সাতসতেরো

বিপদ দেখলেই শুয়ে পড়ে শাবাজ ট্রিটি

শাবাজ ট্রিটি’র জন্য বহু দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। পাখিটি মাঝে মাঝে রাজশাহীতে দেখা যায়। কয়েকবার সেখানে গিয়েও পাখিটির দেখা পাইনি। তবে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় বেশ দেখা যায়। গত বছর তেঁতুলিয়া যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। কিন্তু কোভিড-১৯ এর জন্য যাওয়া হয়নি। অপেক্ষায় ছিলাম যে কোনো একদিন পাখিটির দেখা পাবো।

এ বছর জানুয়ারি মাসের ২৪ তারিখ হাঁস জাতীয় পাখির ছবি তোলার জন্য সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে গিয়েছিলাম। ভোরে সুনামগঞ্জ নেমে মোটরসাইকেলে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওরে পৌঁছে ‘হাওর বিলাস’-এ উঠলাম। রুমে ব্যাগ রেখে রফিকুলের নৌকায় রওনা হলাম।

নাওটানা খালে গজাইরা ও গুফেসহ নানা প্রজাতির হাঁস পাখির কলতানে মুখরিত ছিল। বেশ কিছু পাখির ছবি তুললাম। চাটাইন্না খাল দিয়ে লেইচ্ছামারা খালে ঢোকার সময় দূর থেকে দেখলাম হাতের ডান দিকে ঝোঁপের সামনে কাদা-মাটিতে একটি পাখি কি যেন খাচ্ছে। মাঝি রফিকুলকে ইঞ্জিন বন্ধ করে ধীর গতিতে পাখিটির সামনে যেতে বললাম। দূরবীন দিয়ে পাখিটিকে দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল!

কাঙ্ক্ষিত পাখিটিকে চোখের সামেন এভাবে পেয়ে যাবো কোনোদিন কল্পনা করিনি। অথচ শাবাজ ট্রিটির জন্য কত বছরই না অপেক্ষা করতে হয়েছে। তাই দেরী না করে বেশ কিছু ছবি তুলে মনের শখ পূরণ করে নিলাম। এরপর নৌকা ছোটালাম লেইচ্ছামারা খালের দিকে।

শাবাজ ট্রিটি বা কালো শিরযুক্ত হট টিটি বা হাট্টিমা লম্বা ঝুটিযুক্ত Charadriidae পরিবারের সাদাকালো পাখি। ২৮ থেকে ৩১ সে.মি. দৈর্ঘ্য ও আকার ভেদে ১৪০ থেকে ৩২০ গ্রাম ওজনের এরা জলচর পাখি। এরা মূলত ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বসাবস করে। প্রজনন ঋতু ছাড়া প্রাপ্তবয়স্ক পাখির পিঠের দিকে কালচে সবুজ রঙের হয়। দেহের নিচের দিক সাদা। পেছনে লম্বা কালোযুক্ত শির বা ঝুঁটি থাকে। মুখে কালো ও সাদা রঙ দেখা যায়। বুকে কালো প্রশস্ত ফিতা এবং কালো ডানার উপরের অংশের বাইরের ডানার তিনটি প্রান্ত পালকের আগা অনেকটা পীতাভ-সাদা। এদের চোখ বাদামী। চঞ্চু ছোট ও কালো। পা, পায়ের পাতা ও আঙুল কমলা-বাদামী। প্রজননকালে এদের ঝুঁটি দীর্ঘতর এবং চোখের নিচে সরু কালচে টান থাকে। ছেলে ও মেয়ে পাখির চেহারা অভিন্ন।

শাবাজ ট্রিটি স্যাঁতসেঁতে তৃণভূমি, জলাভূমি, হাওর, নদীর পাড়, পতিত জমি ও আবাদি জমিতে বিচরণ করে। সচারচর জোড়ায় বা ছোট বিচ্ছিন্ন ঝাঁকে থাকে। পানির প্রান্তে হেঁটে ও দৌড়ে এরা ঠোঁট দিয়ে শিকার তুলে খায়। খাদ্যতালিকায় রয়েছে পোকা, শামুক জাতীয় প্রাণী ও কেঁচো। মাঝে মাঝে করুণ সুরে ডাকে। মার্চ থেকে জুন মাস এদের প্রজননকাল। প্রজননকালে পুরুষ পাখি মেয়ে পাখিকে আকৃষ্ট করার জন্য আকাশে উড়ে কসরত দেখায়। এরা মাটিতে বাসা বানায়। বাসার ত্রিসীমানায় কোনো পাখি আসতে দেয় না। পুরুষ পাখি পাহারা দেয়।

নিজেদের বানানো বাসায় মেয়ে পাখি ৩-৪টি ডিম পাড়ে। দুজনে মিলে ডিমে তা দেয়। ২৬ থেকে ২৮ দিনে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটে। ডিম থেকে বের হয়েই ছানারা বাসা ছেড়ে দেয় এবং নিজেরা খাবার খুঁটে খায়। ভয় পেলে ছানারা মাটিতে শুয়ে পড়ে এবং ছানাদের থেকে শত্রুর দৃষ্টি ফেরানোর উদ্দেশ্যে বাবা-মা কিছু দূরে মাটিতে শুয়ে ছটফট করে। এটা বাবা-মায়ের একটি কৌশল মাত্র।

শাবাজ ট্রিটি বাংলাদেশের বিরল পরিযায়ী পাখি। শীত মৌসুমে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের জলাশয়ে দেখা যায়। এ ছাড়াও এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকায় এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে। এরা বিশ্বে বিপদমুক্ত বলে বিবেচিত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এরা সংরক্ষিত।

বাংলা নাম: শাবাজ ট্রিটি, কালো শিরযুক্ত হট টিটি বা হাট্টিমা। ইংরেজি নাম: Northern Lapwing বৈজ্ঞানিক নাম: Vanellus vanellus (Linnaeus 1758)