কপিরাইট

কপিরাইট: আইনি সুরক্ষা কোন পথে

সামগ্রিক অর্থে মানুষের সৃষ্টিশীল চিন্তার ফসল হচ্ছে ‘মেধা-সম্পদ’ যা মানবসমাজে বহুল পরিচিত ‘বস্তুগত সম্পদ’ থেকে ভিন্ন। মানুষ যখন তাঁর প্রতিভা, মেধা ও সৃজনশীলতা ব্যবহার করে মৌলিক কোনো শিল্পকর্ম সৃষ্টি করে তখন সেটি সৃজনকারীর সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয় যা মেধা-সম্পদ হিসেবে সংজ্ঞায়িত এবং বস্তুগত সম্পদের মতো এই মেধা-সম্পদও আইনগতভাবে সুরক্ষিত।

বস্তুগত সম্পদ যেমন: বাড়ি, গাড়ি ইত্যাদি মূর্ত। অর্থাৎ এগুলো দেখা যায়, স্পর্শ করা যায় কিন্তু মানুষের মেধা, চিন্তা ও সৃজনশীলতা বিমূর্ত। অর্থাৎ এগুলো দেখা যায় না, স্পর্শ করা যায় না। তবে এই বিমূর্ত চিন্তা, মেধা ও সৃজনশীলতা যখন কোনো মাধ্যমে বস্তুগতভাবে প্রকাশিত হয় তখন তা মূর্ত হয়ে ওঠে। যেমন, একজন লেখকের মেধা ও মননজাত ভাবনা যখন উপন্যাস বা কাব্যগ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয় কিংবা একজন চিত্রশিল্পীর সৃষ্টিশীলতা যখন চিত্রকর্মে রূপায়িত হয় তখন তা মূর্ত হয়ে ওঠে এবং বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

বর্তমানযুগে মেধা-সম্পদ বা ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। শিল্প সম্পদ সুরক্ষার জন্য ১৮৮৩ সালে অনুষ্ঠিত প্যারিস কনভেনশনে প্রথম মেধা-সম্পদ সুরক্ষার গুরুত্ব স্বীকৃতি পায় এবং ১৮৮৬ সালে অনুষ্ঠিত বার্ন কনভেনশনে সাহিত্য ও শৈল্পিক কাজ সুরক্ষার বিষয়টি স্বীকৃতি পায়। উভয় চুক্তির বাস্তবায়ন তদারকির দায়িত্ব আছে বিশ্ব মেধা-সম্পদ সংস্থা (WIPO)। সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ এর ২৭ নং অনুচ্ছেদে মানুষের মেধা-সম্পদ সুরক্ষার উল্লেখ রয়েছে। এ ধারায় কোনো বৈজ্ঞানিক, সাহিত্য বা নান্দনিক সৃষ্টির মালিকানা থেকে উদ্ভূত নৈতিক ও বস্তুগত স্বার্থ সংরক্ষণ থেকে প্রাপ্ত সুফল ভোগের বিষয়টি ঘোষিত হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মেধা-সম্পদ সুরক্ষা বিষয়ক জাতীয় আইন কার্যকর আছে। এসব আইনের উদ্দেশ্য হচ্ছে উদ্ভাবককে তাঁর সৃষ্টিশীল কাজের জন্য আইনগত স্বীকৃতি ও অর্থনৈতিক অধিকার প্রদান এবং সৃষ্টিশীলতার অগ্রগতিতে সহায়তার মাধ্যমে ন্যায়সঙ্গত বাণিজ্যকে উৎসাহিত করা, যা দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। 

মেধা-সম্পদ সাধারণত দুই শাখায় বিভক্ত ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোপার্টি’ এবং ‘কপিরাইট’। ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোপার্টির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে পেটেন্ট, ট্রেডমার্ক, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন (শিল্পনকশা), জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন (ভৌগলিক পরিচিতি) ইত্যাদি। ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোপার্টি বা শিল্প সম্পদ যেহেতু এক ধরনের উদ্ভাবন ও নতুন আবিষ্কার সেহেতু তা মানুষের মেধা ও সৃজনশীলতার প্রতিফলন। তাই এটি মেধা সম্পদের অন্তর্ভুক্ত।  মেধা-সম্পদের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হচ্ছে কপিরাইট বা লেখক স্বত্ব। এটি সাধারণত নান্দনিক, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক সৃষ্টিকর্মকে বুঝায়। কপিরাইট-এর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে উপন্যাস, কবিতা, নাটক, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত, সাহিত্যকর্ম, ড্রয়িং, পেইন্টিং, আলোকচিত্র, কম্পিউটার প্রোগ্রাম, ভাস্কর্য এবং স্থাপত্য নকশাসহ যে কোনো শৈল্পিক ও নান্দনিক সৃষ্টিকর্ম। ইংরেজি ব্যতীত অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষায় কপিরাইট অর্থ অথারস রাইট বা গ্রন্থকারের স্বত্ব। গ্রন্থকার বলতে যে কোনো শিল্পকর্মের স্রষ্টাকেই বোঝায়। বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তিগত অভাবনীয় উন্নয়ন ও বিকাশের ফলে বর্তমানে কপিরাইট সংক্রান্ত অধিকারের ব্যাপ্তি অনেক বিস্তৃতি লাভ করেছে। বর্তমানে রেডিও-টিভি, ইন্টারনেটের ওয়েবসাইটসহ সাইবার ওয়ার্ল্ডের সব ডিজিটাল সৃষ্টিকর্মও কপিরাইটের আওতাভুক্ত। 

কপিরাইট দ্বারা মেধাসম্পদের ওপর প্রণেতার নৈতিক ও আর্থিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে ওই মেধাসম্পদ বিভিন্ন পন্থায় পুনরুৎপাদন, বিক্রয়, বাজারজাতকরণ, লাইসেন্স প্রদান এবং জনসমক্ষে প্রদর্শনীর ক্ষেত্রে প্রণেতা বা সৃজনশীল ব্যক্তি একচ্ছত্র অধিকার লাভ করেন। মেধাসম্পদের আইনগত স্বীকৃতি প্রদান, উত্তরাধিকারসূত্রে মালিকানা নিশ্চিতকরণ এবং বর্তমান যুগে পাইরেসি, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কপিরাইট সংরক্ষণ, রয়্যালটি আদায় সঠিকভাবে নিশ্চিতকরণে কপিরাইট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কোনো সৃষ্টিকর্মের মৌলিকতাই হচ্ছে ওই সৃষ্টিকর্মের কপিরাইট সংরক্ষিত হওয়ার ন্যূনতম শর্ত। সৃষ্টিকর্ম প্রকাশিত হওয়া কিংবা শিল্পকর্মের মানের প্রশ্নের সাথে কপিরাইট সংযুক্ত নয়। কপিরাইটের মাধ্যমে যদিও লেখকের বা শিল্পীর মেধাস্বত্বের আইনি স্বীকৃতি প্রদান করা হয় কিন্তু এই স্বীকৃতির বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক দিকটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এর মাধ্যমে কপিরাইট হোল্ডার তাঁর শৈল্পিক কাজ থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ লাভ করে।

কপিরাইটের মেয়াদ সীমাহীন নয়। কোনো ব্যক্তির জীবদ্দশায় আজীবন তিনি তাঁর সৃষ্টিকর্মের কপিরাইটের অধিকারী। তাঁর মৃত্যুর পর ৬০ বছর পর্যন্ত উত্তরাধিকারীরা কপিরাইট ভোগ করবেন। ৬০ বছর পর কপিরাইট উন্মুক্ত হয়ে যায়, তখন অন্যরা ব্যবহার করতে পারবে বা প্রকাশ করতে পারবে। মানুষের সৃষ্টিশীলতা ও উদ্ভাবনীশক্তির বিকাশে কপিরাইটের গুরুত্ব অপরিসীম। স্বীকৃতি ও সন্তোষজনক আর্থিক পুরস্কার লেখক, শিল্পী ও সৃষ্টিকারীদের নতুন নতুন সৃষ্টিতে প্রণোদনা প্রদান করে, কর্মচাঞ্চল্য বাড়িয়ে দেয় এবং দেশ ও সমাজ সমৃদ্ধ হয়।  

কপিরাইট আইন ২০০০ দ্বারা বাংলাদেশে কপিরাইট বা মেধাস্বত্ত্ব আইনগতভাবে সংরক্ষিত। মেধা সম্পদের মালিকানা নিবন্ধনের লক্ষ্যে বাংলাদেশে ১৯৬২ সালে কপিরাইট অফিস প্রতিষ্ঠিত হয়। কপিরাইট অফিস একটি আধা-বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠান যেটির কার্যাবলী কপিরাইট আইন ২০০০ (২০০৫ সালে সংশোধিত) ও কপিরাইট বিধিমালা ২০০৬ মোতাবেক পরিচালিত হয়। কপিরাইট অফিস কর্তৃক কপিরাইট রেজিস্ট্রেশনের আওতার মধ্যে যে বিষয়গুলো রয়েছে, সেগুলো হচ্ছে; সাহিত্য, কম্পিউটার সফটওয়্যার, মোবাইল অ্যাপস, কম্পিউটার গেম, সংগীত, রেকর্ড (অডিও-ভিডিও), ই-মেইল, ওয়েবসাইট, সোশ্যাল মিডিয়া, বেতার ও টেলিভিশন সম্প্রচার, চলচ্চিত্র, নাটক, স্থাপত্য, নকশা, কার্টুন, চার্ট, ফটোগ্রাফ, বিজ্ঞাপন (ভিডিও, অডিও, পোস্টার, বিলবোর্ডসহ অন্যান্য), স্লোগান, থিম সং, ফেসবুক ফ্যানপেজ এবং বিভিন্ন ধরনের শিল্পকর্ম ইত্যাদি।

মেধাসম্পদের আর্থিক অধিকার হস্তান্তরযোগ্য। কপিরাইট নিবন্ধন করা হলে সৃজন কর্মের নৈতিক ও আর্থিক অধিকার অর্থাৎ মালিকানা সংরক্ষণ সহজ হয়। কপিরাইট নিবন্ধন আইনানুযায়ী বাধ্যতামূলক না হলেও, সৃজন কর্মের মালিকানা নিয়ে আইনগত জটিলতা দেখা দিলে ‘কপিরাইট নিবন্ধন সনদ’ প্রমাণপত্র হিসেবে বিজ্ঞ আদালতে ব্যবহৃত হতে পারে। কপিরাইট আইন ২০০০ অনুযায়ী, কোন ব্যক্তির যদি কপিরাইট ভঙ্গ করা হয় তিনি আদালতে দেওয়ানি ও ফৌজদারি প্রতিকার চাইতে পারবেন। কপিরাইট ভঙ্গের শাস্তি হতে পারে চার বছরের কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকার জরিমানা। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এ শাস্তি সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড ও পাঁচ লাখ টাকা। ফৌজদারি মামলার বিচার হবে দায়রা জজ আদালতে। এ ছাড়া জেলা জজ আদালতে কপিরাইট ভঙ্গের ক্ষতিপূরণ দাবি ও নিষেধাজ্ঞার আবেদন করা যাবে।

মেধা-সম্পদের অধিকার অন্যান্য বস্তুগত সম্পদের অধিকারের মতোই আইনগতভাবে সুরক্ষিত। যেহেতু মানুষের সৃষ্টিশীলতা, মেধা ও উদ্ভাবনের উপর মানবজাতির অগ্রগতি ও কল্যাণ নির্ভর করে সেহেতু মানুষের মেধা সম্পদের আইনি সুরক্ষা ও প্রসার অপরিহার্য, এর মাধ্যমে নতুন নতুন সৃষ্টিকর্মের সম্ভাবনা তৈরি হয়, দেশের আর্থ-সামাজিক প্রবৃদ্ধি তরান্বিত হয়। মেধা-সম্পদের অধিকার পুরস্কৃত করে সৃষ্টিশীলতা ও মানব প্রচেষ্টাকে, সভ্যতার অগ্রগতির ক্ষেত্রে যেটি প্রধান প্রণোদনা হিসেবে কাজ করে। মেধা-সম্পদের আইনি সুরক্ষায় সবার সচেতনতা প্রয়োজন যাতে মানুষের সৃষ্টিশীলতা ও উদ্ভাবন বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় 

আরও পড়ুন : *কপিরাইট: পাইরেসি ও চৌর্যবৃত্তি *কপিরাইট নিয়ে ফটোগ্রাফারদের ভাবনা *যে কারণে কপিরাইট আইন মানায় আগ্রহ কম