পাট সংকট ও অস্বাভাবিক মূল্য বেড়ে যাওয়ায় বন্ধ হওয়ার পথে বগুড়ার জুট মিলগুলো। ইতোমধ্যে উৎপাদন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি জুটমিল। তবে, এসব মিলের কেনা পাট শেষ হয়ে গেলে নতুন করে আর কিনবেন না বলে জানিয়েছেন মালিকরা। বন্ধ রাখবেন তাদের পাটজাত পণ্যের উৎপাদনও।
পাট অধিদপ্তর বলছে, কয়েক দফা বন্যার কারণে এবার উৎপাদন কমে গেছে। বাজারে পাট নেই। কেউ কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে না। মিল মালিকরা বলছেন, উৎপাদন ঘাটতি থাকার পরেও বিদেশে রপ্তানি করায় বাজারে পাটের সংকট দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, জেলায় ১৮টি ছোট বড় জুট মিল রয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি জুট মিল পাটজাত পণ্য উৎপাদন করে ভারতে রপ্তানি করে। ২০১৯ সালে পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছিল ১ কোটি ৪৭ লাখ ৭৯ হাজার ৭৩২ মার্কিন ডলার। যা বাংলাদেশি টাকায় দাঁড়ায় ১২১ কোটি ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ২৪ টাকা।
২০২০ সালে করোনা সংকটের মধ্যেও বগুড়া থেকে ১ কোটি ২৩ লাখ ৬ হাজার ৪৯ মার্কিন ডলারের পাট নেয় ভারত। যা বাংলাদেশি টাকায় দাঁড়ায় ১০০ কোটি ৯ লাখ ৯৬ হাজার ১৮ টাকা।
পাট সংকটের কারণে অধিকাংশ জুট মিল বন্ধের পথে। এই মিলগুলোতে কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করেন। পাটের অত্যাধিক মূল্য এবং সংকটের কারণে মিলগুলো বন্ধ হয়ে গেলে কর্মহীন হয়ে পড়বেন জুটমিলের শ্রমিকরা।
বগুড়া আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছর কয়েক দফা বন্যায় ৪ হাজার ৫৭৮ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। এই পরিমাণ জমি থেকে ১০ হাজার ৯৮৭ মেট্রিক টন পাট উৎপাদন হওয়ার কথা ছিল। গত বছর পাট চাষের জমির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৩ হাজার ৪১৫ হেক্টর জমি। সেখানে পাট চাষ হয়েছিল ১২ হাজার ১৫ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২৭ হাজার ৪৫৬ মেট্রিক টন। বন্যার কারণে উৎপাদন হয়েছে মাত্র ১৭ হাজার ৮৩৩ মেট্রিক টন।
বগুড়ার গাবতলী উপজেলার পাটব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম বলেন, বন্যায় এবার পাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। উৎপাদনও কমে গেছে। মৌসুম শেষে পাট নেই। তাই দামও বেশি। ভরা মৌসুমে পাটের মণ দাম ছিল ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা। তবে, নভেম্বর মাসের শেষ থেকে পাটের দাম ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার পর্যন্ত বাড়ে। এরপর জানুয়ারির প্রথম থেকে পাট ৩ হাজার ৫০০ টাকা হলেও বর্তমান বাজারে পাট বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার থেকে ৪ হাজার ৫০০ টাকায়। অথচ গত বছর এরকম সময় উন্নত মানের পাটের দাম ছিল সর্বোচ্চ ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৭০০ টাকা।
হাসান জুট মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এটিএম শফিকুল হাসান বলেন, ‘পাটের সংকট ও কাঁচামালের দাম বেশি হওয়ায় প্রতিষ্ঠান প্রায় বন্ধের পথে। আমার এখানে ১ হাজার ৫০০ শ্রমিক কাজ করতেন। বর্তমানে ২০০ থেকে ৩০০ শ্রমিককে দিয়ে স্বল্প পরিসরে কাজ করাচ্ছেন। গত বছর তার প্রতিষ্ঠান থেকে ১ কোটি ৮ লাখ ৪০ হাজার ১৫২ মার্কিন ডলারের পাটজাত পণ্য ভারতে বিক্রি করেছি। ২০১৯ সালে রপ্তানি করেছি ১ কোটি ৩৬ লাখ ৬০ হাজার ৭৩৫ ডলারের পাটজাত পণ্য। তবে পাটের দাম বেশি হওয়ায় এবার রপ্তানি চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন সম্ভব হবে না।’
শেষবার তিনি মণ প্রতি ৩ হাজার ৫০০ টাকা করে ৪৫ টন পাট কিনেছেন বলে জানান শফিকুল হাসান। তিনি বলেন, ‘বর্তমান বাজারে পাটের দাম ৪ হাজারেরও বেশি। দেখা যাচ্ছে একটি পণ্যের দাম যেখানে ১০ টাকা, সেখানে কাঁচা মালের দাম পড়ছে ২০ টাকা। যে কারণে উৎপাদন বন্ধ রেখেছি।’ বগুড়া জুট মিলসের পরিচালক বিজয় বিহানী বলেন, ‘আমরা ভারতে পাটজাত পণ্য রপ্তানি করি। গত বছর ১৪ লাখ ৬ হাজার ২৭২ মার্কিন ডলারের পাটের বস্তা রপ্তানি করেছি। আমার প্রতিষ্ঠানে দুই শিফটে আগে ১ হাজার শ্রমিক কাজ করতেন। পাটের দাম বেশি হওয়ায় আগে যে পাট কিনেছি, সেগুলো দিয়ে পণ্য তৈরি করছি। এই পাট শেষ হয়ে গেলে আর পাট কিনবো না। উৎপাদন বন্ধ রাখবো। তবে বর্তমানে ৫০০ শ্রমিককে দিয়ে কাজ করাচ্ছি। পাট সংকটের জন্য আমি বিদেশে পাট রপ্তানিকেই প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।’
বিজয় বিহানী বলেন, ‘বন্যায় ক্ষতির কারণে এমনিতেই পাটের ঘাটতি ছিল। সেখানে কাঁচামাল দেশের বাইরে রপ্তানি করায় পাট পাচ্ছি না। দামও বেশি।’
একই অভিযোগ নর্থ বেঙ্গল গোল্ডেন ফাইবার অ্যান্ড ডাইভারসিফাইড জুট মিলসের পরিচালক সুভাষ প্রসাদ কানুরও। তিনি বলেন, ‘বন্যায় ক্ষতির চেয়েও রপ্তানিই দেশের পাট সংকটের প্রধান কারণ। গত ৩ মাস ধরে পাট কিনতে পারছি না। দাম বেশি। কিছু পাট আছে। যেগুলো শেষ হয়ে গেলে আপাতত উৎপাদন বন্ধ রাখবো। তার প্রতিষ্ঠানে ৩৫০-এর বেশি শ্রমিক ছিলেন। এখন শ্রমিকের সংখ্যা অর্ধেকেরও নিচে নামিয়ে এনেছি। তবে, নতুন পাট উঠলে আবারওপুরোদমে পাটজাত পণ্যের উৎপাদন শুরু করবো।’
বগুড়া পাট অধিদপ্তরের মুখ্য পরিদর্শক সোহেল রানার বলেন, ‘বন্যার কারণে এবার পাটের উৎপাদন অনেক কম। রপ্তানি তো আগে থেকেই হচ্ছে। মাঝখানে বন্ধ ছিল। এরপর আবারও চালু হয়েছে। তবে, পাট রপ্তানি না করলে কিছু তো থাকতো। দাম কমার কারণে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের মজুদ রাখা পাট ছেড়ে দিতে বলা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বগুড়ায় যারা পাটের মজুদদার, তাদের অধিকাংশের কাছেই পাট নেই। যে দুই-একজনের কাছে আছে, তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। যা পাট আছে, সেগুলো ১ সপ্তাহের মধ্যে ছেড়ে দিতে বলা হয়েছে।’ তারা বর্তমান বাজারে ছাড়বেন বলেও তিনি জানান।