পানির অপর নাম জীবন হলেও সব পানি সব জায়গায় যেমন ব্যবহার করা যায় না, তেমন সব স্থানের পানির অপর নাম জীবন হতে পারে না। একমাত্র বিশুদ্ধ পানির অপর নাম জীবন। বলা যায়, জীবনের বাহক হচ্ছে পানি। খাদ্য ছাড়া হয়তো একজন মানুষ কয়েক সপ্তাহ বেঁচে থাকতে পারেন কিন্তু পানি ছাড়া ১০-১২ দিনের বেশি বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।
মানুষের শরীরের প্রায় ৬০-৭০ ভাগ পানি। শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং শরীর সুস্থ্য রাখতে নিরাপদ পানি জরুরি। সম্প্রতি এক জরিপে দেখা যায়, নিরাপদ পানির ও স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবহরের অভাবে বিশ্বে প্রতিদিন পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ১৪০০ শিশুর মৃত্যু হয়। শিশুরা সবচেয়ে বেশি নিরাপদ পানির সংকটে ভোগে।
জীবনের সাথে পানির রয়েছে এক অবিচ্ছিন্ন আন্তঃসম্পর্ক। মানুষের পান করার জন্য প্রয়োজন নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানি। যেসব পানিতে ময়লা, আবর্জনা, রোগজীবাণু থাকে না, তাকেই আমরা বিশুদ্ধ পানি বলি।
পৃথিবীর উপরিভাগের প্রায় চার ভাগের তিনভাগ পানি। সব পানি নিরাপদ নয়। ৯৭.৫ শতাংশ পানি লবণাক্ত, পানের অযোগ্য। বাকি মাত্র ২.৫ শতাংশের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি পানি বরফ হয়ে পৃথিবীর জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষা করে। আবার বাকি পানির তিন-চতুর্থাংশ ভূ-গর্ভস্থ পানি এবং মাত্র ০.৩ শতাংশ থাকে নদ-নদী, খাল-বিল ও হ্রদে। সুতরাং পৃথিবীর মোট পানির শতকরা একভাগেরও কম পানি পানের যোগ্য।
বৃষ্টি, নদী–নালা, খাল-বিল হৃদ ইত্যাদি প্রাকৃতিক উৎস থেকে মনুষ্য সৃষ্ট উৎস পুকুর, কুয়া, নলকূপ ও পানির কল ইত্যাদি থেকে আমরা পানি পাই। এই নদী- নালা, খাল-বিল, পুকুর এমনকি ভূ-গর্ভস্থ পানি বিভিন্নভাবে দূষিত হচ্ছে। আজকাল আমাদের দেশে যেখানে-সেখানে শিল্প কারখানা স্থাপিত হচ্ছে। আর এসব শিল্প কারখানার উৎপাদিত বর্জ্য সঠিকভাবে পরিশোধন না করে সরাসরি নদী-নালার পানিতে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। ফলে ভূগর্ভের পানি দূষিত হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে হাজারো মানুষ বিশুদ্ধ পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আমাদের দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় বন্যা হয়। আর এসব অঞ্চলের মানুষ নিরাপদ পানির অভাবে বিভিন্নরকম রোগে ভুগছে।
আমাদের দেশের সমতলের দুই তৃতীয়াংশ সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৫ মিটারের চেয়ে কম উঁচু ও হিমালয়ের পাদদেশে হওয়ায় ঘন ঘন বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে পানির উৎস দূষিত হচ্ছে। আবার জলবায়ু পরিবর্তন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অধিক সংখ্যক মানুষের শহরমুখীতা ইত্যাদির কারণেও পানির উৎস দূষিত হচ্ছে। এছাড়াও অল্প বৃষ্টি হলেই ঢাকা, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামের মতো শহর প্রায় পানির তলায় হারিয়ে যায়। জলাবদ্ধতার ফলে পানি দূষিত হচ্ছে, মানুষ চরমভাবে বিশুদ্ধ খাবার পানি সংকটে ভূগছে।
এদিকে শিল্পবর্জ্যরে কারণে পানিতে বিষাক্ত ধাতু যুক্ত হচ্ছে। সেচের জন্য অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে মাটিতে থাকা ভারী ধাতুগুলো পানিতে মিশে যাচ্ছে। ফসল চাষের জন্যে অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহার ও উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণেও পানির উৎস দূষিত হচ্ছে।
আমাদের উন্নয়নশীল দেশে পানি দূষণ একটি মারাত্মক সমস্যা। দেশের প্রায় মানুষ দ্রারিদ্য সীমার নিচে বাস করে, যাদের জন্য বিশুদ্ধ পানি পান করা এক ধরনের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘন ঘন বন্যার ফলে পানিবাহিত রোগ; যেমন- কলেরা, ডায়রিয়া, আমাশয় ইত্যাদি রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটছে।
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পৃথিবীর ২ বিলিয়ন মানুষ এখনো নিরাপদ পানি পান করা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিশ্ব ব্যাংক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও উইনিসেফের এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশ মানুষের নিরাপদ পানি পান করার সম্ভাবনা আছে, কিন্তু মাত্র ৩৪ দশমিক ৬ শতাংশ নিরাপদ পানি পান করে।
বায়োটেকনোলজি বা জৈব প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা খুব সহজে ও অল্প খরচেই সহজ পদ্ধতিতে পানি পরিশোধন করতে পারি।
শ্যাওলার মাধ্যমে পানি পরিশোধন: বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এ দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রচুর পরিমাণ বিভিন্ন রঙের শ্যাওলা জন্মে। পাহাড়ি অঞ্চলে ভূমির ঢালের লেকে জন্মানো শ্যাওলা লেকের পানি পরিষ্কার রাখে। এইসব শ্যাওলা দিয়ে আমরা সহজেই পানি পরিশোধ করতে পারি। সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক “স্ক্যানেবল অ্যান্ড সাসটেইনেবল টোটাল প্যাথোজেন রিমোভাল ফিল্টার পেপার ফর ফয়েন্ট অব ইউজ ড্রিংকিং ওয়াটার পিউরিফিকেশন ইন বাংলাদেশ” শীর্ষক জার্নালে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ পায়। গবেষণায় বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল মোজাদ্দেদ আলফেসানী ও মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. আনোয়ারা বেগম ও গবেষক ড. শারমিন জামান এবং সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যানোটেকনোলজির অধ্যাপক আলবার্ট মিহরানিয়ান বলেন, ‘পিথোফোরা’ নামক গোত্রের শ্যাওলা দিয়ে দূষিত ময়লা যুক্ত পানিও পরিশোধন করা যায়। এর দ্বারা পানিতে থাকা বিভিন্ন ময়লা ক্ষতিকর উৎপাদান, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস পরিশোধন করা সম্ভব। যা কিনা পানিকে ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ বিশুদ্ধ করে এবং পানিতে থাকা ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, এমনকি ২৭-২৮ ন্যানোমিটারের ক্ষুদ্র ভাইরাসও পারিশোধন করা সম্ভব।
এই জৈব প্রযুক্তি ব্যবহার করে একদিকে যেমন বাংলাদেশের মানুষের নিরাপদ পানি নিশ্চিত করা সম্ভব, অন্যদিনে বন্যার ফলে কলেরা, ডায়রিয়া ও আমাশয়ের মতো রোগগুলোর প্রতিরোধ করা সম্ভব। আবার পানিতে জন্মানো এডিস মশার প্রাদুর্ভাবও অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভব হবে। সম্প্রতি এই জৈব প্রযুক্তি ব্যবহার করে তুরাগ নদী ও ধানমন্ডি লেকের পানি পরিশোধন পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয়েছে।
ফার্ন জাতীয় উদ্ভিদের মাধ্যমে পানি পরিশোধন: অনেক সময় নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর, ডোবা, লেক ও সমুদ্রের পানিতে নানা ধরনের তৈলাক্ত পদার্থ মিশ্রিত থাকে। পানিতে থাকা এসব রাসায়নিক কারখানার নানারকম বর্জ্য, গৃহস্থালির বর্জ্য এবং লঞ্চ ও জাহাজ দুর্ঘটনায় নানা ধরনের তৈলাক্ত পানি পরিশোধনের জন্য আমরা জৈব প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারি। এক্ষেত্রে আমরা ফার্ন জাতীয় উদ্ভিদ জৈব প্রযুক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। এই উদ্ভিদ ঊষ্ণ অঞ্চলের প্রাকৃতির পরিবেশে জন্মায়। এই উদ্ভিদ জলাশয়ের নিকটে বৃদ্ধি পায় এবং অনেক সময় জলের উপর ছড়িয়ে পড়ে।
সম্প্রতি জার্মানির কার্লসরুহে ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (টিআইকে) এবং বনবিশ্ববিদ্যালয়ের একদল জার্মান গবেষক পরীক্ষা করে দেখেন, ফার্ন জাতীয় উদ্ভিদ সমুদ্রের তৈলাক্ত পদার্থ শোষণ করতে সক্ষম। ফলে এটি তৈলাক্ত পানি পরিশোধন করে বিশুদ্ধ করে। আবার ফিলিপাইনের এটি ব্যবহার করে পানি পরিশোধন করে। বাংলাদেশের পরিবেশে এই জাতীয় উদ্ভিদ প্রচুর পরিমাণ জন্মে, এটি ব্যবহার করে আমরাও খুব সহজে পানি পরিশোধন করতে পারবো, যাতে আমাদের দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষের নিরাপদ পানি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
সম্প্রতি জলবায়ু বিষয়ক জাতিসংঘের প্যানেলের গবেষণা বলছে, প্রতি ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য ২০ ভাগ বিশুদ্ধ পানি কমে যাচ্ছে। আর এভাবে চলতে থাকলে ২০৩০ সাল পর্যন্ত বিশ্বে ৪০ ভাগ বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট দেখা দেবে। এই বিশুদ্ধ খাবার পানি সংকট থেকে বঞ্চিত মানুষের বাঁচার একমাত্র উপায় হতে পারে জৈব প্রযুক্তি। অথাৎ নিরাপদ পানির অভাব মানে প্রাণের সংকট, সমাজ-সংস্কৃতি ও অর্থনীতির সংকট। ফলে কোটি কোটি মানুষ নিরাপদ পানি হতে বঞ্চিত হচ্ছে। জৈব প্রযুক্তি প্রয়োগ করে কাজ করলে পরিবেশের দূষণের মাত্রা অনেকটা কমে যাবে। পরিবেশ উপকৃত হবে।
সুতরাং এই থেকে উত্তোরনের জন্য আমাদেরই জৈব প্রযুক্তি নীতি” গ্রহণের পাশাপাশি পানি পরিশোধনের জন্য রাষ্ট্রীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: শিক্ষার্থী, এনভায়রনমেন্ট সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।