‘One is not born, but rather becomes, a woman’ সমঅধিকার লড়াইয়ে নারী জাগরণের অগ্রদূত, বিখ্যাত ফরাসি লেখিকা সিমন দ্য বোভোয়ার বহুকাল আগে নারী সম্পর্কে এই উক্তি করেছেন। কিন্তু তাঁর এই কথা বাসি হতে আমাদের আর কতটা পথ এগুতে হবে ঈশ্বরেরও হয়তো জানা নেই। আজ অবধি আমাদের সমাজে নারীদের ক্ষেত্রে এই উক্তিটি সাম্প্রতিক এবং সদ্যপ্রসূত। একজন মানুষকে আমাদের সমাজ, সভ্যতা ধীরে ধীরে নারীতে পরিণত করে, আবার এই সমাজই তাকে পণ্য হিসেবে প্রমোট করে।
নারীর ক্ষমতায়ন, নেতৃত্ব বা তার আর্থিক অবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার সরব অস্তিত্বকে পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে স্বীকার করে নেওয়া হবে এই ভাবনা এখনো পর্যন্ত ভাবনার জগতেই রয়ে গেছে। অর্থাৎ কোনো নারী নেতৃত্বে, মেধায়-মননে, অর্থ বিত্ত ক্ষমতায় যত সফল হোক না কেন, সমাজের অন্যসব সফল পুরুষের সঙ্গে এক কাতারে তাকে মেনে নেওয়ার মানসিকতা এখনো আমাদের মধ্যে তৈরি হয়নি। বরং মোটা দাগে তাকে ফেমিনিন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। নারীর শিক্ষা, পেশা, চলাফেরার গণ্ডী, সময় সবকিছুই যে এখনো আলাদা এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ তার প্রমাণও আমরা প্রায়ই পাচ্ছি। যার সদ্যপ্রাপ্ত নজির বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পের একজন সফল অভিনেত্রী পরীমনি।
সম্প্রতি পরীমনির ফেইসবুক পেইজের একটি পোস্ট ভাইরাল হয়েছে। যেখানে পরীমনি জানিয়েছেন, সাভারের একটি বোট ক্লাবে তাঁকে ধর্ষণ এবং হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছে। এর সঙ্গে নির্দিষ্ট কয়েকজনের নামও তিনি পরবর্তীকালে জানিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যৌন নিগ্রহ বা নির্যাতনের স্বীকার হয়ে থানা বা পুলিশকে না জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি কেন লিখলেন? সেই প্রশ্নের জবাবও উক্ত পোস্টে দিয়েছেন পরীমনি। শুরুতে থানা তাঁর অভিযোগ গ্রহণ করেনি এবং পরের চারদিন তিনি বিভিন্ন জনের সঙ্গে দেনদরবার করেও কারো কাছে সহায়তার আশ্বাস পাননি। অভিযোগ গ্রহণ না করা বা আশ্বাস না পাওয়ার বিষয়টি আমাদের দেশের জন্য নতুন কিছু নয়। তার চেয়েও ভয়ঙ্কর হলো, পরীমনি যে পাব্লিক পোস্টটি করেছেন সেই পোস্টের নিচের মন্তব্য এবং তাতে ব্যবহার করা কিছু ইমোজি। আমি বলছি না সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতিক্রিয়া আমাদের সমাজের পুরো চিত্র, তাই বলে এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে যোগাযোগ মাধ্যমের সদস্যরা আমাদের সমাজেরই প্রতিনিধিত্ব করে। সুতরাং তার হিসাব আমলে না নেবার কোনো কারণ নেই।
আমি যখন এই লেখা লিখছি তখন পর্যন্ত পরীমনির করা শুধু সেই পোস্টে হাহা রিয়াক্ট (অট্টহাসি) এর সংখ্যা সাতষট্টি হাজার ছাড়িয়েছে। বলবেন শুধু হাহার পাশে লাইক লাভ রিয়াকশনও তো আছে। হ্যাঁ আছে, কিন্তু এই ধরনের পোস্ট কি অট্টহাসির একটি ইমোজিও ডিজার্ভ করে?
পরীমনির এই সংক্রান্ত প্রতিটি খবরের লিংক বা পোস্টের নিচে লেখা মন্তব্যগুলো এতটিই অশ্লীল, নোংরা আর বিদ্বেষে ভরা যে, পড়লে মনে হবে এ কোন যুগে বাস করছি আমরা? হিপোক্রেসি আর অশিক্ষা যে সমাজ রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে সেটা বুঝতে খুব বেশি জানার প্রয়োজন পড়ে না। সবচেয়ে বড় কথা, নারী বা পুরুষ নয়, একজন মানুষের আহাজারি, যন্ত্রণা, হতাশা বা কান্না যদি কোনো সমাজের অন্য মানুষদের আনন্দ দেয়, রম্যরসের অনুভূতি জাগায়, তাহলে বুঝতে হবে সেই সমাজ বুদ্ধি-বিবেচনা হারিয়ে ফেলেছে। তার দৃষ্টিতে ঠুলি লাগানো। তার মানবিকতার ওপর মোহর পড়ে গিয়েছে। এবং এই সমাজের সামনে অন্ধকারের পথই কেবল প্রসারিত কোথাও আলোর স্ফুলিঙ্গ-মাত্র নেই।
এ তো গেলো সাধারণ মানুষের রিয়াক্ট বা মন্তব্যের কথা, কিন্তু দেশের তথাকথিত শিক্ষিত প্রগতিশীল হিসেবে পরিচিত লোকজন যখন প্রশ্ন করেন, এত রাতে পরীমনি কেন বাইরে বেরিয়েছিলেন? বের হলেন তো ক্লাবে গেলেন কেন? তাঁর সঙ্গে কারা ছিল, কেন ছিল? তিনি কি পোশাকে ছিলেন? তিনি কি মদ খেয়েছিলেন? বাহরে বাহ! আপনাদের প্রশ্নই আপনাদের মুখোশ খুলে উন্মুক্ত করেছে। সেখানে এবড়ো-থেবড়ো ঘায়ে মাছির ভনভনানি। পরীমনি রাত বারোটার পরে বেরিয়েছেন বলে তাঁকে আপনি রেইপ করার অধিকার পেয়ে গেলেন? তিনি পোশাক ছোট পরেছেন বলেই আপনার রাইট আছে তাঁর সঙ্গে জোরজবরদস্তি করার? নাকি তিনি অভিনয় জগতের মানুষ বলেই বেশ্যা? জেনে রাখেন যারা টাকা দিয়ে বেশ্যাবৃত্তি করেন অনুমতি ছাড়া তাঁদের শরীরের একটি লোমও আপনার স্পর্শ করার ক্ষমতা আইন আপনাকে দেয়নি। আমি এই সংক্রান্ত বিভিন্ন খবরের লিংকে অসংখ্য মন্তব্য পড়েছি। এবং খুবই হতাশা আর ক্ষোভের সাথে লক্ষ্য করেছি সিংহভাগ মন্তব্যই পরীমনির পেশা, পোশাক ইত্যাদি বিষয়কে কটাক্ষ করে লেখা। যার সারবাক্য: ‘এমনটি তো হবারই কথা!’
মানে কী দাঁড়ালো? মানে হলো, মেয়ে বেশি রাতে বাইরে বেরিয়েছ কেন- রেপ তো হবেই। এত ছোট পোশাক পরে পুরুষকে রেপে উৎসাহ দিয়েছ রেপ তো হবেই, বাচ্চা মেয়ে তাতে কি, একা একা ঘরের বাইরে বের হয়েছ ধর্ষণ হবারই কথা, এত রাত পর্যন্ত চাকরির কি দরকার ছিল- রেপ হবে না? হিজাব পরেছ, বোরকা চড়িয়েছ ভালো কথা, মাহরাম ছাড়া ঘরের বাইরে বের হলে রেপ হতেই পারে। সিনেমা নাটকে অভিনয় করো? আরে তোকে তো রেপ করার অধিকার আছে- এই হলো মানসিকতা। সভ্যতা শিক্ষা সংস্কৃতির অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষের ক্রমশ মানুষ হয়ে ওঠার কথা, অথচ আমাদের সমাজে এই ধরনের প্রতিবন্ধী মানসিকতার অমানুষের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
পরীমনি ঢাকার চলচ্চিত্রের একজন মেধাবী এবং জনপ্রিয় অভিনেত্রী। তিনি নিশ্চয় আর দশজন নারীর মতো সাধারণ নন। বরং একজন গুণী শিল্পী। তবুও তিনি একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেই তাঁর ওপর হয়ে যাওয়া অন্যায়ের বিচার চেয়েছেন। তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করলেও প্রকারান্তরে জনগণের দরবারে আপিল করেছেন। আর তার প্রতিদানে আমরা তাঁকে কী দিলাম? ধিক্কার আর অট্টহাসি? তাঁর বিচার চাওয়া কি ভুল? শারীরিক এবং মানসিকভাবে তিনি যে হেনস্থার শিকার হয়েছেন, যন্ত্রণা ভোগ করছেন, যন্ত্রণা প্রকাশ করতে গিয়ে তাঁর চোখ অশ্রুশিক্ত হয়েছে সেটা কীভাবে আপনার কাছে অভিনয় মনে হয়? কেন হাস্যকর লাগে? তাহলে আপনিই বলে দিন- পরীমনি কি করলে খুশী হতেন- বিচার দাবী না করলে নাকি মুনিয়ার মতো আত্মহত্যা করলে?
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ‘উড়তে শেখার আগেই পিঞ্জরাবদ্ধ এই নারীদের ডানা কেটে দেওয়া হয়। এবং তারপর সামাজিক রীতিনীতির জালে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা হয় তাঁদের’। রোকেয়ার বলে যাওয়া সেই কথাগুলো আদৌ কি পুরানো মনে হচ্ছে? না। পার্থক্য সময়ের মাত্র। শৃঙ্খল সেই আগের মতই আছে। একটু আড়াল বা আবডাল থাকায় পায়ে লাগানো শেকলটা হয়তবা সবসময় দেখা যায় না- তবে হঠাৎ হঠাৎ বেরিয়ে আসে।
এত কিছুর পরেও আমরা এই ভেবে আশাবাদী যে একদিন নিশ্চয় এই মানসিকতার পরিবর্তন ঘটবে। তবে তারজন্য চুপচাপ বসে অপেক্ষা করলে চলবে না, দরকার মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ তৈরির সামাজিক আন্দোলন। যেটি শুরু করতে হবে পরিবার থেকেই।
যাই হোক, আমি পরীমনিকে আন্তরিকভাবে অভিবাদন জানাই যে, তিনি এতো জঞ্জালের মাঝেও মুনিয়ার মতো হারিয়ে যাননি। কে কী বলবে, কী ভাববে এমন সনাতনী ভাবনায় আচ্ছন্ন না হয়ে নিজের অস্তিত্বের জানান দিয়েছেন। প্রতিবাদ করেছেন। একজন পরীমনি হাজারো পরীমনির সামনে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত রেখেছেন। পরীমনির এই দিন একদিন সেই দিনের কাছে নিয়ে যাবে যেদিন নারী শুধু নারী হিসেবে নয়, বরং একজন প্রতিনিধি হিসেবেই সমাজে স্বীকৃতি পাবে, পরিচিত হয়ে উঠবে। প্রতিটি পরিবারে পরীমনির মতো আগুনকণ্ঠের জন্ম হোক।
লেখক: প্রভাষক ও কথাসাহিত্যিক