১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা ৭ মার্চে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠের সেই ভাষণ ছিল বাঙালি জাতির মুক্তির মূল মন্ত্র। এটি নিরস্ত্র জাতিকে স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নিতে উৎসাহ দিয়েছিল। এতে ছিল স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতির পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা। সে ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালি জাতি ছিনিয়ে এনেছিল বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। পরাধীন জাতিকে মুক্তির পথ দেখিয়েছে সেই জ্বালাময়ী বক্তৃতা। বঙ্গবন্ধুর মতো এমন আবেদনময় ও সুনিপুণ দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। সব বয়সী মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিল ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ কীভাবে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, তা বিশ্লেষণ করেছেন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘৭ মার্চের ভাষণ ছিল কার্যত স্বাধীনতার ঘোষণা। সেদিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার নিজের ভাষায় জাতিকে হুকুম করেছেন। সেদিন কেউ সরাসরি, কেউবা রেডিওতে এ ভাষণ শুনেছিলেন। ভাষণ শুনে সারা বাংলাদেশের মানুষ আবেগাপ্লুত হয়ে উঠেছিলেন। সবার মন রোমাঞ্চিত হয়েছিল। সেদিন পাকিস্তানিদের দীর্ঘদিনের শোষণ ও অন্যায়ের কথা তুলে ধরা হয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সে ঘোষণা ছিল—সমুদ্রের এক পাড়ে স্বাধীনতা, অন্য পাড়ে পরাধীনতা। আমরা নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে সেই সমুদ্র পাড়ি দিয়েছি। এর জন্য আমাদের ৩০ লাখ প্রাণ হারাতে হয়েছিল। তবু সেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে আমরা পৌঁছাতে পেরেছি।’
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘বাঙালি নিরস্ত্র জাতি ছিল। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে নিরস্ত্র বাঙালি সশস্ত্র বাঙালিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তার বক্তব্যে বললেন, তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো, শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। সেদিন নিরস্ত্র বাঙালি সশস্ত্র বাঙালিতে রূপান্তরিত হয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘৭ মার্চের ভাষণের সময় বঙ্গবন্ধুর কাছে কোনো নোট ছিল না, তিনি একনাগাড়ে বলে গেছেন। পৃথিবীতে অনেক ভাষণ আছে অনেক অর্থবহ। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার এ ভাষণে একটা নিরস্ত্র জনগোষ্ঠীকে সশস্ত্র জনবাহিনীতে রূপান্তর করে প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিয়েছিলেন।’
আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট নজিবুল্লাহ হিরু বলেন, ‘সেদিন রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে থেকে দেখেছি, কি তেজোদীপ্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রতিটি শব্দ। একেকটি শব্দ যেন ভেতরে অগ্নিগর্ভ করে দিচ্ছিল। স্কুলপড়ুয়া আমি যেন যুবকের চেতনায় উদ্বুদ্ধ। ক্ষণে ক্ষণে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল, যেন এখনই নেমে পড়ি মুক্তির যুদ্ধে।’
তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণের পরই মূলত মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। পুরান ঢাকায় যার যা আছে, তা-ই নিয়ে ট্রেইনিং শুরু হয়ে যায় পাড়া-মহল্লায়, মাঠগুলোতে। পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে নিজেদের মুক্ত করতে ৭ মার্চের ভাষণের পর পাল্টে যায় পুরো পরিস্থিতি।’
৭ মার্চের ভাষণকে বাঙালি জাতির মুক্তির কৌশল ও নীতি বলে অভিহিত করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘এ ভাষণ একটি নিরস্ত্র জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরিত করে। এটা স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতির পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেব আত্মপ্রকাশের প্রেক্ষাপট এতে আছে। বাঙালি জাতি পাকিস্তানি হানাদারদের ওপর ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, যেটা এ ভাষণেরই ফল।’
জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক একরামুল কবির বলেন, ‘এই ভাষণে বলা হয়েছে, যার যা আছে তা-ই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। তখনই তো আমাদের সবার মনে জেগেছে, নির্দেশনা এসে গেছে— আমাদের কী করতে হবে। এরই ধারাবাহিকতায় ২৫ মার্চ আমরা পেলাম মুক্তির সংগ্রামের নির্দেশনা। মূলত ওই ৭ মার্চের ভাষণই আমাদের বলে দিয়েছে, এ দেশকে হানাদারমুক্ত করতে হলে কী করতে হবে? বাঙালি জাতি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তা-ই করেছে, নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জন করেছে।’