মহামারি করোনা সংক্রমণের শুরুতে ২০২০ সালে আমাদের অনেকের ভয় ও ধারণা ছিল অধিকাংশ অপুষ্টিতে ভোগা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করা, উন্নত চিকিৎসার বাইরে থাকা এই দেশের মানুষ অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় অধিক হারে আক্রান্ত হবে এবং মৃত্যুতে পর্যবসিত হবে! তখন আমাদের মনোবল ধরে রেখেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর দক্ষ নেতৃত্ব ও সফল পদক্ষেপের ফলে পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ সফলতা দেখাতে সক্ষম হয়েছে মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায়।
তবে শিক্ষাক্ষেত্রে ২০২০ সালে আমাদের সফলতা এবং ব্যর্থতা বা হতাশা উভয়ই ছিল উল্লেখযোগ্য। আমরা জেএসসি, এইচএসসি, বার্ষিক ও অন্যান্য অনেক পরীক্ষা নিতে ব্যর্থ হয়ে অনেকটাই হতাশাগ্রস্ত হয়েছি। শেষে মন্দের ভালো হিসেবে বিকল্প পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন এবং উপরের শ্রেণিতে অটো প্রমোশনের ব্যবস্থা আমরা করতে সক্ষম হয়েছি অধিকাংশ ক্ষেত্রে। যদিও এই অটোপাস সম্মানজনক নয় কোনো শিক্ষার্থীর জন্যই। আগামীতে এমনটি আর করতে হবে না আশা করি। শিক্ষা মূল্যায়নে আসবে যুগোপযোগী অনুকূল পরিবর্তন।
করোনা পরিস্থিতির কারণে ৯ মাসেরও অধিক সময় সরাসরি শ্রেণি পাঠদান চালিয়ে যেতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। তবে অনলাইন এবং টেলিভিশনে পাঠদানের মাধ্যমে আমরা সে ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে দিতে পেরেছি এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জীবন তুলনামূলক ঝুঁকিমুক্ত রাখতে পেরেছি। সেই সাথে আমরা অনলাইন পাঠদান ও পাঠ গ্রহণে কিছুটা দক্ষতা-সমৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। যার দ্বারা ২০২০ সালের ক্ষতি ২০২১ সালে আরও কিছুটা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে বলে প্রত্যাশা করছি।
শিক্ষক-শিক্ষার্থী নির্যাতনের নিষ্ঠুর সংবাদে ২০২০ সালে বারবার মর্মাহত ও হতাশাগ্রস্ত হয়েছি আমরা। বিশেষ করে শিশুশিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা ছিল সর্বাধিক সমালোচিত। চুপি চুপি সংঘটিত হয়েছে অগণিত মেয়ে শিশুর বাল্যবিয়ে। কাজে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছে অসংখ্য ছেলে শিশু। লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে অনেক শিক্ষার্থী। প্রায় সকল শিক্ষার্থী নিমজ্জিত হয়েছে কম-বেশি হতাশায় ও বিষণ্নতায়! এসব ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে ২০২১ সালে উত্তরণ সম্ভব হবে বলে প্রত্যাশা করি।
বেসরকারি শিক্ষক সমাজের আর্থিক স্বচ্ছলতা নিশ্চিত করার অনেক দাবিদাওয়া থাকলেও ২০২০ সালে আমরা তা পূর্ণ করতে সক্ষম হইনি। সর্বাধিক উচ্চারিত দাবি ছিল সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একযোগে সরকারিকরণের। ‘শিক্ষাব্যবস্থা’ জাতীয়করণ চাই, এমন একটি স্লোগানে বারবার উচ্চারিত হয়েছে এই দাবি। তাছাড়া এমপিও নীতিমালা সংশোধনের ক্ষেত্রে শিক্ষকগণ প্রত্যাশা করেছিলেন সরকারিদের মতো বেসরকারিদের বদলি ও পদন্নতির ব্যবস্থা করা হবে এবং অনার্স-মাস্টার্স পর্যায়ে পাঠদানরত নিয়মিত নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করার ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু উল্লেখযোগ্য তেমন কিছুই হয়নি! যা শিক্ষক সমাজের জন্য অত্যন্ত হতাশার কারণ। ২০২১ সালে এই হতাশা থেকে শিক্ষকগণ মুক্তি পাবেন এই প্রত্যাশা করছি। আরো আশাকরি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উন্নীত হবে শিক্ষার বাজেট এবং নিশ্চিত হবে অধিক যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ। পূর্ণ হবে বিভিন্ন পর্যায়ে সকল শিক্ষকের শূন্য পদ।
ইতোমধ্যে জাতীয়করণকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীদের সরকারি বেতন প্রাপ্তির কাজ ২০২১ সালের প্রথমার্ধেই সম্পন্ন হবে বলে আশা করছি। সেইসঙ্গে সবার জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অবৈতনিক বা জাতীয়করণকৃত শিক্ষাস্তর প্রাথমিক পর্যায় থেকে উচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করার প্রত্যাশা করছি। একমুখী শিক্ষার বাস্তবায়ন ও কারিগরি তথা কর্মমুখী শিক্ষার সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে আশা করছি ২০২১ সাল হবে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক।
সবচেয়ে বড় কথা, এত কঠিন সময় পার করার পরেও ২০২১ সালের শুরুতেই আমরা প্রায় সাড়ে ৪ কোটি শিক্ষার্থীর হাতে প্রায় সাড়ে ৩৫ কোটি নতুন বই বিনামূল্যে তুলে দিতে সক্ষম হয়েছি। যা শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যাশা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষকগণ অনলাইন ক্লাসে প্রথম দিকে ততটা দক্ষ ও সক্রিয় ছিলেন না। ক্রমাগত তাদের দক্ষতা ও আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ২০২১ সালে তা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উন্নীত হবে বলে প্রত্যাশা করছি। কেননা, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও ফুরিয়ে যাবে না অনলাইন ক্লাসের গুরুত্ব। কেননা, অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমেই আজ প্রমাণিত হয়েছে ‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র’-এই বাক্যের সত্যতা ও বাস্তবতা। যদিও এটি শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের শতভাগ সফল বিকল্প নয়। তাই প্রত্যাশা করছি, করোনা মোকাবিলা করে ২০২১ সালেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ফিরে যাবেন তাদের প্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষে। পুষিয়ে উঠবেন শিক্ষা ক্ষেত্রের সকল ক্ষতি। প্রমাণ করবেন বাঙালিরা বীরের জাতি।
লেখক: অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা