আইটি ব্যবসায়ী মো. শরীফ উদ্দিন অপূর্ব। একইসঙ্গে সৌখিন ফটোগ্রাফারও। ফটোগ্রাফিতে তার প্রিয় ক্ষেত্র স্ট্রিট ফটোগ্রাফি ও ডকুমেন্টেশন। তিনি ফেসবুকভিত্তিক পেজ বাংলাদেশ ফটোগ্রাফার অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ) এর ফাউন্ডার অ্যাডমিন। ফটোগ্রাফির সঙ্গেই তার সার্বক্ষণিক ব্যস্ততা। প্রথম রোজার দিন তিনি ইফতার শেষে অফিস থেকে যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার হয়ে নিজ বাসায় ফিরছিলেন। ওই সময় ফ্লাইওভারে কর্মরতরা রাস্তার এক পাশে মাগরিবের নামাজ আদায় করছিলেন।
স্বাভাবিকভাবে বিষয়টি একজন স্ট্রিট ফটোগ্রাফারের নজর এড়ানোর মতো নয়। মোটরসাইকেল থামিয়ে নামাজরতদের কয়েকটি ছবি তুললেন। আর সেদিনই একটি ছবি তার ফেসবুকে আপলোড করেন। বিষয়টি এখানে থেমে থাকলে হয়তো এই লেখার প্রয়োজন হতো না। অপূর্ব পরের দিনই তার তোলা সেই ছবির একটি স্ক্রিনশট পোস্ট দেন। যেটি ‘জাজাকাল্লাহ মিডিয়া’ নামের একটি ইসলামি পেজ তাদের ইউটিউব চ্যানেলে পোস্ট দেয়। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ৮ হাজারের বেশি লাইক পায়। একই ছবিটি গত কয়েকদিনে ফেসবুক বেশ কিছু আইডিতে শেয়ার হয়েছে। কোথাও ফটোগ্রাফারের ক্রেডিট দেওয়া হয়নি।
খুব সাম্প্রতিক এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়—একজন সৃজনশীল মানুষের সৃষ্টির স্বত্ব নিশ্চিত করা কতটা প্রয়োজন। আর তার জন্য রয়েছে ‘কপিরাইট আইন’। আইন আছে কিন্তু তার তেমন প্রয়োগ নেই। ফলে শিল্পীর শিল্পকর্ম নিয়ে চলছে নানা ধরনের চক্রান্ত। বিশেষ করে অন্য কারও শিল্পকর্ম নিজের বলে দাবি করতে দ্বিধা করছে না একটি শ্রেণি। যাদের সংশ্লিষ্ট শিল্পকর্মের সঙ্গে বিন্দুমাত্র যোগাযোগ নেই।
এ বিষয়ে শরীফ উদ্দিন অপূর্ব বলেন, ‘ছবি তোলা আমার অন্যতম নেশা। স্ট্রিট ফটোগ্রাফির পাশাপাশি ডকুমেন্টেশন ফটোগ্রাফিও করি। দেশে লকডাউন থাকার কারনে, প্রথম রোজায় সন্ধ্যায় অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে রাস্তায় কিছু ছবি তুলি। ছবিটি ফেসবুক নিজের টাইমলাইন ছাড়াও কয়েকটি ফটোগ্রাফিক গ্রুপে পোস্ট করি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, ছবিটা অনেক গ্রুপে, অনেকের পার্সোনাল আইডিতে, এমনকি কিছু ইউটিউব চ্যানেলে আমার অনুমতি ও ক্রেডিট ছাড়া প্রকাশ করতে দেখি।’
এই ফটোগ্রাফার আরও বলেন, ‘একজন শিল্পীর সবচেয়ে বড় কষ্ট সেখানেই, যেখানে তার শিল্পকে অবমূল্যায়ন করা হয়, তাকে তার ন্যূনতম সম্মানটুকু দেওয়া হয় না। আমাদের দেশে কপিরাইট আইন আছে, কিন্তু এর ব্যবহার সম্পর্কে অনেকেই জানেন না, কোথায় কিভাবে এই আইনের সহায়তা নিতে হয়, তাও তাদের জানা নেই। যে কারণে অনেক ফটোগ্রাফার তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।’
অপূর্ব বলেন, ‘আমি মনে করি, কপিরাইট আইনের ব্যবহার ও সঠিক প্রয়োগ প্রত্যেক শিল্পীর জানা উচিত। যেন তিনি তার প্রাপ্য সম্মান ও মূল্য বুঝে নিতে পারেন। দেশের মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেগুলো আছে, সেগুলো বড় ভূমিকা রাখতে পারে। গণসচেনতার পাশাপাশি আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে কপিরাইট নিশ্চিত করা সম্ভব।’
বার্ড বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেল ও ওয়াইল্ড ফটোগ্রাফার শামীম আলী চৌধুরী বলেন, ‘একজন ফটোগ্রাফারের কাছে ফটোগ্রাফি হচ্ছে শিল্প। ফটোগ্রাফারের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে ক্যামেরার মাধ্যমে যেকোনো বিষয়কে ফুটিয়ে তোলাই হচ্ছে ফটোগ্রাফি। আর এই ফটোগ্রাফি হলো সেই ফটোগ্রাফারের সৃজনশীল কাজ। আমাদের সবার উচিত—যার যার সৃজনশীলতাকে সংরক্ষণ করার জন্য কপিরাইট ব্যবহার করা। যেন প্রমাণ করতে সুবিধা হয়, এই সৃজনশীল কাজের স্বত্বাধিকারী কোনো একজন ফটোগ্রাফার। প্রত্যেক ফটোগ্রাফারের জন্য কপিরাইট ব্যবহার করা জরুরি। তাতে নিজের সৃজনশীল কাজকে অপব্যবহার বা চুরির হাত থেকে রক্ষা করা যায়।’
ফটোগ্রাফির জন্য কপিরাইট কেন প্রয়োজন
সৃষ্টিশীল মানুষ দুই ধরনের সম্পদ নিয়ে শিক্ষিত জীবন যাপন করে; প্রথমত বস্তুগত সম্পদ—জায়গা-জমি, গাড়ি-বাড়ি, টাকা-পয়সা, ব্যবসা-বাণিজ্য, কল-কারখানায় প্রাত্যহিক ব্যবহার্য দ্রব্য; দ্বিতীয়ত মেধাসম্পদের আওতায় আছে—সাহিত্যকর্ম, নাট্যকর্ম, শিল্পকর্ম, সঙ্গীতকর্ম, অডিও-ভিডিওকর্ম, চলচ্চিত্রকর্ম, ফটোগ্রাফি, ভাস্কর্যকর্ম, সম্প্রচারকর্ম ইত্যাদি। কপিরাইট আইন থাকার ফলে শিল্পী ও সৃষ্টিকারীদের সৃষ্টির সঙ্গে ব্যবহারকারীর একটা ভারসাম্য প্রতিস্থাপিত হয়। এই আইন শিল্পী ও সৃষ্টিকারীদের এমন এক একচ্ছত্র অধিকার দেয়, যার ফলে ব্যবহারকারী তাদের অনুমতি ছাড়া সেটা কপি করতে পারে না। সৃষ্টিশীল মানুষের সৃষ্টিকর্ম ও আইডিয়া কেউ অবৈধভাবে পুনঃমুদ্রণ, চুরি বা পরিবর্তন হওয়া থেকে এই আইন সুরক্ষা দেয়। শিল্পকর্ম কাজ ও বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে কপিরাইট আইন সুরক্ষা দেয়। শিল্পী ও সৃষ্টিকারীদের কাজ কেউ কপি করতে পারবে না কপিরাইট আইনের মাধ্যমে এই নিশ্চয়তা থাকে বলে তারা নিশ্চিন্তে সংস্কৃতি ও জ্ঞান, বিজ্ঞানের উন্নয়নে কাজ করতে পারেন। সৃজনশীল কাজের বিকাশ ঘটে ফলে সমাজের উন্নয়ন সাধিত হয়। শিল্পী ও লেখকরা তাদের কাজের মূল্যায়ন পান, সম্মানী নিশ্চিত হয় যা তাদের আরও ভালো কাজে উৎসাহ জোগায়। আন্তর্জাতিক কপিরাইট আইনের ফলে এক দেশের সৃষ্টিকর্ম আরেক দেশে নিরাপত্তা পায়।
ফটোগ্রাফারদের সৃষ্টি বা ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রে ‘কপি রাইট’ আইনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে দৈনিক প্রথম আলোর ফটো এডিটর ও দেশের শীর্ষস্থানীয় ফটোগ্রাফার আবীর আবদুল্লাহ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘কপিরাইট হচ্ছে সৃষ্টিশীল মানুষের সৃষ্টির স্বত্বকে প্রটেক্ট করতে সহায়তা করে। প্রত্যেক ফটোগ্রাফারের ছবি কপি রাইটের আওতায় আনা উচিত। এতে ভবিষ্যতে তার তোলা ছবি অন্য কোথাও ব্যবহার করতে পারবে না।’
আবীর আবদুল্লাহ বলেন, ‘বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও আইন রয়েছে। কেউ অন্য কারও ছবি বিনা অনুমতিতে কোথাও ব্যবহার করলে তার বিরুদ্ধে কপিরাইট আইনে মামলা করা যায়। কেউ অসৎ উদ্দেশ্যে কারও ছবি ব্যবহার করলে তা যে ক্যামেরায় ছবিটি ধারণ করা হয়েছে, তা থেকে প্রমাণ করা সম্ভব। অপব্যবহারকারীকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব। আইনের আওতায় আনতে হলে অবশ্যই কপিরাইট থাকতে হবে। তবে, এ বিষয়ে আমাদের দেশের ফটোগ্রাফাররা ততটা সচেতন নন। একজন লেখকের সাহিত্যকর্ম বা একজন শিল্পীর গাওয়া গানের যেমন কপিরাইট আছে, তেমনি একজন ফটোগ্রাফারের তোলা ছবিরও কপিরাইট রয়েছে। এটাকে কাজে লাগাতে পারলে ফটো চুরি করা বন্ধ হবে। ফটোগ্রাফারের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে।’
দেশের অন্যতম ওয়াইল্ড ফটোগ্রাফার আদনান আজাদ আসিফ বলেন, ‘অন্যের তোলা ছবি নিজের বলে চালানো আমাদের দেশে আজকাল স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা যে কতবড় অপরাধ, সেটা যদি যারা অন্যের ছবি নিজের বলে চালিয়ে দিচ্ছেন, তারা বুঝতে পারতেন, তা হলে এমনটা করতে পারতেন না। এটা যে একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ, এটা বোঝানোর জন্য ২/১ টা মামলা হলে তখন তারা বুঝতে পারবেন।’
আদনান আজাদ আসিফ বলেন, ‘সোশ্যাল নেটওয়ার্কের এত ব্যাপ্তি হয়েছে যে, এটার সুযোগ নিয়ে নানা জনে নানাভাবে অপব্যবহার করছেন। বিশেষ করে ফটোগ্রাফি এতটাই জনপ্রিয় যে, একটা মোবাইলফোন দিয়েও ছবি তোলা যায়। ফলে ফটোগ্রাফি এখন ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। আর এই জনপ্রিয়তার সুযোগ নিয়ে রাতারাতি খ্যাতি লাভের জন্যও এক শ্রেণির মানুষ অন্যের ছবি নিজের বলে চালিয়ে দিচ্ছে। এখনই এই ট্রেন্ডটা থামিয়ে দেওয়া উচিত। আর সেটা দেশে প্রচলিত কপিরাইট আইন দিয়েই সম্ভব। তবে আইনটি আরও পরিমার্জিত করা প্রয়োজন। যেন বিনা অনুমোতিতে কেউ অন্য কারও ছবি ব্যবহার করতে সাহস না পান।
প্রসঙ্গত, ‘কপিরাইট আইন’ আমাদের দেশে নতুন না হলেও কপিরাইটের প্রয়োজনীয়তা, এ-সম্পর্কিত বোধ, সচেতনতা ও প্রয়োগ এর আগে তেমন ব্যাপক ছিল না। ধারণাটি ব্রিটিশ আমল থেকেই শুরু। আর আইনটিও তখন থেকে চালু হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্যাটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক আইনের পাশাপাশি কপিরাইট আইন বলবৎ করা হয়েছে। এই আইনের কাঠামো ও ধারাগুলোর বেশিভাগই আগের আইনের মতো আছে। দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০০ সালে এই আইনটি যুগোপযোগী করে ঢেলে সাজানো হয়।
এরপর ২০০৫ সালে আইনটি আবার সংশোধিত হয়েছে। তবে আইনটির সদর্থক প্রয়োগের ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগ ও বেসরকারি তৎপরতা কখনো উল্লেখযোগ্য ছিল না। এর মূল কারণ যারা কপিরাইটের স্বত্বাধিকারী, তাদের মধ্যে সচেতনতার অভাব ছিল। যে কারণে বাংলাদেশে কপিরাইট আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৫) থাকার পরও নির্বিচারে পাইরেসি হয়েছে ও হচ্ছে। একইসঙ্গে কপিরাইটের বৈধ স্বত্বাধিকারীর অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
আরও পড়ুন : *কপিরাইট: আইনি সুরক্ষা কোন পথে *কপিরাইট: পাইরেসি ও চৌর্যবৃত্তি *যে কারণে কপিরাইট আইন মানায় আগ্রহ কম