দেশব্যাপী করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ার কারণে সরকার গত ৫ এপ্রিল থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত এক সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করে। সেই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ১৪ এপ্রিল থেকে একসপ্তাহের কঠোর লকডাউন ঘোষণা করা হয়। মাঝে ১২ ও ১৩ এপ্রিলকেও প্রথম দফা লকডাউনের আওতায় নিয়ে আসা হয়। এরপর ১৪ এপ্রিল শুরু হওয়া একসপ্তাহের সর্বাত্মক লকডাউনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে আরও একসপ্তাহ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। আর এতেই দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে ব্যবসায়ীদের কপালে। তারা বলছেন, সামনে ঈদ। সারাবছর কেনাকাটা যাই হোক, ঈদের সময় তা পুষিয়ে নেওয়া যায়। সারাবছর করোনার কারণে তেমন মুনাফা হয়নি। সামনে ঈদ। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রচুর বিনিয়োগ করেছেন তারা। ঈদ উপলক্ষে তারা ভালো বিক্রির আশা করছেন। কিন্তু চলমান টানা লকডাউনে ব্যবসায়ে ধস নামার আশঙ্কা ভর করেছে এখন তাদের মনে।
লকডাউন বিষয়ে গাউছিয়া দোকান মালিক সমিতির সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আব্দুল হান্নান প্রধান বলেন, ‘গতবছর মার্কেট বন্ধ ছিল। এবার আশা করেছিলাম, ঈদের সময় ব্যবসা করে কিছুটা পুষিয়ে নেবো। তাই ব্যাংক ও বড় বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বাইরে থেকে ঈদের মালামাল আমদানি করেছি। এখন যে হারে লকডাউনের মেয়াদ বাড়ছে, আমরা অর্থনৈতিকভাবে একদম শেষ হয়ে যাবো।’
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি কামরুল হাসান বলেন, ‘আমরা পাইকারি ব্যবসায়ীরা ঋণ করে ঈদের জন্য কোটি টাকার জামা-কাপড় বানিয়ে রেখেছি। লকডাউনের কারণে সারাদেশের খুচরা ব্যবসায়ীরা সেসব না নিতে পারলে এই কাপড় দিয়ে আমরা কী করবো? গত বছরও মার্কেট বন্ধ থাকার কারণে দোকানের কর্মচারীদের বেতন-বোনাস দিতে পারিনি। এবারও দিতে পারবো কি না, জানি না। ওরা কিভাবে বাঁচবে, আমরাও বা বাঁচবো কিভাবে?’
ইস্টার্ন মল্লিকা দোকান মালিক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সরওয়ার উদ্দিন খান বলেন, ‘গত বছর ঈদের জন্য যে টাকা বিনিয়োগ করেছিলাম, করোনার কারণে মার্কেট বন্ধ থাকায় সেই মালামাল গুদামে থেকে নষ্ট হয়েছে। সেই লোকসানই সামলাতে পারিনি। এবারও যদি ঈদে মার্কেট না খুলতে পারি, ব্যবসা করতে না পারি, তাহলে আমাদের রাস্তায় নামতে হবে।’
গাউছিয়া, চিশতিয়া, চাঁদনীচক, নূর ম্যানসনসহ বিভিন্ন মার্কেটের ব্যবসায়ীদের দোকান ও কারখানায় কাজ করেন কয়েক হাজার কর্মচারী। তারা জানান, প্রতিবছর ব্যবসায়ীরা ঈদের আগে তাদের বেতন-বোনাস মিটিয়ে দেন। গত বছর করোনার জন্য টাকা দেয়নি। খেয়ে না খেয়ে কোনোভাবে পরিবার নিয়ে বেঁচে আছে। এবারও যদি লকডাউনের কারণ দেখিয়ে মালিকপক্ষ তাদের পাওনা টাকা না দেয়, তাহলে পরিবার নিয়ে গ্রামে চলে যেতে হবে। তারা বলেন, ‘করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা না গেলেও খেতে না পেরেই মারা যাবো।’
ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিকভাবে চালু না থাকায় মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক গোলাম মাওলা হিরন বলেন, ‘আর্থিক ও মানবিক বিপর্যয় এড়াতে ছোট-বড় সব ব্যবসায়ী, অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মজীবী এবং নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী শুরু থেকেই লকডাউনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। বাঁচার জন্য তারা যেকোনো কাজ করতে মানসিকভাবে প্রস্তুত রয়েছে। এরা নিজেদের কাজটা না করতে পারলে রোজগারের জন্য বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে যাবে।’
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মোহিত কামাল জানান, লকডাউনের ফলে সাধারণ মানুষ একপ্রকার ঘরবন্দি হয়ে পড়েছে। খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষ এখন প্রায় কর্মহীন। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার ও স্বল্পপুঁজির ব্যবসায়ীরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন। করোনা সংক্রমণের ভিত্তি এবং লকডাউনের ফলে সার্বিকভাবে মানুষের আর্থিক ক্ষতির সঙ্গে সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
এই চিকিৎসক বলেন, ‘করোনার প্রথমদিকে একে অপরকে বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করলেও এখন সবাই কমবেশি আর্থিক সংকটপূর্ণ। তার মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় মধ্য ও নিম্নআয়ের মানুষ সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। এই অবস্থায় হতাশা এসে গ্রাস করছে তাদের। এই হতাশার খুব মারাত্বক প্রভাব পড়তে পারে অনেকের মধ্যে। যা হতে পারে ভয়ঙ্কর।’
মিরপুর শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. ফরহাদ মনজুর বলেন, ‘সরকার সবার স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিবেচনায় লকডাউনের ঘোষণা দিলেও মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পেটের তাগিদে ঘরবন্দি থাকতে পারছে না। তারা স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে বেরিয়ে পড়ছে। উপজেলা শহর ও গ্রামগুলোতে মানুষজন অসচেতনতভাবে চলাফেরা করছে। এছাড়া প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এবার অনেকটা নমনীয়। তাই তাদেরকে বুঝিয়ে, তাদের পাশে দাঁড়িয়ে, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। স্বাস্থ্যবিধির শর্ত না মানলে সেটা সবার জন্য বিপদ বয়ে আনবে।’
অর্থনীতিবিদ নেয়ামত আলী সরকার বলেন, ‘লকডাউনে সাধারণ মানুষ, ছোট ব্যবসায়ীরা তাদের উপার্জন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছেন। এসব পেশার মানুষেরা খুব মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এসব মানুষদের পাশে সরকারকে দাঁড়াতে হবে। সত্যিকার অভাবী এবং অসহায় মানুষেরা যাতে প্রণোদনা সঠিকভাবে পায় তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। এসব মানুষের কাছে এখন মূল বিষয় হচ্ছে বেঁচে থাকা। তাই এরা সবাই বাঁচার জন্য দৌড়াচ্ছে।’
এলিফেন্ট রোডের একজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাড়া, কর্মচারীর বেতন, আনুষঙ্গিক খরচ, পারিবারিক ব্যয় সবকিছুই নির্ভর করে ব্যবসার ওপর। ব্যবসা নাই বলে এসব খরচও দিতে পারছি না। অনেকে এরই মধ্যে বিকল্প চিন্তা করছে খরচ কমানোর জন্য। বাসা ছেড়ে দিয়েছে, শিক্ষার্থীদের স্কুল ড্রপআউট করে পরিবারকে গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। ক্ষুদ্র, মাধ্যম ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলছে, দোকান, বাসাবাড়িতে টু-লেট বাড়ছে, লোনের কিস্তি বাকি পড়ছে। আমরা কী করে বাঁচবো?’