সাতসতেরো

উড়ন্ত পোকা ধরায় পটু নীলগলা চুটকি

চোখ জুড়িয়ে যায় বিচিত্র রঙের পাখি দেখে! সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমা! যত দেখি মুগ্ধ আকাঙ্ক্ষা প্রতিনিয়ত বেড়ে চলে। এ কারণেই বন থেকে বনে ছুটে বেড়ায় বার্ড ফটোগ্রাফাররা। পরিচিত হয় জীব-বৈচিত্রের সঙ্গে।

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের ভেতর ছোট পুকুর পাড়ে বসে আছি। চারদিকে পাখির কলতানে বন মুখরিত। সাদাগলা বুলবুলিগুলো ঝোঁপের ভেতর থেকে বের হয়ে আসছে। সঙ্গে আছে জলপাই বুলবুলি। এদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচানাচি করছে নীলরাজা। মাঝে মাঝে নীলরাজার পানিতে ডুব দিয়ে গোসলের দৃশ্য অসাধারণ!

এদের নানা অঙ্গভঙ্গি দেখতে গিয়ে অনেক সময় ক্যামেরায় চোখ রাখতেও ভুলে যেতে হয়। এদের সঙ্গে যোগ দিলো কমলা বউ, শ্যামা, ভীমরাজসহ আরো কিছু ছোট পাখি। এমন সময় হঠাৎ নজর পড়লো উড়ে এসে ডালে বসা একটি পাখির উপর। পাখিটি এতোই ছোট যে খালি চোখে দেখতে সমস্যা হচ্ছিল। ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে পাখিটিকে দেখে চমকে উঠলাম!

আগে কখনো পাখিটির সঙ্গে পরিচয় বা দেখা হয়নি। কিছুক্ষণ পর পাখিটি পুকুর পাড়ে একটি ডালে বসলো। সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা তাক করে বেশ কিছু ছবি তুললাম। অন্যান্য পাখির চেয়ে এর গোসল করার ভঙ্গি ব্যতিক্রম। সারা দেহ পানিতে ভিজিয়ে ডানা ঝাপটিয়ে গোসল করলো। আরো কিছু ছবি তুললাম। পাখিটির নাম ঘাটকি বা নীলগলা চুটকি।

Blue-throated blue flycatcher বা ঘাটকি Cyornis বংশীয় ১৪ সে.মি. দৈর্ঘ্যের Muscicapidae পরিবারের অন্তর্গত কালচে বাদামি চোখের পোকা-শিকারী পাখি। পূর্ণবয়স্ক পুরুষপাখির পিঠ ও গলা নীল। দেহতল সাদা। কপাল ও ভ্রু উজ্জ্বল নীল। গলা কালচে নীল। বুক লালচে। বগল ও  পেট সাদা। মেয়েপাখির কোমর জলপাই-বাদামি। গলা হালকা পীত-কমলা রঙের। বুক কমলা পেট সাদা। উভয়ের চোখ কালচে বাদামি। ঠোঁট বাদামি কালো। পা ও পায়ের পাতা ধূসর বাদামি।

ঘাটকি সাধারণত মুক্ত বনভূমি, বাঁশবন ও কুঞ্জবনে বিচরণ করে। একা থাকতে পছন্দ করে। মাঝে মাঝে জোড়ায় দেখা যায়। ছোট ছোট গাছ ও গাছের নিচে জন্মানো গুল্মলতায় খাবার খুঁজে বেড়ায়। এদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে উড়ন্ত পোকা ও পোকার ছানা। মাঝে মাঝে খাবারের জন্য মাটিতে নামতে দেখা যায়। মাটিতে শিকার ধরার পর আগের অবস্থানে ফিরে যায়। এরা ভয় পেলে চিকচিক শব্দে ডাকতে থাকে। এরা বিভিন্ন ধরনের শব্দে তীব্র সুরে গান গায়। অন্য পাখির ডাক অনুসরণে এরা পারদর্শী।

এপ্রিল থেকে আগস্ট মাস এদের প্রজননকাল। প্রজননকালে বাঁশের কোটর এবং গাছের গর্তে লাইকেন নামক শৈবাল ও মৃত পাতার সরু মূল বিছিয়ে বাসা বানায়। নিজেদের বানানো বাসায় মেয়েপাখিটি ৪-৫টি ডিম পাড়ে। ১২-১৪ দিনে ডিম থেকে ছানা বের হয়। বাবা-মা দুজনে মিলে সংসারের যাবতীয় কাজ করে।

ঘাটকি বাংলাদেশের বিরল পরিযায়ী পাখি। চট্টগ্রাম, খুলনা ও সিলেট বিভাগের সব বনে দেখা যায়। এ ছাড়াও ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, চীন ও থাইল্যান্ডসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এর বৈশ্বিক বিস্তৃত রয়েছে। এরা বিশ্বে ও বাংলাদেশে বিপদমুক্ত বলে বিবেচিত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এই প্রজাতি সংরক্ষিত।

বাংলা নাম: ঘাটকি বা নীলগলা চুটকি ইংরেজি নাম:  Blue-throated blue flycatcher বৈজ্ঞানিক নাম: Cyornis rubeculoides