উপেক্ষা করা যায় না। তাদের ভূমিকা সম্পর্কে পত্র-পত্রিকায় কমই লেখালেখি হয়েছে। এজন্য তা বিদ্বৎসমাজের আলোচনায়ও তেমন ওঠে আসেনি। কিন্তু জনসমাজের স্মৃতিসত্তায় তা আজও জাগরূক আছে। শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের ভূমিকায় অসহায় মানুষ যে সেদিন ভরসা পেয়েছিলেন, মুক্তিযোদ্ধারা পেয়েছিলেন বিপুল উদ্দীপনা নানাজনের স্মৃতিচারণায় এর সাক্ষ্য মেলে। আজ তাই গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি তাদের, যারা জাতির দুর্দিনে সংস্কৃতির অমিয়ধারায় উজ্জীবিত করেছিলেন মানুষকে, জাগিয়ে তুলেছিলেন মুক্তির তৃষ্ণা, ছড়িয়ে দিয়েছিলেন মুক্তির বারতা।