অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টি সিরিজে বাংলাদেশের ভূমিধস জয়ে অন্যতম প্রাপ্তি হলো বড় দলের বিরুদ্ধে জয়ের ধারাবাহিকতা ও আত্মবিশ্বাস। এমনিতেই বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ খেলতে অস্ট্রেলিয়া অনীহা দেখাতো। একধরনের উন্নাসিক আচরণ করতো। এবারো করোনার সময়ে কোভিড প্রোটোকল নিয়ে নানা টালবাহানায় সিরিজের ভাগ্য দোদুল্যমান ছিল। দুটি দলই নানা কারণে মূল দলের কিছু খেলোয়াড় ছাড়াই ৭ দিনে ৫ ম্যাচের সিরিজ শুরু করেছিল ৩ অগাস্ট। ৯ আগস্টে সিরিজ শেষে ফলাফল বাংলাদেশ ৪ অস্ট্রেলিয়া ১। অনেক কষ্টে কোনমতো সিরিজে একটি ম্যাচ জিতে সফরকারীরা হোয়াইটওয়াশ এড়িয়েছে।
মিরপুরের শের-ই-বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের উইকেট কেমন ধাঁচের সেটা মুলত সবার জানা। ধীর গতির অসমান বাউন্সের উইকেটে স্পিন বেশ ভাল ধরে। উইকেটে বল পড়ার পর গ্রিপ করে। ব্যাটে বল আসে অনেক দেরিতে। এই ধরনের উইকেটে মানিয়ে নিতে টাইমিং এবং ফুটওয়ার্ক দুটোই খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এমন উইকেটের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া অভ্যস্ত নয়। অতিথি দল যে চ্যালেঞ্জে পড়বে সেটা জানাই ছিল। তবে অস্ট্রেলিয়া তাদের বিশ্বসেরা বোলিং আক্রমণ দিয়ে এই চ্যালেঞ্জ ভালো মতো সামাল দিতে পারবে বলে সিরিজ শুরুর আগে অনেকে মন্তব্য করেছিলেন। সিরিজ শেষে দেখা গেল বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানরাও চিরচেনা উইকেটে ভালো ব্যাটিং করতে পারেননি। কিন্তু অনুকূল উইকেটে রহস্যময় বোলিং করেছেন মোস্তাফিজুর রহমান, তরুণ তুর্কি শরিফুল ইসলাম, স্পিনার নাসুম, মেহেদী এবং বিশ্বসেরা সাকিব আল হাসান, যিনি এই সিরিজের সেরা পারফর্মার। পুরো সিরিজে অধিনায়ক হিসেবে বিচক্ষণভাবে দলের সম্পদ ব্যবহার করেছেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। ১৩১ , ১২১, ১২৪ রানের মতো মামুলি সঞ্চয় নিয়েও ম্যাচ জেতা সহজ কথা নয়। একবার নয়, পুরো সিরিজে এমন কীর্তি বেশ কয়েকবার করে দেখিয়েছে বাংলাদেশ। সিরিজের চতুর্থ যে ম্যাচে বাংলাদেশ হেরেছে সেখানেও লড়েছে দারুণ শক্তিতে। বড় দলের বিরুদ্ধে এমনভাবে শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ের মানসিকতাই এই সিরিজে বাংলাদেশের বড় অর্জন।
অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, এমন উইকেটে খেলে বাংলাদেশের কি লাভ হলো? আসন্ন আইসিসি টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্য দুই দলের প্রস্তুতি যুৎসই হলো না। মানছি এই প্রশ্ন তোলার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি আছে। কিন্তু সেই সঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, জয় কিন্তু আত্মবিশ্বাস তৈরি করে। জয় সবসময় অনুপ্রেরণার। আইসিসি র্যাংকিংয়ের পঞ্চম দলকে যখন দশম দল ধরাশায়ী করে সিরিজ জিতে তখন উইকেট, পরিবেশ বা দুই দলে কে আছে কে নেই সেসব বিষয় বিবেচনার সুযোগ নাই।
আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে যে কোন কন্ডিশন এবং উইকেটের সঙ্গে নিজেকে দ্রুততম সময়ে মানিয়ে নেওয়ার দক্ষতা আবশ্যিক প্রয়োজনীয় একটি শর্ত।
বিশ্বকাপের পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে পরিচিত হওয়া অস্ট্রলিয়া দলের বাংলাদেশ সফরের অন্যতম উদ্দেশ ছিল বলাই বাহুল্য। সব ম্যাচ শের-ই-বাংলা স্টেডিয়ামে হতে হবে এই শর্তও অস্ট্রেলিয়াই জুড়ে দিয়েছিল। এই মাঠের উইকেট কেমন হয় তা নিয়ে নিশ্চয়ই অস্ট্রেলিয়া হোমওয়ার্ক করেই এসেছিল। কন্ডিশন অনুযায়ী দল নির্বাচন যদি না করে থাকে তাহলে সেই দায় তো খোদ ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার।
অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে অনেক উন্নত ক্রিকেট খেলেই সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ। ৪-১ ব্যবধানে এই সিরিজের ফলটাই জানাচ্ছে বাংলাদেশ দল এই সিরিজে প্রতিপক্ষের চেয়ে অনেক বেশি স্মার্ট ক্রিকেট খেলেছে। শক্তিমান অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে এই সিরিজ জয়ের সঙ্গে সঙ্গে আরো অনেক কিছু পেয়েছে বাংলাদেশ।
সিরিজের বড় অর্জন আর্ন্তজাতিক টি- টোয়েন্টিতে বিশ্বের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে সাকিব আল হাসানের হাজার রান এবং শতাধিক উইকেটের বিশ্ব রেকর্ড। মোস্তাফিজ আবারো প্রমাণ করলেন এখনো তিনি বিশ্বের ‘রহস্যময়’ বোলার। যাকে ব্যাটসম্যানরা খেলতেই পারে না! বল ব্যাটে লাগাতেই পারে না! তরুণ শরিফুল, আফিফ, সোহানও এই সিরিজে বিকশিত হয়েছেন। ঘরের মাটিতে টি- টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ এখন দারুণ শক্তিমান দল। নিজ মাঠে পেছনের নয়টি ম্যাচের আটটিতেই জিতেছে বাংলাদেশ। এই সিরিজের বড় ব্যবধানে জয় আসন্ন নিউ জিল্যান্ডের বিরুদ্ধে পাঁচ ম্যাচের সিরিজেও বাংলাদেশকে ভালো আত্মবিশ্বাস যোগাবে।
অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে এই সিরিজ জয়কে যারা ক্রিকেট অঘটন বলছেন তারা ভুল বকছেন। প্রতিটি ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যানদের ত্রাহি এবং বেহাল অবস্থা দেখে বোঝা গেছে বাংলাদেশের বোলিংয়ের কোন জবাবই তাদের কাছে নেই। অঘটন একটা-দুটো ম্যাচে ঘটে। সিরিজের অধিকাংশ ম্যাচে ঘটে না। বাংলাদেশ এই সিরিজে মাঠের বাইরে থেকে ২২ গজের মধ্যে পুরোটা জুড়ে অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে ভালো ক্রিকেট খেলেছে। জিতেছে ফেভারিটের কায়দায়।
এই সিরিজে বাংলাদেশের সাফল্যকে কেউ যদি অঘটন বলে তাহলে বুঝতে হবে তিনি কুপমুন্ডকতায় ভুগছেন! দ্বিপাক্ষিক এই সিরিজে বাংলাদেশ সেরা দলের মতোই খেলেছে।
সিরিজে বাংলাদেশের এই শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার মিডিয়াও। মেলবোর্নের জাতীয় দৈনিকগুলোর খেলার পাতায় সাকিব মোস্তাফিজের প্রশংসা এবং ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াকে তুলোধুনো করে প্রতিবেদন হয়েছে।
লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং ক্রিকেট বিশ্লেষক।