দুই পাশে লাল মাটির পাহাড়। পাহাড়ের উপর উঁচু গাছ। তারই মাঝে সরু ছড়া দিয়ে হাঁটছি। ছড়ার নাম বড়ছড়া। পানির মধ্যে পা ফেলতেই ছলাৎ ছলাৎ শব্দ হলো। বেশ লাগছিল! এ ভাবে হাঁটতে হাঁটতে কতটা পথ পাড়ি দিয়েছি মনে নেই। যেন পথ শেষ হতে চাচ্ছে না। এক অদম্য নেশায় পেয়ে বসেছিল। পায়ের নিচে ছলাৎ ছলাৎ শব্দের মধ্যেও চোখ দুটো সজাগ ছিল। ঘুরে ফিরে পাখির সন্ধান করছিলাম। তেমন কিছু নজরে পড়ল না।
আগে থেকেই জানতাম কাপ্তাই লেকের বড়ছড়ায় পাখিটি নাকি সবসময় দেখা যায়। শুনে আগ্রহ নিয়ে এসেছিলাম; যদি ছবি তুলতে পারি। অথচ পাখিটির দেখা নেই। অবশ্য সারাদিন নানান প্রজাতির পাখির ছবি তুলেছি। তাতে মন খারাপ কিছুটা কাটিয়ে ওঠা গেছে। এদিকে সন্ধ্যা নেমে আসছে। আমি রাঙ্গামাটি শহরে ফিরে এলাম। কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে রাত কাটানোর ভালো ব্যবস্থা না থাকায় আমরা এবার রাঙ্গামাটির একটি হোটেলে উঠেছিলাম। সারাদিন ছড়ার পানিতে হেঁটে শরীর ক্লান্ত। ৮টার মধ্যেই রাতের খাবার শেষ করে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমানোর আগে পরিকল্পনা করলাম পরের দিন ব্যাঙছড়া যাব।
ভোরে একটি সিএনজিতে চেপে কাপ্তাই চলে এলাম। ব্যাঙছড়া যাওয়ার জন্য ইট বিছানো রাস্তা ধরে হাঁটছি। কারো সঙ্গে কারো কোনো কথা নেই। সবার নজর আশপাশের জঙ্গল আর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের দিকে। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর সঙ্গী বন্যপ্রাণী গবেষক ও ওয়াইল্ড ফটোগ্রাফার আদনান আজাদ আসিফ ফিসফিস করে বলল- মিয়া ভাই যে পাখিটি খুঁজছিলাম সেটা সামনে। পাখিটি একনজর দেখার জন্য সবাই চমকে তাকালাম। আদনান আঙুল উঁচিয়ে দেখাল- ওই যে! কিন্তু আলো কম থাকায় ক্যামেরা তাক করেও খুব একটা লাভ হলো না। অবশেষে ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’ মনে করে যে যার মতো ছবি তুলে নিলাম।
এতক্ষণ যে পাখিটির কথা বলছিলাম সেটির নাম বন বাচকো। এটি Ardeidae পরিবারের অন্তর্ভূক্ত ৫০ সে.মি. দৈর্ঘ্য এবং প্রায় ৩৫০ গ্রাম ওজনের পাখি। দেহ লালচে, হলদে ঠোঁটের নিশাচর মাছশিকারী পাখি বন বাচকো। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির কালো ডোরাসহ পিঠ তামাটে। ঘাড় লাল। মাথার চারদিকে ঘন কালো ঝুঁটি। থুতনি ও গলা সাদা। ঘাড়ের উপরের অংশ লাল। বুকের উপরে কালো কালো লম্বা দাগ। বুকের নিচে লালচে। তলপেটে কালো তিলা। চোখ সোনালি-হলদে গোলাকার। পা সবুজ ও পায়ের পাতার সামনের অংশ বাদামি। ছেলে ও মেয়ে পাখির চেহারা অভিন্ন।
এরা ঘন বনের মধ্যে বহতা নালা, জলা ও জলপ্রবাহ এবং জলমগ্ন বাঁশঝাড়ে বিচরণ করে। সচারচর একা ও জোড়ায় থাকে। এরা রাতে পানির উপর দাঁড়িয়ে বা পানিতে ধীরে ধীরে হেঁটে ঠোঁট দিয়ে শিকার করে। খাদ্যতালিকায় রয়েছে মাছ, ব্যাঙ ও পানির অমেরুদণ্ডী প্রাণী। এরা বকের মতো ঠোঁট দিয়ে কোপ না মেরে ঠোঁট দিয়ে শিকার চেপে ধরে। দিনে পানির ধারে বড় কোনো গাছে ঘুমিয়ে থাকে। সন্ধ্যা হলেই এদের কর্মব্যস্ততা বেড়ে যায়। মাঝে মাঝে গম্ভীর গলায় ডাকে। মে-জুন এদের প্রজননকাল। এ সময় ঘন বনে নদীর ধারে ছোট গাছে ডালপালা দিয়ে মাচার মতো বাসা বানায়। নিজেদের বানানো বাসায় মেয়ে পাখিটি ৩-৫টি সাদা ডিম পাড়ে। ছেলে ও মেয়ে পাখি উভয়েই ছানাদের পরিচর্যা করে।
বন বাচকো বাংলাদেশের বিরল আবাসিক পাখি। চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের চিরসবুজ বনে পাওয়া যায়। এরা বিশ্বে বিপদমুক্ত ও বাংলাদেশে মহাবিপন্ন বলে বিবেচিত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত।
পাখিটির ইংরেজি নাম: Malaysian night heron/Tiger bittern বৈজ্ঞানিক নাম: Gorsachius melanolophus
* ‘নীল শিসদামা’র কণ্ঠে বাঁশির সুর
* গৃহপালিত হাঁসের পূর্বপুরুষ নীলশির হাঁস