অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতার পাশে মানবিক, সৎ, সৃজনমনস্ক পৃথিবী গড়ার একটি ক্ষিপ্র ধারা বহমান আছে। যদিও সৃজনমনস্ক ধারা যতটা পুঁজির দাস হিসেবে কাজ করছে, ততটা কাজ করছে না সৃজনকর্ম সুরক্ষায়। দেরিতে হলেও সৃজনকর্মের সুরক্ষার বিষয়টি দীর্ঘমেয়াদী টিকে থাকার একটি প্রধান নিয়ামক- এটি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য বুঝতে শুরু করেছে। এজন্যই উদ্ভব হয়েছে কপিরাইট ধারার।
ইংরেজি ‘copyright’-এর শাব্দিক অর্থ কর্মের অধিকার। সাধারণভাবে আমরা একে মেধাস্বত্ব বলি। আইনের বিধান বলে, সুকুমার সৃজনকর্মের স্রষ্টা বা রচয়িতার অনুমতি ছাড়া কপি বা পুনরুৎপাদন করা, অনুবাদ করা, উপযোগী করা, রূপান্তর করা, অভিযোজন করা, ব্যক্তিগত যে পর্যায়েই হোক না কেন, তা কপিরাইট ধারণা, আন্তর্জাতিক আইন, আন্তর্জাতিক চুক্তি, দেশীয় আইন, নৈতিকতা ও ইতিবাচক বোধের চরম পরিপন্থী। আন্তর্জাতিকভাবে কপিরাইটের সুরক্ষা ও রচয়িতার বৈধ উত্তরাধিকারগণ ৫০ বছর সুবিধা ভোগ করে। বাংলাদেশে বলবৎ কপিরাইট আইন-২০০০ (২০০৫ সংশোধন) এর ২৪ ধারা অনুযায়ী এটি ৬০ বছর। তবে ৫০/৬০ বছর পর স্রষ্টা বা রচয়িতা সৃজনকর্ম থেকে আয় অর্জনের অধিকার বঞ্চিত হলেও কেউ সৃজনকর্মের মৌলিকত্ব ক্ষুণ্ন করতে পারবে না। এজন্যই অ্যারিস্টোটল, প্লেটো, সক্রেটিসের সৃজনকর্ম এখনো বহমান আছে।
উন্নত বিশ্ব থেকে শুধু জ্ঞান-বিজ্ঞান নয়, বিভিন্ন অধিকার সচেতনতা ও দূরদৃষ্টিতে আমরা পিছিয়ে। এ জন্যই ইংল্যান্ডে ১৭০৯ সালে কপিরাইট আইন কার্যকর হলেও পূর্ববৎ আইনের সাক্ষাৎ মেলে ১৯৬২ সালে। ভারতে কপিরাইট আইন প্রবর্তিত হয় ১৯১৪ সালে। বর্তমান বাংলাদেশে কপিরাইট আইন ২০০২ (২০০৫ এ সংশোধিত) সালের। যদিও আইনের বিধি-বিধান দ্বারা বিভিন্ন মাধ্যমে সৃজনকর্মের সুরক্ষা হচ্ছে না। বিশেষ করে কম্পিউটার নির্ভর প্রযুক্তির মাধ্যমে সৃজনকর্মের সুরক্ষা কঠিন। ইউটিউবে সংগীত, নাটকসহ নানা সৃজনকর্মের স্রষ্টা অধিকারের বিষয়টি উদ্বেগজনকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। বাংলাদেশে বলবৎ আইনে কম্পিউটার প্রোগ্রামের লঙ্ঘিত কপি প্রকাশ, ব্যবহার ইত্যাদি অপরাধের শাস্তি চার বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং চার লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। তবে এই অপরাধের জন্য সর্বনিম্ন শাস্তি ছয় মাস মেয়াদের কারাদণ্ড এবং ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ড (ধারা ৮৪)। কিন্তু এমন বিধান দিয়ে ক্রমঅগ্রসরমান প্রযুক্তিখাতে কপিরাইট আইন রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না।
আমাদের দেশে আইনের দুটো বড় দুর্বলতা হচ্ছে— আইনের বিধানগুলো যুগ-উপযোগী নয় এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রে দায়িত্বরত ব্যক্তিবর্গের অবহেলা। এর সঙ্গে রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা। আর আইনের বিধান ও প্রতিপালনে অসচেতনতা আমাদের মজ্জাগত। বিপরীতক্রমে আইনের ফাঁক-ফোকর তো রয়েছেই। কপিরাইট আইনের আলোকে Intellectual property বা মেধাসম্পদের আওতায় আছে— এক. মৌলিক সাহিত্যকর্ম দুই. মৌলিক নাট্যকর্ম তিন. মৌলিক সংগীতকর্ম চার. মৌলিক শিল্পকর্ম পাঁচ. আদি চলচ্চিত্র ছয়. আদি রেকর্ড সাত. আদি ব্রডকাস্ট এছাড়া চলচ্চিত্র, অডিও-ভিডিও কর্ম, ফটোগ্রাফি, ভাস্কর্যকর্ম ইত্যাদি। (সূত্র: গাজী শামছুর রহমান, বাংলাদেশের কপিরাইট আইন, বাংলা একাডেমি, ১৯৮৬ ঢাকা) এসব ক্ষেত্রে পাইরেসি, প্লেজারিজম বা চৌর্যবৃত্তি ইত্যাদির ভয়াল থাবা উন্নয়নশীল বিশ্বের সৃজন ভুবনকে বিশৃঙ্খল করে তুলেছে।
কপিরাইট বা মেধাস্বত্বের সঙ্গে একটি পক্ষ জড়িত। সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রধান লেখক প্রকাশক এবং সংগীতের ক্ষেত্রে গীতিকার, সুরকার, যন্ত্রী, চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে কাহিনিকার, অভিনেতা, স্ক্রিপ্ট রাইটার, পরিচালক, গায়ক, সহশিল্পীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা থাকেন। কম্পিউটার নির্ভর ডিজিটাল দুনিয়ায় মেধাক্রম চৌর্যবৃত্তির ফাঁদে পড়েছে। সম্প্রতি ইউটিউব চ্যানেলগুলো সংগীত, নাটক ও চলচ্চিত্রের বারোটা বাজিয়েছে! বর্তমান আইনের দুর্বলতা ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে উদাসীনতার কারণে সৃজনকর্মীরা কেবল আয় থেকেই বঞ্চিত হচ্ছে না, তাদের স্রষ্টার অধিকার থাকছে না। আইন আমাদের সৃজনের পিতৃত্বের (Right to patternity) অধিকার সুরক্ষা করতে পারছে না।
কপিরাইটকে ঘিরে যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত বিচারের অবতারণা হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে কপিরাইট অফিস কিংবা আদালত ভুক্তভোগীদের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে অপ্রতুলতা দৃশ্যমান। এ জন্য কপিরাইট আইন প্রয়োজনের তাগিদে দ্রুত সংশোধন, পরিমার্জন প্রয়োজন। সচেতন দেশগুলো এই রীতি মান্য করে। কিন্তু আমাদের দেশে ২০০০ সালের কপিরাইট আইন অনেক বিলম্বে ২০১৭ সালে সংশোধনের উদ্যোগ নিলেও সংশোধিত আইন এখন চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায়। জানি না এই আইন অনুমোদনের পর কতটা যুগ-উপযোগী থাকবে। তবে প্রস্তাবিত নতুন আইনের বলবৎ আইনের দুর্বলতা কাটাতে কিছু ধারা সংশোধন, পরিমার্জন করা হয়েছে। যেমন: ১. কপিরাইট আইনের একটি সহজ ও গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা ২. বিভিন্ন ক্ষেত্রে শাস্তি কঠিনতর করা ৩. জটিল ধারা ভেঙে বিভিন্ন উপধারায় বিভক্ত করে সহজীকরণ করা হয়েছে (যেমন: ধারা ৫২) ৪. কপিরাইট লঙ্ঘনজনিত মামলা দায়রা জজ ছাড়াও দ্রুত নিষ্পত্তির স্বার্থে বিশেষ আদালত বিচারার্থে গ্রহণ করতে পারবে ৫. যে কোনো অনুমোদিত সম্প্রচার বন্ধে কপিরাইট অফিসকে সময়ের প্রয়োজন রয়েছে
কপিরাইট আইন সংশোধনী কমিটির একজন সদস্য হিসেবে মনে করি কপিরাইট আইন সংশোধনসাপেক্ষে গৃহীত ব্যবস্থা এ ক্ষেত্রে ফলদায়ক হবে। সম্প্রতি ঢাকার আগারগাঁও-এ কপিরাইট অফিস হচ্ছে। আশাকরা যায় কাঠামোতে পরিবর্তন আসবে। তবে এই আইনে সুবিধাভোগীদের অংশগ্রহণ সচেতনতা একটা বড় বিষয় এবং আইন ভঙ্গকারীদের কঠোর শাস্তির নিশ্চয়তা বিধান গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের বাস্তবতায় সচেতনতার পাশাপাশি আইন ভঙ্গকারীদের কঠোর শাস্তির নিশ্চয়তা আইনের প্রতিপালনে একটি মোক্ষম অস্ত্র।
বইয়ের জগতে পাইরেসির ভূত ইতোমধ্যেই অনামিশা ডেকে এনেছে। প্রকাশিত নতুন বইয়ের পাইরেট কপি বাজারে চলে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে পিডিএফ কপিতেও বাজার সয়লাব। আর বিদেশি বইয়ের পাইরেট কপি তো হচ্ছেই। ইদানিং চিরায়িত সংগীতকে মৌলিক রচনা বলে চালিয়ে দেওয়া এবং সেগুলোর কপিরাইট বিভিন্ন ফন্দিবাজরা ভুল তথ্য দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে নিচ্ছে। এ ঘটনাগুলো কপিরাইট অফিস এমনকি আদালতের আঙিনা পর্যন্ত গড়িয়েছে। বিষয়গুলো সুসংহত আইন দ্বারা সহজেই সমাধান করা সম্ভব। মেধাস্বত্বের রক্ষণ যেমন জরুরি আবার মেধাস্বত্বের দোহাই দিয়ে সৃজনমনস্ক গবেষকদের কাজ যেন সংকুচিত না হয়, যে বিষয়গুলোও সংশ্লিষ্টদের দেখতে হবে।
মেধাস্বত্বের রক্ষণ সৃজনের মান ও ধারাবাহিকতা অবিমিশ্রভাবে চলমান রাখা আমাদের দায়িত্ব। প্রতিপক্ষের প্রতি প্লেজারিজম বা চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ আসতেই পারে, বিষয়টি প্রমাণসাপেক্ষ। আন্তর্জাতিক গ্রন্থ ও কপিরাইট দিবসের প্রাক্কালে আমি মনে করি, আমাদের সামগ্রিক উন্নয়নের সূচকে অর্থের মানদণ্ডের সঙ্গে সৃজনমনস্কতার মানদণ্ড নির্ধারণ জরুরি। সৃজনের পাখা বাধাহীনভাবে মেলে ধরতে যথাযথ কপিরাইট আইন প্রণয়ন এবং প্রতিপালন এখন সময়ের দাবি। এ জন্য প্রস্তাবিত নতুন কপিরাইট আইনের অনুমোদন জরুরি।
লেখক: সদস্য কপিরাইট আইন সংশোধনী কমিটি ও খণ্ডকালীন শিক্ষক, মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়ুন : *কপিরাইট: আইনি সুরক্ষা কোন পথে *কপিরাইট নিয়ে ফটোগ্রাফারদের ভাবনা *যে কারণে কপিরাইট আইন মানায় আগ্রহ কম