নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরী এবং বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জার বাক্যুদ্ধে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে স্থানীয় রাজনীতি। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (২১ জানুয়ারি) একরামুল করিম চৌধুরীর ভিডিওবার্তাকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতিও আরও অশান্ত হয়ে উঠেছে। এমন পরিস্থিতিকে দলের জন্য অশনিসংকেত বলে মনে করছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা।
বৃহস্পতিবার ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওবার্তায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে রাজাকার পরিবারের সদস্য বলে মন্তব্য করেন একরামুল করিম চৌধুরী। তার এই বক্তব্যের প্রতিবাদে ক্ষেপে ওঠেন বসুরহাট পৌরমেয়র আবদুল কাদের মির্জাসহ দলের নেতাকর্মীরা।
এদিকে, এমপির কর্মী-সমর্থকরাও নিজেদের অবস্থানে অনড়। শুক্রবার ও শনিবার উভয়পক্ষই মিছিল-মিটিং করেছে। একরামুল করিম চৌধুরীকে দল থেকে বহিষ্কারের দাবিতে শুক্রবার থেকে শনিবার বেলা ১১টা পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন কাদের মির্জাপন্থীরা। একরামুল করিম চৌধুরীকে ‘মাতাল’ আখ্যায়িত করে আবদুল কাদের মির্জা বলেন, ‘মাতাল একরামুল করিম চৌধুরী মদ খেয়ে আমাদের রাজাকার পরিবারের সদস্য বলায় পুরো নোয়াখালী উত্তাল। তাকে দল থেকে বহিষ্কারের দাবিতে লাগাতার কর্মসূচির ঘোষণা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে কটূক্তি করায় এই কর্মসূচি দেওয়া হয়। একরামুলকে বহিষ্কার না করা পর্যন্ত রোবাবার হরতাল ডাকা হয়েছে। হরতাল শেষে আরও কর্মসূচি ঘোষণা দেবো।’ কাদের মির্জা আরও বলেন, ‘অনেক দিন অপেক্ষা করেছি। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নির্দেশে বসুরহাট বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল থেকে আমাদের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নিয়েছিলাম। আমরা কি বিচার পেয়েছি? একরাম চৌধুরী মাতাল অবস্থায় আমাদের নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে চরম কটূক্তি করেছেন। একরামুল করিম চৌধুরীকে দল থেকে বহিষ্কারসহ জেলা কমিটি বাতিল করা পর্যন্ত আমাদের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।’
এর আগে, বৃহস্পতিবার রাতের ভিডিওবার্তায় একরামুল করিম চৌধুরী বলেন, ‘আমি কথা বললে তো আর মির্জা কাদেরের বিরুদ্ধে কথা বলবো না। কথা বলবো ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধে। একটা রাজাকার পরিবারের লোক এই পর্যায়ে এসেছেন। তার ভাইকে শাসন করতে পারেন না। এগুলো নিয়ে আমি আগামী কয়েক দিনের মধ্যে কথা বলবো। আমার নাম যদি জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি না আসে। তাহলে আমি এটা নিয়ে শুরু করবো।’
একরাম চৌধুরীর এই বক্তব্য ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার পরতার কর্মী-সমর্থকরা নোয়াখালীর মাইজদী শহরের হাউজিং এলাকা, জয়কৃষ্ণপুর, মাইজদী বাজার, লক্ষ্মীনারায়ণপুর, ল’ইয়ার্স কলোনি, কলেজ পাড়ায় বিক্ষোভ মিছিল করেন। প্রথমে খণ্ড খণ্ড মিছিল করলেও পরে তারা শহরের প্রধান সড়কে জমায়েত হয়ে মিছিল করেন। মিছিলে তারা কাদের মির্জার বিরুদ্ধে স্লোগান দেন। এই সময় বেশ কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণের শব্দে চারদিক কেঁপে ওঠে। শুক্রবার বিকালেও তারা মিছিল করেন।
শুক্রবার দুপুরে সামাজিক যোগাযোগের লাইভে এসে একরামুল করিম চৌধুরী বলেন, ‘আমি ওবায়দুল কাদের সাহেবকে নয়, মির্জা কাদেরকে বলেছি। কারণ ওবায়দুল কাদের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও কমান্ডার। মির্জা কাদেরের পরিবার মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী পরিবার।’
একরামুল করিম চৌধুরী এমপি বলেন, ‘শুক্রবার আমার স্ট্যাটাসের পর আমার পক্ষে, দলের পক্ষে বিক্ষোভ মিছিল করে, প্রতিবাদ করেছেন নেতাকর্মীরা।’ এজন্য তিনি নেতাকর্মীদের ধন্যবাদ জানিয়ে একরাম চৌধুরী বলেন, ‘আপনারা আজ আর কোনো প্রতিবাদ বিক্ষোভ করবেন না। আপনারা যদি দলকে ভালোবাসেন, দলের প্রধান শেখ হাসিনাকে ভালোবাসেন, ওবায়দুল কাদেরকে ভালোবাসেন, শেখ হাসিনার উন্নয়নের ধারা ধরে রাখতে চান, তাহলে আর নিজেদের মধ্যে বিরোধ নয়। আমাদের মধ্যে কোনো দূরত্ব থাকলে সিনিয়র নেতারা ডেকে তা সমাধান করে দেবেন।’
তবে, দলের এই দুই নেতার বাক্যুদ্ধকে নোয়াখালীতে দলের রাজনীতির জন্য অশুভ বলে মনে করছেন বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা। তারা মনে করছেন, এ দুই নেতাকে পরস্পরের বিরুদ্ধে উসকে দিয়ে একটি মহল ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপচেষ্টা করছে। তারা এই দুই নেতাকে যেমন বিভ্রান্ত করছেন, তেমনি দলকেও সাধারণ মানুষের কাছে হেয় করছেন।
এই প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নেতা বলেন, ‘ওবায়দুল কাদেরের পরিবারকে রাজাকার বলে ঠিক করেননি একরামুল করিম চৌধুরী। আরও দায়িত্বশীল হয়ে তার কথা বলা উচিত। ওবায়দুল কাদেরের মুক্তিযুদ্ধের সময় বীরত্বগাথা, যুদ্ধের কথা সবাই জানে। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দুই বারের সাধারণ সম্পাদক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন না হলে ওবায়দুল কাদের এই পদে আসতে পারতেন না। দলের জন্য তার যে অবদান, তা তৃণমূল নেতারা জানেন।’
স্থানীয় নেতারা আরও বলেন, ‘তিনি ৭৫-পরবর্তী সময় ছাত্রলীগকে সংগঠিত করেছেন। জেলে থেকে নেতৃত্ব পেয়েছেন। এরপর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দেলনে বার বার নির্যাতিত হয়েছেন। বহুবার জেল খেটেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দলকে তৃণমূল পর্যায়ে দাঁড় করিয়েছেন। বিদেশিরা যখন ফিরে গেছেন, শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর দায়িত্ব ওবায়দুল কাদেরের হাতে তুলে দিয়েছেন। যেখানে নেত্রী তাকে বিশ্বাস করে দলের দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন, সেখানে ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে তৃণমূল পর্যায় ঐক্যবদ্ধ। তাই একরামুল করিম চৌধুরীকে আরও সংযত হয়ে কথা বলা উচিত।’
অন্যদিকে, জেলা আওয়ামী লীগে ও অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা বলেন, ‘৭৫ পরবর্তী সময় ও আবদুল মালেক উকিলের মৃত্যুর পর নোয়াখালীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতি এক প্রকার কোণঠাসা অবস্থায় চলে গিয়েছিল। তৎকালীন নেতারা অন্য দলের নেতাদের সঙ্গে ব্যালেন্স করে চলতেন। দলের চেয়ে নিজেকে প্রাধান্য দিতেন বেশি। কিন্তু একরামুল করিম চৌধুরী দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর তৃণমূল পর্যায়ে দলকে দাঁড় করিয়েছেন। যে জেলা এক সময় বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল, তা আজ শেখ হাসিনার দুর্গ। একরামুল করিম চৌধুরীর ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বে তা আজ সম্ভব হয়েছে।’ তারা বলেন, ‘দ্বিধা-বিভক্তি ভুলে দলকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে।’ ওবায়দুল কাদের ও একরাম চৌধুরী মিলে এই জেলা আওয়ামী লীগকে আরও গতিশীল করতে পারেন বলেও তারা মনে করেন।