স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উদযাপনের বছরে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কের বিষয়টি বন্ধুত্ব ও সংযুক্ততার ঐতিহাসিক বন্ধন গুরুত্ব পেয়েছে। এই সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে সামাজিক-সাংস্কৃতিক-সভ্যতার ঐতিহ্যগত অংশীদারিত্ব, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে অকৃত্রিম সহযোগিতার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। কূটনীতিকরা বলছেন, বিষয়টি আরও সৃদৃঢ় হয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সর্বশেষ বাংলাদেশ সফরের মাধ্যমে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, করোনা মহামারির মধ্যে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এটিই ছিল প্রথম বিদেশ সফর। এর মাধ্যমে ভারতের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্বের বিষয়টি প্রকাশ পায়। তবে নরেন্দ্র মোদির এর আগের সফর এবং শেখ হাসিনার শেষ দিল্লি সফরের সঙ্গে তুলনা করলে, মোদির এই সফরের আক্ষরিক অর্জন কম বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
মোদির ২০১৫ সালের ঢাকা সফরে দুই দেশের মধ্যে মোট ২২টি দ্বিপক্ষীয় দলিল স্বাক্ষর, বিনিময় ও হস্তান্তর হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- স্থলসীমান্ত চুক্তি, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি, ট্রানজিট ও বাণিজ্য প্রটোকল এবং উপকূলীয় নৌ-পরিবহন চুক্তি। ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চারদিনের দিল্লি সফরে সাতটি চুক্তি ও তিনটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। আর, এবারের মোদির সফরে পাঁচটি সমঝোতা স্মারক এবং কয়েকটি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ও উদ্বোধন করা হয়।
দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রেখে একসঙ্গে উন্নতি করা এবং এগিয়ে যাওয়ার যে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে গেছেন নরেন্দ্র মোদি তাকে কাজে লাগাতে পারলে উভয় দেশই উপকৃত হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
নরেন্দ্র মোদি সফরে যেমনটি বলেছেন, একবিংশ শতাব্দীর আগামী ২৫ বছর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ঐতিহ্যের অংশীদার, আমরা উন্নয়নেরও অংশীদার। আমরা লক্ষ্য ভাগাভাগি করি, চ্যালেঞ্জগুলোও ভাগাভাগি করি। আমাদের মনে রাখতে হবে যে বাণিজ্য ও শিল্পে, যেখানে আমাদের জন্য একই ধরনের সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনি সন্ত্রাসবাদের মতো সমান বিপদও রয়েছে। একইভাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দুই দেশের যৌথ প্রয়াসের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন রোববার সন্ধ্যায় রাইজিংবিডিকে বলেন, নরেন্দ্র মোদির এই সফরের ফলে বিদ্যমান দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা আরও বেগবান ও জোরদার হবে বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। তার এই সফর ঘিরে বাংলাদেশের প্রাপ্তি এবং প্রত্যাশার সুন্দর সমীকরণ হয়েছে। আমরা কানেক্টিভিটির ওপর জোর দিয়েছি। একই মনোভাব দেখিয়েছে ভারত। দুই সরকারপ্রধানই আলোচনায় বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে রোবাস্ট আঞ্চলিক কানেক্টিভিটির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন।
তিনি বলেন, পাশাপাশি অর্থনৈতিক কূটনীতির বিষয়টিও প্রাধান্য পেয়েছে এই সফরে। ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক ভারসাম্য বাংলাদেশের অনুকূলে আনা এবং বাণিজ্য অবারিত করার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ট্রেড ফেসিলিটেশন বিষয়াবলি নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। উভয় পক্ষ ট্যারিফ এবং নন-ট্যারিফ অপসারণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে যে গভীর সম্পর্কের ভিত রচিত হয়েছিল, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে নরেন্দ্র মোদির আগমনের বিষয়টি সেই সম্পর্কের দিকেই আমাদের দৃষ্টিপাত করে। গত ৫০ বছরে ধ্বংসস্তূপ থেকে আমরা একটি সম্মানজনক অবস্থানে এসেছি। মোদির এ সফর তারই স্বীকৃতি দেয়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বহুমাত্রিক। ভারতের কাছে আমাদের কিছু সাধারণ প্রত্যাশা দীর্ঘদিনের। নদীর পানি বণ্টন, জলবায়ু ইস্যু, সীমান্ত নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলো সামনে রাখতে হবে। আশা করি, এসব ক্ষেত্রে ভারতের যতটুকু ইতিবাচকতা প্রদর্শন প্রয়োজন, মোদির এ সফরের পর আমরা তা দেখতে পাব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমদ বলেন, বাংলাদেশে নরেন্দ্র মোদির সফর সরকারের পাশাপাশি জনগণের মধ্যেও গুরুত্ব পায়, এবারও পেয়েছে। এই সফরের অবশ্যই কিছু প্রাপ্তি রয়েছে। তবে আরও কিছু পেন্ডিং ইস্যু নিয়ে আলোচনা ও সমাধান হলে ভালো হতো। বিশেষ করে সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা, পানি চুক্তি, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিষয়ে ভারতের আরও আন্তরিক অবস্থান- এসব বিষয়ের সমাধান এখন সময়ের দাবি।
মোদির দুই দিনের এই সফরে উভয় দেশের মধ্যে পাঁচটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। সেগুলো হলো—১) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, অভিযোজন ও প্রশমনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা।
২) বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি) এবং ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর অব ইন্ডিয়ার (আইএনসিসি) মধ্যে সহযোগিতা।
৩) বাণিজ্য বিকাশে অশুল্ক বাধা দূর করতে একটি সহযোগিতা ফ্রেমওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করা।
৪) বাংলাদেশ-ভারত ডিজিটাল সার্ভিস অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং (বিজিএসটি) সেন্টারের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি সরঞ্জাম, কোর্সওয়্যার ও রেফারেন্স বই সরবরাহ এবং প্রশিক্ষণ সহযোগিতা।
৫) রাজশাহী কলেজ মাঠের উন্নয়নে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন।
এছাড়াও দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে ভার্চুয়ালি বেশ কয়েকটি প্রকল্পের উদ্বোধন করা হয়। যার মধ্যে রয়েছে, ঢাকা ও নিউ জলপাইগুড়ির মধ্যে যাত্রীবাহী ট্রেন সার্ভিস, বাংলাদেশ-ভারত স্বাধীনতা সড়ক। মুক্তিযুদ্ধে যেসব ভারতীয় সৈন্য আত্মাহুতি দিয়েছেন তাদের স্মরণে আশুগঞ্জে একটি সমাধিসৌধ উদ্বোধন করা হয়। এছাড়াও কুষ্টিয়ার শিলাইদহে কুটিবাড়িতে ভারতের অর্থায়নে যে সংস্কার কাজ হয়েছে তারও উদ্বোধন করা হয়। বৈঠকে বাংলাদেশের কাছে ভারতের ১০৯টি অ্যাম্বুলেন্স হস্তান্তর করেন মোদি। এছাড়া দুটি সীমান্ত হাট এবং স্মারক ডাকটিকিটের মোড়ক উন্মোচন করা হয়।