কোকিল প্রজাতির বেশ কয়েকটি পাখি রয়েছে। তবে একটি প্রজাতির কোকিল আমার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়। অনেক দিন চেষ্টা করেও দেখা পাইনি। যখনই কোথাও কোকিল পরিবারের পাখি দেখতাম তখনই এই কোকিলটির কথা মনে হতো। অনেক দিন অধরা ছিল পাখিটি। সাধারণত লোকালয়ে এই প্রজাতির কোকিল দেখার সুযোগ নেই। এরা পরিযায়ী পাখি। গ্রীষ্মকালে আমাদের দেশে আসে।
২০১৯ সালের ১৮ জুলাই আমরা যারা একসঙ্গে বার্ড ফটোগ্রাফি করি তারা ‘অভিযাত্রিক সুন্দরবন’-এর ব্যানারে ১০ জনের একটি দল ঢাকা থেকে মংলার উদ্দেশ্যে রওনা দেই। আগে থেকেই ‘ফেমাস ট্যুর বিডি’-এর কর্ণধার রুবেল সব কিছু গুছিয়ে রেখেছিলেন। এমভি গাঙচিল নামের একটি ছোট লঞ্চে কিসমত ভাই, ডা. নাজমুল ভাই, ড. আমিনুর রহমান ভাই, আফজাল ভাই, অনুপম সিং, খোকনদা, এস. ভুইয়া নাজিম, সাজন, মাসুদ রানা সে যাত্রায় সঙ্গী ছিলেন। রাতে কটকা অফিস পাড়ায় লঞ্চ নোঙর করে।
লঞ্চের কেবিনে রাত যাপন করে পরদিন খুব ভোরে কটকার জামতলা পৌঁছি। কিছু সময় সেখানে কাটিয়ে ছোট দেশীয় নৌকায় জামতলী খাল দিয়ে যাচ্ছিলাম। এমন সময় খালের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে কেওড়া গাছের ডালে লালচে রঙের লেজ বড় একটি পাখি বসলো। পাখিটি সম্পর্কে আমার আগে ধারণা ছিল না। নৌকায় বসে সবাই পাখিটি খুঁজতে লাগলাম। হঠাৎ নজরে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা তাক করে মাত্র দুটি ক্লিক করতে পেরেছিলাম। আমার সঙ্গীরা কেউই পাখিটিকে ক্যামেরায় বন্দী করতে পারলেন না। তার মূল কারণ মাত্র কয়েক সেকেন্ড পাখিটি ছিল। তারপর কোথায় যে উড়ে গেল আর খুঁজে পাওয়া গেল না।
পরবর্তী সময়ে কটকার জামতলীতে কয়েকবার পাখিটির দেখা পেলাম। কিন্তু ছবি তুলতে পারিনি। নৌকায় বসে পাখিটির ছবি তোলায় ছবিটি তেমন ভালো হয়নি। তারপরও পাখিটিকে ক্যামেরা বন্দী করতে পারায় আমার সংগ্রহে আরেকটি নতুন পাখি যোগ হলো। এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কি হতে পারে!
এতক্ষণ যে পাখিটির কথা বলছিলাম তার নাম লালপাখা কোকিল বা লালডানা কোকিল। Cuculidae পরিবারের অন্তর্ভূক্ত আকার ভেদে ৩৮-৪৬ সে.মি. এবং ৬৬-৭০ গ্রাম ওজনের লম্বা লেজের ঝুটিওয়ালা পাখি। তামাটে ডানা ও ঘাড়ের পেছনের দিকের সাদা গলাবদ্ধ ছাড়া পিঠ চকচকে কালো। থুতনি, গলা ও গোলাপি বুক ছাড়া দেহের নিচে সাদা। মসৃণ কালো মাথায় লম্বা ঝুটি পেছনের দিকে হেলে থাকে। লেজের আগা সাদা। চোখ লালচে বাদামি। ঠোঁটের নিচের অংশের গোড়া হলুদ। পা ও পায়ের পাতা বাদামি। মেয়ে ও ছেলেপাখির পার্থক্য নাই।
লালডানা কোকিল চিরসুবজ বন, আর্দ্র পাতাঝরা বন, বনভূমি ও ছোট ঝোঁপে বিচরণ করে। এরা একা বা জোড়ায় থাকে। অনেক সময় ৩-৪টি পাখি দল বেঁধে উড়ে বেড়ায়। এরা এক ডাল থেকে অন্য ডালে লফিয়ে ও ঝোঁপের ঘন পাতায় খাবার খুঁজে বেড়ায়। এদের খাবার তালিকায় রয়েছে শুঁয়ো পোকা। প্রজননের সময় পুরুষপাখি সুন্দর গান গায়। এপ্রিল থেকে আগস্ট মাস এদের প্রজননকাল।
এরা কোকিলের মতো নিজেরা বাসা বানায় না এবং ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায় না। ছাতার বা বাবলারের বাসায় মেয়েপাখি ২-৩টি ডিম পেড়ে চলে যায়। পরে ছাতার পাখি তাদের ডিমের সঙ্গে এদের ডিম তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায়। বাচ্চাদের লালন-পালন ও খাবার ছাতার পাখিই করে। অন্যের বাসায় ডিম দিয়ে এরা নিশ্চিন্তে মনের সুখে বনে ঘুরে বেড়ায়।
লালপাখা কোকিল বাংলাদেশের দুর্লভ পরিযায়ী পাখি। গ্রীষ্মকালে সুন্দরবন ছাড়াও খুলনা ও সিলেট বিভাগে দেখা যায়। এ ছাড়াও ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এর বৈশ্বিক বিস্তৃত রয়েছে। এরা বিশ্বে বিপদমুক্ত বলে বিবেচিত। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এরা সংরক্ষিত।